কাল আজকাল

কামরুল হাসান বাদল | বৃহস্পতিবার , ২ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:২৭ পূর্বাহ্ণ

বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ এবং সুইডেনের উদাহরণ

বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশে ইতিমধ্যে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এ ক্ষেত্রে সুইডেনের সাফল্য অন্যান্য দেশের জন্য মডেল হতে পারে। সুইডেন এখন নিজেদের দেশের বর্জ্য ব্যবহার করা ছাড়াও অন্য দেশ থেকে বর্জ্য আমদানি করছে।
একটি সংবাদমাধ্যমে বলা হয়েছে, সুইডেন রাষ্ট্রীয়ভাবে বর্জ্যের পুনঃপ্রক্রিয়াজাতকরণ (রিসাইক্লিং) করে। এর মাধ্যমে উৎপাদিত বিদ্যুৎ দেশটির মোট চাহিদার প্রায় অর্ধেকটা পূরণ করে। দেশটির রিসাইক্লিং ব্যবস্থা এতটাই অত্যাধুনিক যে গত বছর দেশটির গৃহস্থ আবর্জনার মাত্র ১ শতাংশ ফেলে দেওয়া হয়েছে। সুইডেনে এমন একটি ব্যবস্থাপনা তৈরি করা হয়েছে, যার মাধ্যমে বর্জ্য পোড়ানো থেকে উৎপাদিত তাপ একটি নির্দিষ্ট স্থানে যুক্ত হয়। পরে সেটি শীতকালে ঘর উষ্ণ রাখার কাজে ব্যবহৃত হয়।
সুইডেনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত রিসাইক্লিং অ্যাসোসিয়েশনের যোগাযোগ-সংক্রান্ত পরিচালক আনা-কেরিন গ্রিপওয়াল বলেন, ‘সুইডেনের জনগণ প্রকৃতিবান্ধব। তারা প্রকৃতি ও পরিবেশ বিষয়ে সচেতন। আমরা দীর্ঘদিন বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষের সঙ্গে কাজ করেছি। তাদের বুঝিয়েছি, যেসব বস্তু আমরা পুনঃপ্রক্রিয়াজাত করে পুনরায় ব্যবহার করতে পারি, সেগুলো ঘরের বাইরে ফেলে দেওয়া উচিত নয়।’
দেশটির জনগণ বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়ে সচেতন হয়েছে। এর ফলে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে রিসাইক্লিং সফল হয়েছে। এখন যদি ময়লাই না পাওয়া যায়, এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিতে হবে। ফলে বিদ্যুৎ নিয়ে সংকটে পড়তে হবে সুইডেনকে। এমন পরিস্থিতিতে অন্য কোনো দেশ থেকে ময়লা আমদানির জন্য দেশটির ওপর চাপ তৈরি হচ্ছে। হয়তো ময়লা কিনেই আপাতত এই পরিস্থিতি সামাল দিতে হবে সুইডেনকে নানা দেশ অনেক আগে থেকে বিকল্পধারায় নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ শক্তি উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে। বাংলাদেশে অন্তত দু’দশক থেকে এ বিষয়ে ভাবনা-চিন্তা ও পরিকল্পনা করা হলেও এখন পর্যন্ত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। চট্টগ্রামের আগে নারায়ণগঞ্জ, কেরানীগঞ্জে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের পাইলট প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। চট্টগ্রামে গত এক দশকে অন্তত ২৫টি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এ লক্ষে উদ্যোগ নিয়েছে। এবং প্রতিবারই সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে ‘অনাপত্তিপত্র’ দেওয়া হয়েছে কিন্তু সবকিছুই কেবল উদ্যোগের মধ্যেই রয়ে গেছে।
