ড. মঈনুল ইসলামের কলাম

| বৃহস্পতিবার , ২ ডিসেম্বর, ২০২১ at ৬:২৮ পূর্বাহ্ণ

খাদ্য সাহায্যের সাম্রাজ্যবাদী মরণচক্রে যেন আর কখনো জাতিকে পড়তে না হয়

জনসংখ্যার অত্যধিক ঘনত্ব, জমি-জন অনুপাতের অত্যল্পতা এবং চাষযোগ্য জমির ক্রম-সংকোচন সত্ত্বেও বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতা অর্জন করে এখন মোটা ধান-উদ্বৃত্ত দেশে পরিণত হয়েেেছ। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের ধান উৎপাদন ছিল মাত্র এক কোটি দশ লাখ টন, ২০২০ সালে তা সাড়ে তিন গুণেরও বেশি বেড়ে তিন কোটি বিরাশি লাখ টন ছাড়িয়ে গেছে। ধান, গম ও ভুট্টা মিলে ২০২০ সালে খাদ্যশস্য উৎপাদন ছিল চার কোটি তিপ্পান্ন লাখ টন। সত্তর লাখ টন আলুর অভ্যন্তরীণ চাহিদার বিপরীতে ২০২০ সালে বাংলাদেশে এক কোটি দুই লাখ টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। মিঠাপানির মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে। তরিতরকারী উৎপাদনে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে চতুর্থ। হাঁস-মুরগীর ডিম ও মাংস উৎপাদনে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ। গরুর মাংস ও দুধ উৎপাদনে দেশে এখনো ঘাটতি রয়ে গেলেও মাংস উৎপাদনে কয়েক বছরের মধ্যেই স্বয়ম্ভরতা অর্জন করা যাবে বলে আশাবাদ সৃষ্টি হয়েছে। ঈদুল আজহার সময় অতীতে চোরাচালানে আসা ভারতীয় গরু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করলেও এখন তার প্রয়োজন হয় না, বরং মাঝে মাঝে কোরবানীর গরু উদ্বৃত্ত থাকছে। (ভারত থেকে গরু চোরাচালান সীমিত পরিসরে অব্যাহত থাকলেও তা ক্রমহ্রাসমান। এই চোরাচালানে ভারত ও বাংলাদেশ দু’দেশেরই চোরাচালানী এবং সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তা ও সৈনিকদের স্বার্থ জড়িত থাকায় তা বন্ধ করা যাবে না)। ছাগল উৎপাদনে আমরা উদ্বৃত্ত অবস্থানে পৌঁছে গেছি। আম, আনারস, কলা, পেয়ারা ও কাঁঠালের মত কয়েকটি প্রধান ফল উৎপাদনেও এখন বাংলাদেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে গেছে, যদিও বিদেশ থেকে নানারকম বিদেশী ফল আমদানি ক্রমেই বাড়ছে। আমরা প্রতি বছর প্রায় ৫৫/৬০ লাখ টন গমও আমদানি করি। তবুও এটা অনস্বীকার্য যে বাংলাদেশে একটি কৃষি বিপ্লব চলমান।
কৃষিখাতের সমৃদ্ধি বাংলাদেশের বৈশ্বিক ইমেজ বদলে ফেলার পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা পালন করে চলেছে। স্বাধীনতার উষালগ্নে বাংলাদেশের টিকে থাকা নিয়ে বিশ্ববাসীর যে প্রবল আশংকা ছিল তার প্রধান কারণই ছিল মারাত্মক খাদ্যঘাটতি। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ হিসেবে শাসকদের অচিন্তনীয় অবহেলা, বৈষম্যমূলক শোষণ ও অবর্ণনীয় বঞ্চনার শিকার হওয়ায় পূর্ব পাকিস্তান পঞ্চাশের দশকেই ক্রমবর্ধমান ‘খাদ্যশস্য ঘাটতি অঞ্চলে’ পরিণত হয়েছিল। ১৯৫৩ সালে শুরু হয়েছিল মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের খাদ্য সাহায্যের মরণফাঁদে পূর্ব পাকিস্তানের বন্দী হওয়ার ট্র্যাজিক ইতিহাস। ঐ সময়টায় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ‘মোহাম্মদ আলী বগুড়া’, গভর্নর জেনারেল ছিলেন জাঁদরেল আমলা মির্জা গুলাম মোহাম্মদ। তাঁদের আমলেই সস্তায় পাওয়া খাদ্য দিয়ে শুরু করা হয়েছিল ওয়ার্কস প্রোগ্রাম ও টেস্ট রিলিফ, সম্প্রসারিত হয়েছিল রেশনিং। ঐ পর্যায়ে পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্য ঘাটতি না থাকলেও ১৯৫৭ সাল থেকে পূর্ব পাকিস্তান ক্রমবর্ধমান ‘খাদ্যশস্য ঘাটতি অঞ্চলে’ পরিণত হয়েছিল, যে ঘাটতি বাড়তে বাড়তে ১৯৭০ সালে প্রায় ৩৫ লাখ টনে পৌঁছে গিয়েছিল। ষাট ও সত্তরের দশকে বিশেষজ্ঞদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, খাদ্য সাহায্য না পেলে পূর্ব পাকিস্তানে/বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ অনিবার্য।
