হল্যান্ড থেকে

বিকাশ চৌধুরী বড়ুয়া | শনিবার , ৯ অক্টোবর, ২০২১ at ৬:৩৯ পূর্বাহ্ণ

সুইজারল্যান্ডের চিঠি
চলে গেলেন বাংলাদেশ প্রেমিক-নিকোলা

আশি বছরের বেশি বয়স হবে নিকোলার। বিরাশি কী তিরাশি। এখনো কী সুন্দর। অতি উজ্জ্বল গায়ের রং। জেনেভা এসেছি শুনে ফোনে বলেন, ‘বিকাশ আমি তো তোমার অনুষ্ঠানে আসতে পারছি না, কারণ এখন আমি হাসপাতালে। তোমার সময় হলে একবার এসো।’ তার কণ্ঠস্বরে কেমন যেন মিনতি, যেন আমাকে দেখার, নাকি শেষ দেখার, আকাঙ্ক্ষা। ভীষণ ব্যস্ত ছিলাম কাজ নিয়ে। তারপরও ঠিক করলাম তাকে একবার দেখে আসবো। ফোনে যখন কথা হচ্ছিলো তখন তার কণ্ঠস্বরে মনে হয়নি ‘যমদূত’ তার দোরগোড়ায়। ভেবেছিলাম বয়সের কারণে শরীর খারাপ, কিংবা ছয় বছর আগে মরণব্যাধি ক্যান্সারের কারণে তার শারীরিক দশা খারাপের দিকে। জেনেভার হোটেল থেকে তার সাথে ফোনে কথা হচ্ছিল গেল সপ্তায়। এর মাস খানেক আগে জেনেভা আসতে হয়েছিল দিন দুয়েকের জন্যে। তখন তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম লাঞ্চ অথবা ডিনারের। জেনেভা গেলেই তার সাথে দেখা হয়, আলাপ হয়, আলোচনা হয় নানা বিষয় নিয়ে- বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, মানবাধিকার ইস্যু এবং যে বিষয়ে তার কাজ ‘ক্লাইমেট’ নিয়ে। সুইজারল্যান্ডের পরিবেশ-সম্পর্কিত প্রতিষ্ঠান, আর্থ ফোকাস ফাউন্ডেশনের তিনি ছিলেন সুইজ উন্নয়ন সংস্থা আর্থ ফোকাস ফাউন্ডেশনের এক্সিকিউটিভ ম্যানেজমেন্ট কমিটির ভাইস-প্রেসিডেন্ট ও মুখপাত্র তিনি ভাইস প্রেসিডেন্ট। সেই সূত্রে তার সাথে পরিচয় সাত-আট বছর আগে। পরিচয়ের সূত্র জেনেভায় বসবাসরত মানবাধিকার কর্মী অরুণ বড়ুয়া। বাংলাদেশ সম্পর্কে তার আগ্রহের শেষ নেই। তার স্বামী ছিলেন সুইস কূটনৈতিক, মারা গেছেন ইতিমধ্যে। যে সংগঠনের (ইউরোপীয়ান বাংলাদেশ ফোরাম) কাজে আমার সুইজারল্যান্ড যাওয়া, তার প্রতিটি অনুষ্ঠানে শক্ত-সবল কিন্তু অশীতিপর এই সুইস মহিলা উপস্থিত থাকতেন, কেবল শ্রোতা হিসাবে নয়, বক্তা হিসাবেও। অনুষ্ঠানের বিষয় মানবাধিকার থাকলেও তিনি এক পর্যায়ে চলে আসতেন পরিবেশে। জেনেভায় এমনি এক অনুষ্ঠানে তিনি মানবাধিকার সম্পর্কে বলতে গিয়ে কী বিপজ্জনক হারে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গারা কক্সবাজারে সমানে গাছ-পালা কেটে পরিবেশ নষ্ট করছে সে সম্পর্কে সাবধান করে দিয়েছিলেন। তার সেই সাবধানী-বাণী গতকাল দেখলাম প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও উচ্চারণ করলেন। শেখ হাসিনা বললেন, রোহিঙ্গারা