অনার কিলিং

সাদিয়া মাহজাবীন শশী | শনিবার , ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ at ৭:৪২ পূর্বাহ্ণ

দু’হাজার উনিশ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত জার্মান ভাষার চলচ্চিত্র ‘আ রেগুলার উইম্যান’-এর খানিকটা গল্প বলে শুরু করি। চলচ্চিত্রে তিন ভাই থাকে; নুরি, তারিক আর সিনান যারা প্রতি সপ্তাহের নির্দিষ্ট দিনে একটি স্টাডি সার্কেলে যোগ দেয়। এই সার্কেলের বক্তা মূলত একজন ইসলাম ও কোরান বিশারদ, যার রোজকার বক্তব্যেই নারীদের চাল-চলন তথা আকিদা বিষয়ে গরম গরম বার্তা থাকে। সেই বার্তায় উদ্দীপ্ত হতে হতে সবচে ছোট ভাই নুরি একদিন তাদের আপন বড়বোন আইনুরকে গুলি করে মেরে ফেলে। আইনুরের অপরাধ? তাঁর অপরাধ হচ্ছে, স্বামীর শারীরিক নির্যাতন সইতে না পেরে শিশু সন্তানকে সঙ্গে করে সে বাবার বাড়ি ফিরে এসেছে, আইনুর হিজাব ত্যাগ করে বাড়ির বাইরে গিয়ে মেকানিকের কাজ নিয়েছে, আইনুর ধুমপান এবং মদপান করে, আইনুর জিন্স-টপস পড়ে কিন্তু বোরকা চাপায় না, আইনুরের ছেলেবন্ধু আছে, সর্বোপরি আইনুর স্বাধীন জীবন যাপন করছে। দু হাজার পাঁচ সালে বার্লিনে ঘটে যাওয়া একটি অনার কিলিং-এর ঘটনা অবলম্বনে এই চলচ্‌িচত্র।
‘অনার কিলিং’ শব্দটি আমরা শুনেছি, অনেকে খোঁজ-খবরও রাখি। তবুও সামান্য করে বলে নিই। সম্মান রক্ষার্থে হত্যা বা অনার-কিলিং হল কাউকে নিজের পরিবার বা গোত্রের সম্মানহানির দায়ে ঐ পরিবার বা গোত্রের অপর ব্যক্তি কর্তৃক হত্যা করা, যার মাধ্যমে এই সম্মানহানির উপযুক্ত প্রতিকার হয়েছে বলে মনে করা হয়। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশেই অনার কিলিং প্রচলিত যার প্রধানতম শিকার হলো নারী। ভারত, পাকিস্তান, জর্ডান, লেবানন, মরোক্কো, সিরিয়া ছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে প্রকাশ্যে বা গোপনে কিংবা ভিন্ন নামে এ-প্রথা প্রচলিত। তবে ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানীর মত দেশেও অনার কিলিং-এর খবর আজও পাওয়া যায়। মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান, ইহুদি অর্থাৎ প্রধান কয়েকটি ধর্মানুসারী দেশেই এসব ঘটনার বাড়-বাড়ন্ত। যুক্তরাষ্ট্রের এক সমীক্ষায় দেখা যায় পৃথিবীতে প্রতি বছর অনার কিলিং-এর নামে প্রায় পাঁচ হাজার জনকে হত্যা করা হয়, যাদের আটানব্বই ভাগই নারী। মধ্যপ্রাচ্যের এবং দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার নারীবাদী সংগঠনের এক হিসাবমতে প্রতি বছর প্রায় বিশ হাজারের উপর মেয়েকে অনার কিলিং-এর নামে হত্যা করা হয়।
