একজন রাষ্ট্রনায়কের প্রকৃতিপাঠ

সালমা বিনতে শফিক | শনিবার , ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ৭:৪৩ পূর্বাহ্ণ

১৯২৮ সালের কথা। ভারতের এক কালের ডাকসাইটে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তখন দশ বছরের ছোট্ট মেয়েটি। গ্রীষ্মের ছুটিতে গিয়েছিলেন হিমালয়ের পাদদেশের জনপদ মুসৌরিতে। বাবা জওহরলাল নেহেরু কাজে ব্যস্ত এলাহাবাদে। মেয়ের সঙ্গে সময় কাটাতে ব্যাকুল বাবা পুরো গ্রীষ্মকাল জুড়ে মেয়েকে চিঠি লিখে গিয়েছেন একের পর এক। কি কথা লেখা ছিল সেইসব চিঠিতে? প্রতি চিঠিতে তিনি গল্প বলেছেন মেয়েকে; কেমন করে কখন পৃথিবী নামক গ্রহটার পথচলা শুরু, জীবনের উত্থান, সভ্যতার সূচনা। ছুটি ফুরিয়ে গেলে গল্প ফুরোবার নয়।
দশ বছর বয়সী কন্যাকে এসব কেনইবা বলতে গেলেন পিতা? পরাধীন ভারতবর্ষে বিলেতফেরত বাবাটির তখন কাজের শেষ নেই। ভারতমাতাকে মুক্ত করার অভিপ্রায়ে মহাত্মা গান্ধী, মৌলানা আজাদদের সঙ্গে বৈঠকের পর বৈঠক। মেয়ের কথা ভোলেননা। প্রথম চিঠিতেই বাবা চিঠি লেখার যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেন- আমাদের পৃথিবীটা এখন অনেকগুলো ছোট বড় রাষ্ট্রের মধ্যে ভাগ হয়ে আছে। তবে পৃথিবীনামক গ্রহটা কিন্তু আমাদের সকলের। বাবার বিশ্বাস তাঁর চিঠিগুলো মেয়েকে বুঝতে শেখাবে যে এই পৃথবীতে বসবাসকারী সকল জনগোষ্ঠী আমাদের ভাইবোন।
বাবা চাইতেন মেয়ে তাঁর শিক্ষা গ্রহণ করুক প্রকৃতি থেকে, নিজের চারপাশ থেকে। সেজন্য প্রথম চিঠির শিরোনাম দিয়েছিলেন ‘বুক অব নেচার’। ইন্দিরা ছেলেবেলাতেই প্রকৃতিকে বই হিসেবে গ্রহণ করেছিল। আশেপাশে পড়ে থাকা পাথর, বৃক্ষলতা, পোকামাকড় দেখে দিনের অনেকটা সময় কাটত তার। আর রাতে দেখত তারকারাজি।
যে শিশু প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি ভালোবাসা নিয়ে বড় হয় স্বভাবতই প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি তার দায়িত্ববোধ জন্ম নেয় ছেলেবেলাতেই এবং সেই ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ চলমান থাকার কথা জীবনভর। প্রকৃতি ও মানুষকে ভালোবাসতে ভালোবাসতে বেড়ে ওঠা শিশু বড় হয়ে পৃথিবীর অমঙ্গল চিন্তাা করতে পারে না।
নেহেরুর ইতিহাস চিন্তা এতটাই আধুনিক ও উদারপন্থী ছিল যে কিশোরী কন্যাকে লেখা তার চিঠিগুলো প্রকাশের নয় দশক পরও তাদের প্রাসঙ্গিকতা বিন্দুমাত্র কমেনি, বরং বেড়েছে। কারণ অনেক মানুষের জীবনযাত্রার মানের ব্যাপক উন্নয়ন হলেও জীবনে জটিলতা বাড়ছে; আগের তুলনায় ক্রমশ সহিংস হয়ে উঠছে পৃথিবী। জাতিগত বিদ্বেষ ও প্রকৃতির প্রতি নির্মমতা আমাদের ভালোবাসার পৃথিবীকে ক্রমাগত উত্তপ্ত করে তুলছে।
চিঠিগুলো ইংরেজিতে লেখা। ‘লেটার্স ফ্রম অ্যা ফাদার টু হিজ ডটার’ নামে ইংরেজিতে বই আকারে প্রকাশিত হবার পর পৃথিবীর নানান ভাষায় তা অনূদিত হয়েছে। বাংলা ভাষায় ‘বাবার চিঠি’, ‘কল্যাণীয়াসু’ নামে অন্তত দু’ধরনের সংকলন বের হয়েছে।
প্রায় শতবছর আগে একজন রাজনীতিবিদ বাবার তার মেয়ের কাছে লেখা চিঠিগুলো আমাদের নতুন প্রজন্মের শিশুকিশোরদের মনে প্রকৃতি ও মানুষের প্রতি গভীর ভালোবাসা জাগিয়ে তুলবে। ওরা পৃথিবীটাকে বাসযোগ্য করবে, হাল ধরবে নতুন পৃথিবীর। পরিবার, সমাজ, দেশ, পৃথিবীর প্রতি সমানভাবে দায়িত্বশীল হবে। আর সেকারণেই আমাদের বিদ্যালয়গুলোর পাঠ্যতালিকায় থাকা চাই এই বইটি।
একালের বাবা মায়েদের জন্যও অবশ্য পাঠ্য আলোচ্য গ্রন্থটি। চিঠিগুলোর কোথাও বাবা মেয়েকে একবারের জন্যও বলেননা তোমাকে প্রথম বা সেরা হতে হবে, কিংবা দেশ বা বিশ্বের সেরা প্রতিষ্ঠানে পড়তে যেতে হবে। আমাদের ছেলেমেয়েরা এখন দিনরাত বইখাতা (বই বলতে কেবলই পাঠ্যবই) আর তথ্যপ্রযুক্তির নানাবিধ যন্ত্রপাতি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। মাটি থেকে আকাশ জুড়ে প্রকৃতির খেলা চোখ মেলে দেখার সময় হয় না ওদের। ইচ্ছেও হয় না। দোষটা ওদের নয়, আমাদেরই। দিনের আকাশে প্রথম সূর্যোদয়, পাখপাখালি, কীট পতঙ্গ, লতা-গুল্ম, বৃক্ষরাজি, আর রাতের আকাশের তারকা নক্ষত্ররাজি দেখে ওরা পড়ার ব্যাঘাত ঘটাক, তা আমরা চাই না। সেকারণে প্রকৃতির সঙ্গে ভালোবাসাবাসি হয়ে ওঠে না ওদের। অসুস্থ প্রতিযোগিতা অনৈতিকতা ও সহিংসতার বিস্তার ঘটিয়ে চলেছে সমাজের সর্বত্র। আমরা দেখেও দেখছি না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঅনার কিলিং
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে ২৪ ঘণ্টায় করোনা আক্রান্ত ৫৪ জন