অবাধে গাছপালা, বন জঙ্গল কেটে আমাদের পরিবেশ-ভারসাম্য এবং পাশাপাশি দেশের নিরাপত্তা নষ্ট করছে। যাই হোক, জেনেভায় সম্মেলন শেষে হল্যান্ড ফেরার দিন ঠিক করলাম নিকোলাকে একবার দেখে আসবো। ব্যস্ত, কোলাহল-মুখর জেনেভা শহর থেকে কিছুটা দূরে, বাস-ট্রামে ঘন্টা খানেক পথ পেরিয়ে আমরা, আমরা বলতে আমি, সুমনা, অরুণ বড়ুয়া ও সসীম গৌরীচরণ এবং তার বছর আড়াইয়ের মিষ্টি মেয়ে এলিনাসহ নিকোলার দেয়া হাসপাতালের ঠিকানা ধরে সেখানে নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত হই। উপস্থিত হয়ে টের পেলাম এই হাসপাতালে কেবল সেই সমস্ত রোগীকে আনা হয় যাদের আর ইহলোকের এই জীবনে ফেরার কোন সম্ভাবনা থাকে না। এখানেই তাদের অপেক্ষা করতে হয় ‘যমদূতের’ আগমনের অপেক্ষায়। ভাবতেই গা শিউরে উঠে। আমি জানি আমার আর বাঁচার কোন সম্ভাবনা নেই। আমি জানি যে কোন সময় আমার চোখ দুটি চিরতরের জন্যে বন্ধ হয়ে যাবে- কী ভয়াবহ। কোন রোগীর এমন শারীরিক দশায় একসাথে চারজনকে রোগীর সাথে দেখা করতে দেবে কিনা এ নিয়ে সংশয় ছিল। কিন্তু দেখলাম হাসপাতাল রিসেপশন কিছু বললো না, কেবল ‘করোনা’ পাশ আছে কিনা তা চেক করলো মোবাইলে। লিফটে উপরে উঠে তার কামরার দরোজায় মৃদু শব্দ করে ঢুকতেই দেখি একটি বেডে শুয়ে আছেন নিকোলা। তার পাশে গায়ে গা লাগিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে এক তরুণী তারই চাদরের ভেতর গা গলিয়ে শুয়ে আছে। আমাদের দেখে তরুণীটি চাদর থেকে নিজেকে বের করে বেড থেকে নেমে আমাদের পাশে দাঁড়ালো। পরিচয় দিয়ে জানালো সে নিকোলার মেয়ে, নাম লিসা। নিকোলার জন্যে নেয়া ‘অর্কিড’ ফুলের ছোট্ট টবটা লিসার হাতে দিতেই সে তার মাকে দেখিয়ে বলে, ‘মা দেখ তোমার জন্যে কী সুন্দর অর্কিড নিয়ে এসেছে।’ নিকোলা চোখ মেলে আমার দিকে তাকাতেই বলি, ‘নিকোলা, আমি বিকাশ’। তখন তার অক্সিজেন চলছে। সে অবস্থায় আমার দিকে তাকিয়ে ‘খুব খুশি হয়েছি’ বলে, পুনরায় বলেন, ‘আই এম সো সরি’। কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে বলি, ‘আপনার সরি বলার কোন কারণ নেই’। জানি, তিনিও জানেন, তারপরও তাকে বলি, ‘চিন্তা করবেন না, আপনি ভালো হয়ে উঠবেন’। লিসার সাথে কিছু কথা হলো। এই প্রথম তার সাথে সাক্ষাৎ এবং পরিচয়। তাকে বলি, এমন মায়ের জন্যে তোমার গর্ব হবার কথা। উত্তরে বলে, ঠিক তাই। বাংলাদেশের জন্যে, বিশ্ব পরিবেশের জন্যে নিকোলার ছিল অগাধ ভালোবাসা ও ভাবনা। দেখা হলেই বিশ্বব্যাপী জলবায়ু দূষণের কথা বলতেন, কী করে এর থেকে উত্তরণ সম্ভব তা নিয়ে চিন্তা ভাবনা করতেন। এই ব্যাপারে তিনি ছিলেন খুব সক্রিয়। বয়স তাকে থামিয়ে রাখতে পারেনি। অরুনকে লক্ষ্য করে লিসা বলে, ‘তুমি তো আমাদের বাসায় আগে এসেছিলে। মা তোমাকে ভালো করে চেনে। তুমি জেনেভায় থাকো, যখন ইচ্ছে করে তুমি চলে এসো, আগামীকালও আসতে পারো।’ লিসাকে সহানুভূতি ও ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নেই আমরা।
আমরা ফিরে চলি বাস স্টপেজের দিকে। আকাশ কিছুটা মেঘলা, যেন একটু পর বৃষ্টি নামবে। আমার ফেরার তাড়া, কেননা আজই ফিরে যাব হল্যান্ড। এসেছি ২৮ নভেম্বর। ৩০ তারিখ ছিল জেনেভা প্রেস ক্লাবে সম্মেলন ও জাতিসংঘ দফতরে যে ঐতিহাসিক ‘ব্রোকেন চেয়ার’ বা ‘ভাঙা চেয়ার’ তার সামনে প্রতিবাদ সমাবেশ। বিষয় একাত্তরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ও তার দেশি দোসরদের দ্বারা সংঘটিত ‘গণহত্যার’ আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দাবি। অনুষ্ঠানের আয়োজক ইউরোপীয়ান বাংলাদেশ ফোরাম ও সুইজারল্যান্ডের বাংলাদেশ হিউমান রাইটস কমিশন। জেনেভা রেল স্টেশনের কাছেই চমৎকার মাঝারি আকারের আটতলা হোটেল, হোটেল ক্রিস্টাল। এর আগেও এই হোটেলে আমার বার তিনেক থাকা হয়েছে। এবার একসাথে এই হোটেলে উঠেছেন ঢাকা থেকে আসা অন্যতম বক্তা, শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্য, আসিফ মুনীর। শহীদ বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিক অধ্যাপক মুনীর চৌধুরীর ছেলে, ডাচ পার্লামেন্টের প্রাক্তন সদস্য হেরি ফান বোমেল, আমস্টারডাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এন্থনি হোলস্ল্যাগ এবং লন্ডন থেকে আসা সমাজ সংগঠক ও ডেইলী ষ্টার পত্রিকার লন্ডন প্রতিনিধি আনসার আহমদ উল্লাহ। একই অনুষ্ঠানে এসেছেন হল্যান্ড থেকে ডাচ সাংবাদিক রব ফ্রেইকেন। তিনি হল্যান্ডের প্রথম সারির দৈনিক পত্রিকা, দ্য ফলঙক্রান্তের ইস্তানবুল প্রতিনিধি, সেখানেই তার অবস্থান। বাংলাদেশের গণহত্যা নিয়ে তার দীর্ঘ প্রতিবেদন দেখলাম মাস কয়েক আগে তার পত্রিকায়। বাংলাদেশের আর এক বুদ্ধিজীবী পরিবারের সদস্যা, ড. মেঘনা গুহ ঠাকুরতার সাক্ষাৎকার-ভিত্তিক ওই দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশিত হয় ওই পত্রিকায়। কেবল সে কারণে তিনি (রব ফ্রেইকেন) বাংলাদেশ সফর করেছিলেন। ডাচ ভাষায় তার দুটি বই- ‘বোম্বে হাইপারস্টাড’ এবং ‘বাস ইন এইখেন বুরকা’ বেশ পাঠক জনপ্রিয়তা পেয়েছে। প্রথম বইটি ইতিমধ্যে অন-লাইনে কেনা হলেও ব্যস্ততার কারণে শেষ করতে পারিনি। ভারতের মুম্বাই