এতদঅঞ্চলের ইতিহাসে ‘সতীদাহ’ একটি মর্মন্তুদ অধ্যায়। এই সতীদাহও এক ধরনের অনার কিলিং হিসেবে গণ্য কেননা সতীদাহ আত্মহত্যা নয়, আগুনে পুড়ে মরতে বাধ্য করা হত ওই নারীদের। বৃটিশরাজ আসার পর এই প্রথা বন্ধ হয়েছে বটে। কিন্তু চেতনার ধিকি ধিকি আগুন কি আর সহজে নেভে? নেভে না। বরং সেই আগুন আজও উসকে দেয় বহুজনে, শরীরে না-মরে মনে মনে মরে আজো লক্ষ নারী। ভাবছেন আলটপকা কথা বলছি? কীভাবে ঘটছে এসব? কোথায় ঘটছে! আবছায়া একটা ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করবো এইবেলা। তার আগে জেনে নিই আপনাপন মাযহাব-গোত্র-কাস্টের মহান সম্মান রক্ষার্থে হত্যার ক্ষেত্রে যেসকল কারণ প্রধান তার মধ্য রয়েছে পরিবারের অমতে বিয়ে, নিম্নবর্ণ বা মর্যাদার কাউকে বিয়ে করা, বিবাহ-পূর্ব সম্পর্ক, বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক, বিবাহ-বহির্ভূত সম্পর্ক আছে বলে সন্দেহ পোষণ করা, ধর্মীয় বিধি-নিষেধ অবজ্ঞা করা, সামাজিক বা গোত্রীয় বিধি-নিষেধ অবজ্ঞা করা। কিন্তু আমাদের দেশে তো এরকম কোনও খবর আমরা পাই না, তাই নয় কি? আমাদের দেশের আইন-শৃঙ্খলা খুবই কঠিন এবং কঠোর। কিন্তু একটু আগেই বলতে চাইছিলাম যে কথাটা সেটি এবারে খোলাসা করি। দেখুন ‘অনার-কিলিং’ শব্দবন্ধটি থেকে ‘অনার’ আর ‘কিলিং’ একটু আলাদা করে নিয়ে ভাবি। অনার বা সম্মান তার জায়গায়ই থাকুক। কিলিং কি শুধুই হত্যা বা শরীরের মরে যাওয়াতেই সীমাবদ্ধ? যৌন সহিংসতা, ধর্ষণ, যৌন দাসত্ব, নারীর প্রতি অশ্লীল আচরণ বা বাক্য ব্যবহার এসবও কি মানুষ হিশেবে নারীর মৃত্যু ঘটায় না? প’লে প’লে মানসিক মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় না? এই যে বিব্রস্ত্র করে নারীকে পেটানো, সেই বিভৎস অত্যাচারের ভিডিও তুলে সেটি বাজারে ছেড়ে দেওয়া, এই যে সোশ্যাল মিডিয়ায় যেকোনও ইস্যুতে নারীদের অকথ্য ভাষায় গালাগাল করা, এই যে কোনও একটা নারী বিষয়ক ইস্যুতে পক্ষ-বিপক্ষে জুটে গিয়ে নারীর বিরুদ্ধে সালিশ বসিয়ে গণরায় দিয়ে দেওয়া, নারীর পোশাক নিয়ে, নারীর ঋতুস্রাব, নারীর রাত করে বাইরে থাকা নিয়ে এবং এরকম হাজারটা বিষয় নিয়ে…এই যে সোশ্যাল মিডিয়ায় রায়ের আসর খুলে নিয়ে বসে, তারা কারা? নিশ্চয় নারীরা নয়। তারা আমাদেরই ভাই-বন্ধু-স্বজন, তবে লিঙ্গে পুরুষ। হাজার বছরের বহমান চেতনা বদলে নারীরা সময়কে ধরতে চাইছেন ঠিকই কিন্তু নারীর প্রতি হাজার বছরের বহমান চেতনা বদলালেন না পুরুষরা। তাই এই পুরুষরা মনের পশুটিকে শান্ত রাখার প্রক্রিয়ায় যতোটা পারেন, যেভাবে পারেন নারীদের অপদস্থ-হেনস্থা করতে উঠেপড়ে লাগেন সাধ্যমতো যেকোনও উসিলায়। আর পুরুষের অন্তরের এই ধিকি ধিকি আগুনকে উসকে দেওয়ার জন্য মাঠে-ঘাটে-স্ক্রিনে বাড়-বাড়ন্ত হয়ে ফুটছে শতেক বক্তা। এর বাইরে, যে-পুরুষটি বা যারা নারীর গায়ে হাত তুলে ফেলে, ধর্ষণটা করেই ফেলে, গালিটা মুখের উপরেই দিয়ে ফেলতে পারে, এমনকী হত্যাও করে ফেলে তাদের কথা বলা বাহুল্যই। একটু ভেবে দেখবেন কি যে এসবই অনার কিলিং-এর আওতায় পড়ে কী-না? অনার কিলিং মানে, সম্মান রক্ষার্থে নারীকে হত্যার চাইতে নারীর সম্মানহানী ঘটিয়ে তার নারীসত্তার মন-মননকে গুড়িয়ে দেওয়ার, দমিয়ে রাখার এক নয়া পাঁয়তারা হিশেবে বুঝতে চাইছি আমি। তাতে করে এর বিরুদ্ধে লড়াই করার পথটা সহজ হবে বৈকি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেয়াং পাহাড়ে মা মারিয়া তীর্থ উৎসবে মিলনমেলা
পরবর্তী নিবন্ধএকজন রাষ্ট্রনায়কের প্রকৃতিপাঠ