ইতিহাস সাক্ষ্য দিচ্ছে, বিংশ শতাব্দীর পঞ্চাশের দশকে খাদ্য সাহায্য মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের একটি মোক্ষম অস্ত্রে পরিণত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের বাজারে খাদ্যশস্যের দাম পড়ে যাওয়া ঠেকাতে উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য সাগরে ফেলে দেওয়ার প্রসঙ্গটি এ-পর্যায়ে পাঠকদেরকে জানানো প্রয়োজন। এই ব্যাপারটি ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫১ সাল পর্যন্ত পরপর পাঁচ বছর ঘটিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তাদের কৃষিখাতে উৎপাদনের যে স্ফীতি দেখা দিয়েছিল তার মোকাবেলায় ঐ পাঁচ বছর আটলান্টিক মহাসাগরে উদ্বৃত্ত খাদ্য নিক্ষেপ করতে হয়েছিল অভ্যন্তরীণ খাদ্য বাজারে খাদ্যশস্যের দাম স্থিতিশীল রাখার প্রয়োজনে। এই ঘটনার মাধ্যমেই জন্ম হয়েছিল খাদ্য সাহায্যের। পাঠকদেরকে ইতিহাসের আরেকটু পেছনে নিয়ে গেলে বুঝতে সুবিধা হবে কেন বছরের পর বছর এহেন খাদ্যশস্য উদ্বৃত্তের ঝামেলায় পড়তে হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রকে। সমস্যার গোড়াটা রয়ে গেছে ১৯২৯-১৯৩৫ সালের বিশ্ব মহামন্দার মোকাবেলায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট কর্তৃক গৃহীত ’নিউ ডীল’ কর্মসূচীর মধ্যে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ১৯৩২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির প্রার্থী ছিলেন রুজভেল্ট। ঐ নির্বাচনে ডেমোক্রেটিক পার্টির নির্বাচনী ইশতিহারের নাম ছিল ‘নিউ ডীল’। রুজভেল্ট প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়ে ১৯৩৩ সাল থেকে ‘নিউ ডীল’ বাস্তবায়ন শুরু করেছিলেন, যার অন্যতম প্রধান কর্মসূচী ছিল কৃষিতে খাদ্যশস্যের দাম স্থিতিশীল করার জন্য ‘নিম্নতম দাম নির্ধারণ নীতি’ এবং উৎপাদন না করে জমি পতিত রেখে দেওয়ার জন্য জমির মালিককে ‘ক্ষতিপূরণ’ প্রদান। এই দুটো নীতির মধ্যে বোধগম্য কারণেই প্রথম নীতিটা জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল, কারণ সুনির্দিষ্ট দামে কৃষক যত বেশি উৎপাদন করতো তত বেশি তার আয় সুনিশ্চিত হতো। কিন্তু, এই নীতির ফলে উদ্বৃত্তের ঝামেলা সৃষ্টি হওয়ার আগেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় আসল ঝামেলাটা টের পাওয়া গিয়েছিল যুদ্ধের পর। প্রথমে মার্কিন সরকার উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য নির্দিষ্ট দামে কিনে নতুন নতুন গুদামে মজুত করতে শুরু করলো। কিন্তু, পরপর দু’তিন বছর যখন ক্রমাগতভাবে উদ্বৃত্তের পাহাড় জমতে শুরু করল, তখন ভুলটা বোঝা গেল। সরকার পড়ল বিপাকে। উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য কেনার জন্য বাজেটে ব্যয় বরাদ্দ, ক্রয়ের ব্যবস্থা গড়ে তোলা, সংগৃহীত খাদ্যশস্য পরিবহন, গুদামজাতকরণ এবং মজুত করা খাদ্য বিক্রয়–প্রত্যেকটি বিষয়ই ব্যয়বহুল। এক মৌসুমের গুদামজাত খাদ্য বিক্রি করে গুদাম খালি না করলে পরের মৌসুমের খাদ্য সংগ্রহের ঝামেলা বেড়ে যাচ্ছিল। আবার বিক্রয়ের চেষ্টা করলে খাদ্যশস্যের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক বাজার দামে ধস নামছিল। এই সমস্যা থেকে রেহাই পেতে পরপর পাঁচ বছর উদ্বৃত্ত খাদ্যশস্য জাহাজে