স্যোসাল মিডিয়ার যুগে ম্রিয়মাণ ডাক বিভাগ!

বিশ্ব ডাক দিবস

মোহাম্মদ আইয়ুব | শনিবার , ৯ অক্টোবর, ২০২১ at ৬:৩৭ পূর্বাহ্ণ

আজ ৯ অক্টোবর বিশ্ব ডাক দিবস। বিশ্বের অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশেও বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্যদিয়ে ডাক বিভাগ এ দিবসটি পালন করবে। ১৮৭৪ সালের এই দিনে সুইজারল্যন্ডের বার্ণে ২২টি দেশের প্রতিনিধিদের অংশ গ্রহণে গঠিত হয় ইউনিভার্সেল পোস্টাল ইউনিয়ন (ইউপিইউ)। ইউপিইউ গঠন করার মহেন্দ্রক্ষণটি স্মরণীয় রাখতে সংগঠনের পক্ষ থেকে ১৯৬৯ সালে জাপানের টোকিওতে অনুষ্ঠিত ইউনিভার্সেল ডাক ইউনিয়নের ১৬তম অধিবেশনে ভারতীয় প্রতিনিধিদলের সদস্য আনন্দ মোহন নারুলা ৯ অক্টোবরকে বিশ্ব ‘ডাক ইউনিয়ন দিবস’ হিসেবে পালনের ঘোষণা প্রস্তাবাকারে পেশ করেন। প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয় এবং প্রতি বছরের ৯ অক্টোবর বিশ্ব ডাক ইউনিয়ন দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত হয়।
পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে জার্মানির হামবুর্গে অনুষ্ঠিত ১৯তম অধিবেশনে নাম পরিবর্তন করে ‘বিশ্ব ডাক দিবস’ রাখা হয়। এর পর থেকে প্রতিবছর দিবসটি ‘বিশ্ব ডাক দিবস’ হিসেবে পালিত হয়ে আসছে।
আবহমান বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্য ও জীববৈচিত্র্যের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ডাকঘর বা ডাক ব্যবস্থা। ডাকপিয়ন বা রানার যে নামেই বলিনা কেন তাদের বর্তমান পরিস্থিতি কি অবস্থায় আছে তা দেখতে গিয়েছিলাম পোস্ট অফিসে। মনখুলে কথা হলো সেবাধর্মী রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানের পোস্ট মাস্টারের সাথে। জানতে চাইলাম হলুদ খামের দিনগুলোর অনুভূতি সম্পর্কে। দুই টাকার হলুদ খামের চিঠি তিন টাকা হতে বেড়ে এখন পাঁচ টাকায়, দামে বাড়লেও কদর বাড়েনি বিন্দুমাত্র। এখন আর কেউ হলুদ খামে চিঠি লিখে ডাক পোস্টে বাক্স বন্দি করে না। এখন আর ডাক পিয়নের হলুদ খামের চিঠি নিয়ে ব্যস্ততাও নেই। লাইন ধরে পোস্ট অফিসের সামনে এখন আর মানুষের ভিড়ও নেই। নেই সাধারণ মানুষের আনাগোনা। ঝিমিয়ে পড়েছে এক সময়ের কর্মব্যস্ত থাকা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান ডাক পোস্ট বা পোস্ট অফিস।