২০১৮ সালে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) সঙ্গে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোডের্র (পিডিবি) বর্জ্য থেকে ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র স্থাপনে সমঝোতা স্মারক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। চুক্তির শর্ত মতে, চসিক জমি দেবে বিনামূল্যে এবং প্রতিদিন নিজস্ব খরচে বর্জ্য পৌঁছে দেবে বিদ্যুৎ কেন্দ্রে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে পিডিবি। এই প্রতিষ্ঠানটি বিল অন অপারেট অ্যান্ড ট্রান্সফার (বিওওটি) পদ্ধতিতে স্পন্সর ঠিক করবে।
এর জন্য প্রয়োজন ২০ একর জায়গা। চসিকের টিজি সেন্টার হালিশহর বা আরেফিন নগর সংলগ্ন জায়গায় এ প্ল্যান্ট গড়ে তোলার কথা। এ প্রকল্প বাস্তবায়নের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছিল ২০২১ সাল পর্যন্ত। প্রকল্প বাস্তবায়নে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড এবং স্পন্সর প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চারটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিল। এই চারটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শুরু হওয়ার কথা থাকলেও ২০২১ সালের নভেম্বর মাস পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি হয়নি কাজের।
দেশে বিদ্যুৎ ঘাটতি যেমন আছে তেমনি নগরসমূহে বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খল অবস্থাও বিদ্যমান। ফলে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের এই উদ্যোগটি অত্যন্ত সময়োপযোগী বলে মনে করে সবাই। ৬০ লাখের অধিক জনসংখ্যার এই নগরীতে আধুনিক ও স্বাস্থ্যসম্মত কোনো বর্জ্যাগার নেই। একেক সময় একেক জায়গায় নিচু জমিতে বর্জ্য ফেলা হয়। এভাবে জায়গাটি ভরাট হয়ে গেলে অন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়। এভাবেই বছরের পর বছর সিটি করপোরেশন প্রতিদিন প্রায় আড়াই হাজার টন বর্জ্য খোলা জায়গায় ফেলে। এরফলে সৃষ্ট দুর্গন্ধে আশেপাশে মানুষের বসবাস করা দুষ্কর হয়ে পড়ে। বর্জ্যের কারণে পরিবেশ দূষিত হয়ে ছড়ায় নানান রোগব্যাধি। সিটি করপোরেশনের তৎকালীন মেয়র আ. জ. ম নাছির উদ্দিন সে সময় বলেছিলেন, আধুনিক বর্জ্যাগার নির্মাণ বা বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের সামর্থ্য নেই সিটি করপোরেশনের। কাজেই সরকারি প্রতিষ্ঠান পিডিবির সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে এই প্রকল্প গড়ে উঠলে একদিকে বর্জ্য ডাম্পিংয়ের বিশাল ঝামেলা থেকে মুক্ত হবে সিটি করপোরেশন অন্যদিকে জাতীয় গ্রিডে যুক্ত হবে আরও ২৫ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ।
অতীতে আমরা দেখেছি ঢাকঢোল পিটিয়ে অনেক উদ্যোগ শুরু করা হয়। শুরুতে অনেক আশ্বাসবাণী শোনানোও হয় কিন্তু পরবর্তীতে তার বাস্তবায়ন হয় না। বিশ্বকবির ভাষায়, ‘আমরা আরম্ভ করি শেষ করি না’র মতো’। এক্ষেত্রেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি, কাজ এখনও শুরুই হয়নি শেষ করা তো দূরের কথা।
উন্নত দেশেগুলোতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনাও অনেক আধুনিক। বিভিন্ন বর্জ্য ফেলার জন্য সেখানে ব্যবহৃত হয় বিভিন্ন রঙের বিন। কোন রঙের বিনে কোন বর্জ্য ফেলা হবে তা পরিবার থেকে শুরু করে রাস্তার ধারে রাখা বিনেও অনুসরণ করা হয়। কিছু বর্জ্য আছে সহজে পচনশীল, কিছু বর্জ্য অপচনশীল এবং কিছু বর্জ্য যা থেকে দূষণ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। সেসব নিয়ম মেনে বিনে ফেলা হয়। পৌর কর্তৃপক্ষ বর্জ্যগুলো সেভাবেই সংগ্রহ করে। অপচনশীল বর্জ্যগুলো আলাদা করে তা রিসাইক্লিং করার উপযুক্ত হলে তাই করে নতুবা বৈজ্ঞানিক উপায়ে তা ধ্বংস করে। দূষণ বা রোগ জীবাণু ছড়াতে পারে বা মেডিক্যাল বর্জ্যের ব্যাপারে সে সব দেশ অত্যন্ত সতর্ক। তারা সেসবও সতর্কতার সঙ্গে ধ্বংস করে থাকে।