বোঝাই করে আটলান্টিক মহাসাগরে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। এর পরিপ্রেক্ষিতেই হিসাব-নিকাশ করা হলো, মহাসাগরে ফেলে না দিয়ে জাহাজগুলোর খাদ্যশস্য যদি বিভিন্ন মার্কিনপন্থী দেশে ’খাদ্য সাহায্য’ প্রদানের জন্য প্রেরিত হয় তাহলে খাদ্যেশস্যের কোন মূল্য আদায় না করলেও সংগ্রহ-খরচ, মজুত-খরচ, পরিবহন-খরচ ও জাহাজ ভাড়া দিতে সাহায্য-গ্রহীতা দেশ রাজি হলে ঐ ব্যবস্থাটা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বিরাট ব্যয়সাশ্রয়ী হবে। এই হিসাব-নিকাশ থেকেই ১৯৫৩ সাল থেকে তদানীন্তন ঠান্ডাযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মার্কিন-মক্কেল রাষ্ট্র পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, মিশর, তুরস্ক ও ফিলিপাইন, যুদ্ধবিধ্বস্ত দক্ষিণ কোরিয়া ও দক্ষিণ ভিয়েতনামে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য সাহায্যের প্রক্রিয়াটি শুরু হয়েছিল। এ সম্পর্কে প্রামাণ্য দলিল উপস্থাপিত হয়েছে ইউএসএইডের একজন প্রাক্তন কর্মকর্তা টেরেসা হেয়টার রচিত বিশ্বের ‘বেস্ট সেলার’ এইড এজ ইমপেরিয়ালিজম গ্রন্থে।
খাদ্য সাহায্যের জালে বিভিন্ন দেশকে আটকে ফেলার পর খাদ্যশস্য আর ‘সাহায্য’ থাকে নি। সাহায্যের শর্তগুলো ক্রমান্বয়ে এমন শক্ত ও জটিল করে ফেলা হয়েছিল যে পুরো ব্যাপারটাই একটা নিষ্ঠুর ব্ল্যাকমেইলিংয়ে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘পি এল ৪৮০’ খাদ্য কর্মসূচীর শর্তের বহর সম্পর্কে যাঁরা ওয়াকিবহাল তাঁরা এই শর্তগুলোর অপমানজনক চারিত্র অনুধাবন করবেন! পিএল ৪৮০ টাইটেল ১ থেকে টাইটেল ৪ পর্যন্ত প্রতিটি কর্মসূচীর শর্তাবলী ক্রমেই কঠোর থেকে কঠোরতর করা হয়েছে, এবং এগুলো পাকিস্তান ও বাংলাদেশকে গলাধঃকরণ করতে হয়েছে। পঞ্চাশ দশকের শেষদিকেই খাদ্যশস্যের উচ্চ দাম নির্ধারণ শুরু করা হয়েছে, এবং খাদ্যের মোট মূল্যের অর্ধেক স্থানীয় মুদ্রায় পরিশোধ করার শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ঐ মূল্য বাবদ প্রাপ্ত অর্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজের ইচ্ছেমতোন পাকিস্তানে এবং বাংলাদেশে খরচ করতে পারতো, কিন্তু কোথায় খরচ করা হচ্ছে তা জানার কোন অধিকার দেশের সরকারের ছিল না। টেরেসা হেয়টার বলছেন, সন্দেহ করার কারণ রয়েছে যে মার্কিনপন্থী রাজনৈতিক দল, রাজনৈতিক নেতা, সামরিক অফিসার, সিভিল আমলা, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক এবং সমাজের প্রভাবশালী ব্যক্তি ও সংগঠনগুলোর আনুগত্য কেনার জন্য এই অর্থ দেদারসে ব্যবহার করা হতো। প্রয়োজনে, সামরিক অভ্যুত্থান এবং গণ আন্দোলন উসকে দেওয়ার জন্যও এই ফান্ড ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন দেশে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করায় তাদের কাছ থেকে কোন সাহায়্য নেবে না বলে প্রাথমিক অবস্থান নিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর সরকার। কিন্তু, শেখ মনি ও খোন্দকার মোশতাকের নেতৃত্বাধীন মার্কিন লবী ক্রমেই বঙ্গবন্ধুর মন জয় করে নিয়েছিল। তাই অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দিনের জোর আপত্তি অগ্রাহ্য করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফকে আবাহন জানিয়েছিল বাংলাদেশ। মনে করা হয়, মারাত্মক খাদ্য ঘাটতি মোকাবেলায় ব্যর্থ হওয়ার ভয় বঙ্গবন্ধুকে ঐ সিদ্ধান্ত গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করেছিল। কিন্তু, স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের প্রকট