নগরীর কাহিনী উঠে এসেছে তার এই বইয়ে। কথা ছিল রব ফ্রেইকেনও উঠবে এই হোটেলে, কিন্তু তাকে অনুষ্ঠান শেষ করেই ফিরে যেতে হয়েছে হল্যান্ডে, সন্ধ্যায় জরুরি মিটিং ছিল বিধায়। জেনেভা প্রেস ক্লাবে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশের ১৯৭১ গণহত্যা’ শীর্ষক এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল ইউরোপীয় পার্লামেন্ট সদস্য ব্রান্ডো বেনিফি ও বৃটিশ পার্লামেন্ট সমস্যা, বাংলাদেশ বংশোদ্ভূত রুশনারা আলীর যথাক্রমে ভিডিও বার্তার মাধ্যমে ও ভার্চুয়ালি যোগ দেয়া। বক্তা হিসাবে এসেছিলেন জার্মান বেতার, ডয়েসী ভেলের প্রোগ্রামস ফর এশিয়ার পরিচালক দেবরতি গুহ। ভারতীয় বংশোদ্ভূত হলেও তার শেকড় বাংলাদেশে। সে কথা তিনি বলেন নানা প্রসঙ্গে। ডয়েচে ভেলেতে এই উচ্চ-পর্যায়ে তিনি যে কেবল প্রথম বাঙালি তা নন, তিনি প্রথম এশীয় যিনি এই উচ্চাসনে পৌঁছুতে সক্ষম হয়েছেন। বিষয়টি যে বাঙালি হিসাবে আমাদের সকলের গর্বের বিষয় তা বলা বাহুল্য। সহজেই সবাইকে আপন করে নিতে পারেন তিনি, বলতেও পারেন খুব ভালো।
নিকোলা আর নেই। এই পর্যায়ে এসে ভাবলাম একবার ফোন করে দেখি নিকোলা কেমন আছেন। ফোন করি তার মেয়ে লিসাকে। ফোন ধরলো না। মেসেজ পাঠালাম। সাথে সাথে এলো উত্তর।
লিসা লিখলো, ‘হ্যালো বিকাশ, মায়ের জন্যে মঙ্গল কামনা করে তোমার পাঠানো বার্তার জন্যে অনেক ধন্যবাদ। আমি অন্ত্যন্ত দুঃখের সাথে জানাচ্ছি যে, গতকাল আমাদের মা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। আমার ভাই সে সময় উপস্থিত ছিল। আমি ও আমার বোন হাসপাতালে আসার একটু আগেই তিনি মৃত্যুবরণ করেন’। একটু বাদেই আর একটি বার্তা পাঠিয়ে লিসা লিখলো, ‘তার ইচ্ছে অনুযায়ী তার স্মরণে আমরা একটি অনুষ্ঠান করবো এবং তোমায় জানাবো।’ মনটা খারাপ হয়ে এলো। ভাবি কত ঠুনকো আমাদের এই জীবন।
রবি ঠাকুরের গানের মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশকে ভালোবাসা এই সুইস নারীর আত্মার মঙ্গল কামনা করে ও শ্রদ্ধা জানিয়ে শেষ করছি আজকের এই লেখা। “তরঙ্গ মিলায়ে যায়, তরঙ্গ উঠে/ কুসুম ঝড়িয়া পড়ে, কুসুম ফোটে/ নাহি ক্ষয় নাহি শেষ/ নাহি নাহি দৈন্য লেষ/ সেই পূর্ণতার পায়ে মন-স্থান মাগে/ আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু, বিরহ দহন লাগে/তবুও শান্তি, তবু আনন্দ, তবু অনন্ত জাগে।”

লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্যোসাল মিডিয়ার যুগে ম্রিয়মাণ ডাক বিভাগ!
পরবর্তী নিবন্ধগণতান্ত্রিক মূল্যবোধের স্খলন