আমাদের দেশে এসবের কোনো বালাই নেই। কলার খোসা থেকে ডাবের খোসা, পলিথিন, পস্নাস্টিক থেকে শুরু করে কর্কসিট, সিরিঞ্জ থেকে স্যানিটারি ন্যাপকিন একইভাবে একইস্থানে ফেলা হয়। সিটি করপোরেশনের গাড়িও সব বর্জ্য একই সঙ্গে তুলে ময়লার ডিপোতে ফেলে।
ব্রাজিলের একটি শহরের মেয়র একটি অভূতপূর্ব কাজ করেছিলেন। নগরীর বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে না পেরে তিনি ঘোষণা করেছিলেন বজ্যের্র বিনিময়ে সিটি করপোরেশন হতে নাগরিকদের বিনামূল্যে সবজি প্রদান করা হবে। যত কেজি বর্জ্য, তত কেজি সবজি। মাত্র ছয়মাসে তিনি তাঁর শহরের নাগরিকদের অভ্যাস পাল্টে দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। চট্টগ্রামের মেয়র এমন একটি উদ্যোগ নিতে পারেন। তবে তা সব বর্জ্যের জন্য নয়। কারণ ৬০ লাখের অধিক নাগরিকের বর্জ্যের বদলে সবজি দিতে গেলে এই নগরে আর কারো কিছু করে খাওয়ার পরিবেশ থাকবে না।
পলিথিন ও প্লাস্টিক পণ্য আমাদের মতো দেশে পরিবেশের জন্য বড় হুমকি হয়ে উঠেছে। আসলে শুধু আমাদের দেশের জন্যই নয়। প্লাস্টিক আজ সারাবিশ্বের জন্যই হুমকি হয়ে উঠেছে। পলিথিনও একপ্রকার প্লাস্টিক। এই প্লাস্টিকের কারণে পরিবেশ ও বিশ্বের প্রাণিবৈচিত্র্য হুমকির মুখে পড়েছে। এর কারণে জমির ঊর্বরা শক্তি কমছে, শহরে জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। প্রতিদিন নালা-খাল দিয়ে এই প্লাস্টিক নদীতে গিয়ে পড়ছে। অপচনশীল এই পদার্থের কারণে খাল ও নদীর তলদেশে একটি আলাদা স্তর তৈরি হচ্ছে। খাল-নালা বা নদী ড্রেজিংয়ে এটি সবচেয়ে বড় বাধা। অন্যদিকে এই পলিথিন অনেক মাছ খাদ্য হিসেবে খাচ্ছে। এই মাছ আবার মানুষ খাচ্ছে এবং এভাবে পলিথিনের বিষাক্ত রাসায়নিক মানবদেহে প্রবেশ করছে।
এই পলিথিন বা প্লাস্টিকের ভয়াবহতা থেকে উদ্ধারের একটি উপায় হলো সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এই জাতীয় বর্জ্য কিনে নেওয়া। কিনে নেওয়া এই বর্জ্য যা রিসাইক্লিং করা যায় তা করা হবে অন্যগুলো স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে ধ্বংস করা হবে।
এই কাজের জন্য বাড়তি বাজেটের দরকার। সে বাজেট আশাকরি সরকার দেবে। দেশকে বাঁচাতে হলে, পরিবেশকে রক্ষা করতে হলে এবং জনগণকে এ কাজে উদ্বুদ্ধ করতে হলে সরকার বা সিটি করপোরেশনকে এভাবে ভাবতে হবে। লাভবান হলে অনেকে এটাকে পেশা হিসেবে নেবে এবং তখন নালা-খাল-নদী থেকে বেছে বেছে তারা প্লাস্টিক পণ্য সংগ্রহ করবে। এভাবে কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে বিপন্ন হতে যাওয়া পরিবেশ। পরিবেশ সুরক্ষায় বিদেশ থেকে প্রচুর সাহায্য আসে দেশে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন আরেকটি নতুন প্রকল্পের মাধ্যমে অর্থ সংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারে। মনে রাখা দরকার পরিবেশকে সুরক্ষা দেওয়াই এখন অগ্রগণ্য কাজ।
লেখক : কবি-সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধদুর্নীতিমুক্ত সমাজ বিনির্মাণ জরুরি
পরবর্তী নিবন্ধড. মঈনুল ইসলামের কলাম