খাদ্য-ঘাটতির পূর্ণ সুযোগ নিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্ব ব্যাংক। প্রথমে পাকিস্তানের ঋণের দায় নিতে হবে দাবি জানিয়ে কালক্ষেপণের চাণক্য নীতি গ্রহণ করেছিল তারা। পরে, বাংলাদেশ কিউবার কাছে পাটের বস্তা রপ্তানি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-আরোপিত অবরোধ কেন লঙ্ঘন করল তার কৈফিয়ত চেয়ে ১৯৭৪ সালে খাদ্যশস্যবাহী কয়েকটি জাহাজকে সাগরের যাত্রাপথ থেকে বিভিন্ন দেশের বন্দরে নোঙর করতে বাধ্য করে যাত্রা বিলম্বিত করে দিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ফলে, কূটনৈতিক চ্যানেলে দুঃখ প্রকাশ করে কয়েক মাস পর মার্কিন খাদ্যসাহায্য পুনরায় চালু করা গেলেও সরকার দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে পারেনি। প্রফেসর নুরুল ইসলামের বই ‘মেকিং অব এ নেশন বাংলাদেশ: এন ইকনমিস্ট’স টেইল’ এ এই কাহিনীর বর্ণনা রয়েছে। প্রধানত এজন্যেই ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর সরকার অনেক সাধ্য-সাধনা করে বাংলাদেশকে জাতিসংঘের ‘স্বল্পোন্নত দেশের’ ক্যাটেগরিতে অন্তর্ভুক্ত করাতে সক্ষম হয়েছিল, যাতে বাংলাদেশ এর ফলে বৈদেশিক খাদ্য সহায়তা এবং ‘সফট লোন’ পাওয়ার ব্যাপারে বিশেষ বিবেচনা পায়। চরম খাদ্যশস্য ঘাটতি এবং বিশেষ করে ১৯৭৪ এর দুর্ভিক্ষের কারণে বঙ্গবন্ধু ঐ পর্যায়ে বৈদেশিক ঋণ/অনুদানকে এবং বিশেষত খাদ্য অনুদানকে অপরিহার্য বিবেচনা করেছিলেন। এটা খুবই তাপর্যপূর্ণ যে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকান্ডের পর এদেশে বৈদেশিক সাহায্যের বান ডেকেছিল, যার প্রায় ৪০-৪৫ শতাংশই থাকতো খাদ্যসাহায্য।
পুরো আশির দশক ও নব্বইয়ের দশকে বাংলাদেশ সরকারকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ এর কাছে নতজানু থাকতে হতো খাদ্যঘাটতি পূরণের মূল চাবিকাঠি তাদের কাছে থাকার কারণে। ১৯৫৭ সালের ৪২ বছর পর বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে স্বয়ম্ভরতার কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল ১৯৯৯ সালে শেখ হাসিনার শাসনামলে, কিন্তু ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আওয়ামী লীগ আমলের কৃষিনীতি পরিত্যাগ করায় আবার দেশে খাদ্যঘাটতি বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে খাদ্যসাহায্যও বেড়ে গিয়েছিল। এতদ্‌সত্ত্বেও, ২০০৬ সালে বিএনপি-জামায়াত সরকার দেশের খাদ্যশস্যের মজুতকে বিপজ্জনকভাবে কমিয়ে ফেলায় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭-৮ সালে ফলন বিপর্যয় ও খাদ্যমজুতের স্বল্পতার কারণে দেশ আরেকটি দুর্ভিক্ষের কবলে পড়ার আশংকা সৃষ্টি হয়েছিল। অবশেষে, বর্তমান সরকারের নিষ্ঠাবান প্রয়াসের ফলে ২০১১ সালে বাংলাদেশ মোটা ধান উৎপাদনে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করেছে। ১৯৭২ সালে দেড় কোটি টন ধান লাগতো আমাদের, অথচ উৎপাদন করতে পারতাম মাত্র এক কোটি দশ লাখ টন। গত বছর এদেশে তিন কোটি বিরাশি লাখ টন ধান উৎপাদিত হয়েছে। সতের কোটির বেশি মানুষের খাদ্যশস্য যোগান দিয়েও এখন প্রায় প্রতি বছর মোটা ধান উদ্বৃত্ত হচ্ছে আমাদের। খাদ্যসাহায্য এখন আমাদের বৈদেশিক ঋণ/অনুদানের এক শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। আল্লাহর রহমতে খাদ্যসাহায্যের মরণচক্র থেকে জাতিকে উদ্ধার করেছেন এদেশের কৃষক সমাজ, চলমান কৃষি বিপ্লবের জন্যে তাঁদেরকে অভিনন্দন ।
লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধকাল আজকাল
পরবর্তী নিবন্ধসেন্ট্রাল পাবলিক কলেজে বিদায় সংবর্ধনা