আষাঢ়ী পূর্ণিমা : বৌদ্ধবিশ্বে বরণীয় ও আত্মবোধনের দিন

শ্যামল চৌধুরী | শুক্রবার , ২৩ জুলাই, ২০২১ at ১:৩৩ পূর্বাহ্ণ

সুদূর অতীতকাল থেকে বছরের বিশেষ কোনো সময়কে কেন্দ্র করে মানবজাতির আনন্দোৎসবের ধারা প্রবহমান।

সেসব তাৎপর্যময় দিনগুলোতে রয়েছে একটি শ্বাশত আনন্দের নির্মল অনুভূতি। তার মধ্যে মানবের দুঃখমুক্তির পথ প্রদর্শনকারী মহাকারুণিক তথাগত গৌতম বুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত পূর্ণিমাগুলোর মধ্যে আষাঢ়ী পূর্ণিমা অন্যতম গুরুত্ববহ তিথি।

মহামানব গৌতম বুদ্ধের আবির্ভাব হয়েছিল খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীতে। বুদ্ধজীবনের স্মৃতিবিজড়িত আষাঢ়ী পূর্ণিমার রয়েছে ঘটনাবহুল তাৎপর্য।

এ মহান দিনে রাজকুমার সিদ্ধার্থ গৌতম রাণী মহামায়ার জঠরে প্রতিসন্ধি গ্রহণ করেন। শুভ বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতে হিমালয়ের পাদবিধৌত দেবদেহ নগরের সীমান্ত অঞ্চলে লুম্বিনী নামক উদ্যানে সিদ্ধার্থ গৌতম জন্মগ্রহণ করেন।

বয়স তখন ঊনত্রিশ বছর। রাজকুমার সিদ্ধার্থ একদিন সারথি ছন্দকের সাথে নগর পরিভ্রমণে বের হলেন। সেদিন তিনি দেখতে পেলেন জরাগ্রস্থ এক বৃদ্ধ, ব্যাধিগ্রস্থ এক লোক এবং এক মৃতব্যক্তি। বিভীষিকাময় লোমহর্ষক তিনটি ভিন্ন নিমিত্ত দর্শনের পর দেখলেন শান্ত সমাহিত গেরুয়া বসনধারী এক সন্ন্যাসী।

সিদ্ধার্থের অন্তরে গভীর ভাবোদয় হলো। জীবনের প্রাচুর্যের মধ্যে থেকেই তিনি জীবন সত্যকে উপলব্ধি করেন। তাঁর মতে এ জগতে দুঃখ অনন্ত-অসীম এবং সময় অতি ক্ষণস্থায়ী। অতঃপর দুঃখমুক্তির পথ সন্ধানে সিদ্ধার্থের গৃহত্যাগের সিদ্ধান্ত….।

আষাঢ়ী পূর্ণিমার এক গভীর রাতে রূপবতী স্ত্রী যশোধরা, পুত্র রাহুল ঘুমিয়ে আছে। সিদ্ধার্থ রাজসিংহাসনের ক্ষণিকের মায়া-মোহকে তুচ্ছ করে গৃহত্যাগ করলেন। অতঃপর রাজ আভরণ পরিত্যাগ করে কেশছেদন করে সন্যাস ধর্ম গ্রহণ করেন। রাজকুমারের এ গৃহত্যাগকে মহাভিনিস্ক্রমণ বলা হয়। পৃথিবীর ইতিহাসে এমন ঘটনা বিরল যেখানে কোনো রাজা-বাদশা, রাজকুমার রাজ্যত্যাগ এবং বিবাহিত স্ত্রী-সন্তান ত্যাগ করে গৃহত্যাগ করেছে।

অতঃপর নেপালের নৈরঞ্জনা নদীর তীরে মহাবোধিবৃক্ষমূলে ৬ বছর কঠোর সাধনায় তিনি বোধিজ্ঞান অর্থাৎ বুদ্ধত্ব লাভ করেন। সিদ্ধার্থ খুঁজে পেলেন দুঃখের কারণ। সেই গৃহকারক আর কেউ নয় আপন অন্তরে লুকিয়ে থাকা তৃষ্ণা। তৃষ্ণার ক্ষয় মানে নির্বাণ কিন্তু এই পথে যেতে হলে প্রয়োজন অবিদ্যা ও মিথ্যাদৃষ্টির পরিহার। অহিংসার মানসিকতা। দান, শীল, ভাবনাময় চেতনা।

বুদ্ধত্ব লাভের ২ মাস পরে শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমায় সারনাথের ঋষিপতন মৃগদাবে গিয়ে তিনি সর্বপ্রথম পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের নিকট ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্রের মাধ্যমে তাঁর নবলব্ধ ধর্মপ্রচার করেন।

আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথিতেই মহাকারুণিক বুদ্ধ তাঁর নবলব্ধ জ্ঞানকে সর্বপ্রথম সারনাথের ইসিপতন মৃগদাবে পঞ্চবর্গীয় শিষ্যের নিকট প্রচার করেন অর্থাৎ তিনি বুদ্ধাসনে উপবেশনপূর্বক আঠার কোটি ব্রহ্মা পরিবেষ্টিত পঞ্চবর্গীয় শিষ্যদের সম্বোধন করে ‘ধর্মচক্র প্রবর্তন সূত্র’ দেশনা করেন।

তাঁদের মধ্যে কোন্ডণ্য বুদ্ধ ধর্মদেশনানুসারে জ্ঞান সম্প্রসারিত করে আঠার কোটি ব্রহ্মার সাথে স্রোতাপত্তি ফলে প্রতিষ্ঠিত হলেন। পরে পঞ্চবর্গীয় ভিক্ষুর সবাই অর্হত্ব লাভ করেন। এজন্য এ তিথি ধর্মচক্র প্রবর্তন তিথি নামেও অভিহিত।

উল্লেখ্য, সম্রাট অশোক সারনাথে ত্যাগ, মৈত্রী ও মানবতার প্রতীক স্তম্ভ নির্মাণপূর্বক তাতে ধর্মচক্র প্রতীক স্থাপন করেছেন। এটাকে অশোক চক্র বলা হয়ে থাকে।

এ পূর্ণিমা তিথিতে বুদ্ধ শ্রাবস্তীর গন্ড আম্র বৃক্ষমূলে যমক ঋদ্ধি প্রদর্শন করেন। ত্রিপিটক শাস্ত্রে এই যমক ঋদ্ধি প্রদর্শন সম্পর্কে বহু বিষয় বিস্তারিত লিপিবদ্ধ রয়েছে। এ তিথিতেই বুদ্ধ মাতা রাণী মহামায়াকে ধর্মদেশনা প্রদানের উদ্দেশ্যে তাবতিংস স্বর্গে গমন করেন।

এ দিনে পূজনীয় ভিক্ষুসংঘের ত্রৈমাসিক বর্ষাব্রত আরম্ভ হয়। আষাঢ়ী পূর্ণিমা থেকে আশ্বিনী পূর্ণিমা পর্যন্ত তিন মাসব্যাপী বুদ্ধ নির্দেশিত শীল পালনের মাধ্যমে ভিক্ষুসংঘ বর্ষাব্রত অধিষ্ঠান করে থাকেন। সদ্ধর্মের শ্রীবৃদ্ধিতে তাঁদের ভূমিকা অনস্বীকার্য।

এ শুভ আষাঢ়ী পূর্ণিমা দিবসটি বাংলাদেশ ছাড়াও সমগ্র বৌদ্ধবিশ্বে পরম শ্রদ্ধার সাথে পালিত হয়ে আসছে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর আষাঢ়ী পূর্ণিমার গুরুত্ব উপলব্ধি করেছিলেন এবং যথাযথ মর্যাদায় তা পালন করতেন। শান্তিনিকেতনে তাঁর সময়ে এ পুণ্যতিথিতে ‘ধর্মচক্র প্রবর্তন উৎসব’ যথারীতি অনুষ্ঠিত হতো।

উপরোক্ত স্মৃতি বিজড়িত আষাঢ়ী পূর্ণিমা তিথি সকল বৌদ্ধের কাছে তাই একটি বরণীয় এবং আত্মবোধনের দিন হিসেবে পরিগণিত। এখানে বুদ্ধের বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির ব্যাপ্তি অনেক বিশাল যেখানে বুদ্ধ ক্ষণিক সুখ ও ক্ষণিক ভোগ-ঐশ্বর্য ত্যাগ করে বৃহত্তর সুখের জন্য এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন।

দীর্ঘ ৪৫ বছর জীব জগতের কল্যাণে অমৃতময় নির্বাণ ধর্ম প্রচার করেন তিনি। তৎকালীন জম্বুদীপ সহ সমগ্র পৃথিবীতে বুদ্ধের ধর্ম ছড়িয়ে পড়ে। এক বৈশাখী পূর্ণিমা তিথিতেই জগতপূজ্য এ মহামানব ৮০ বৎসর বয়সে কুশীনগরের মল্লদের শালবনে মহাপরিনির্বাপিত হন।

লেখক: সংস্কৃতিকর্মী, প্রাবন্ধিক ও গীতিকার। সম্পাদক, ‘অমিতাভ’ (সমাজ, সাহিত্য, সংস্কৃতি বিষয়ক পত্রিকা)
ই-মেইল : amitabhactg@yahoo.com

পূর্ববর্তী নিবন্ধটেকনাফে পল্লী বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে বাড়ির উপর পড়ে দু’জনের মৃত্যু
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে আরও ৬ জনের মৃত্যু, শনাক্ত ৪৫১