কথিত আছে, এক সময় এক রানার নগদ অর্থ ও চিঠি নিয়ে তার নিজ গৃহে আসলেন, স্ত্রী সন্তান নিয়ে খাওয়াদাওয়া শেষ করে ঝুলিতে রাখা টাকা ও চিঠি ঠিকঠাক করে সাজিয়ে কাঁধে ঝোলা ঝুলিয় বেরিয়ে পড়লেন চিঠিপত্র ও টাকাগুলো সঠিক সময়ে সঠিক ব্যক্তির কাছে পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে। রানারের হাতে ছিলো প্রতিদিনের সঙ্গী বল্লম আর হ্যাজেক বাতি। পথিমধ্যে ঘটলো এক মহা বিপদ! গভীর রাতে রানারের সন্তান অর্থের লোভে পড়ে পিতার ঝোলায় হামলা করে, কিন্তু ডাক পিয়ন রাষ্ট্রের সম্পদ রক্ষা করতে বিন্দুমাত্র পিছপা হননি, অন্ধকারে পিতা তার হাতে থাকা বল্লম দিয়ে পুত্রের দেহে আঘাত করে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা, আমানত অক্ষত ও অক্ষুণ্ন রেখেছিলেন।
এ ধরনের অসংখ্য ঘটনা কিংবা গৌরবময় ইতিহাসে সমৃদ্ধ হয়ে আছে রাষ্ট্রীয় এই প্রতিষ্ঠানটির পান্ডুলিপি। কথিত আছে কোন একসময় দুইপাশে জঙ্গলবেষ্টিত সরু রাস্তা ধরে ছুটে চলেছিলো রানার, হঠাৎ রানার দেখতে পেল রাস্তা পার হচ্ছিল একটি বাঘ। বাঘ ও রানার মুখোমুখি হওয়ায় সাহসী ডাক পিয়ন তার হাতে থাকা বল্লম দিয়ে বাঘকে আঘাত করে এবং নিজের জান ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ অক্ষুণ্ন রেখে কর্মস্থলে ফিরলেন। কর্মস্থলে ফিরে এসে ব্রিটিশ বসকে ঘটনার বর্ণনা করতে গিয়ে টাইগারপাস শব্দটা বারবার উচ্চারণ করে রানার। পরবর্তীতে ব্রিটিশ কর্মকর্তা বাঘ পারাপারের স্থান হিসেবে চিহ্নিত করে, সেই থেকে এই স্থানটির নামকরণ করেন ‘টাইগারপাস’।
এসব তথ্যের মধ্যে মজার ব্যাপার হচ্ছে, কিছুদিন আগে একজন সচেতন মা তার সন্তানকে পোস্ট অফিস দেখাতে নিয়ে এসেছেন। সন্তানকে শৈশবের ডাক পোস্টের গুরুত্ব ও জৌলুশের কথাও জানিয়েছেন মা। এখন আর সেই জৌলুশও নেই, গৌরবময় ঘটনাও নেই, অতীতের হারানো দিনের স্মৃতিচারণেই তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছেন পোস্টমাস্টার। পোস্ট মাস্টারের কথা প্রসঙ্গে আমার জাদুঘরের কথা মনে পড়লো কারণ ডাক পোস্টের এমন পরিণতি যে, প্রজন্মকে এনে দেখাতে হচ্ছে এটা আমাদের হারানো ডাকঘর, যেভাবে আমরা জাদুঘরে হারানো বিষয়ের উপর জ্ঞান অর্জন করি।
এখন স্যোসাল মিডিয়ার যুগ। ফেইসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টুইটারের সাথে পাল্লা দিয়ে চলছে নতুন এপস। এ-যুগে হলুদ খামের কথা বলা মানে আলাদীনের জ্বিনের গল্প বলার মতো। রাষ্ট্রীয় ডাক পোস্টের টেকসই ব্যবস্থাপনা, সর্বোচ্চ ব্যবহার উপযোগিতা ও সেবার পরিসর বাড়াতে একটি নতুন উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। বাংলাদেশের আনাচেকানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ডাকঘরের সাথে যদি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান টেলিটকের কাস্টমারকেয়ার কিংবা সার্ভিস পয়েন্ট যুক্ত করা যেতো তবে একই সাথে দুটি প্রতিষ্ঠান লাভবান হতে পারতো। এতে সাধারণ মানুষের আনাগোনাও বাড়তো। সাথে সাথে লোকসানে থাকা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান টেলিটক কিছুটা স্বস্তি পেতো। এতে কলা বেচা আর রথযাত্রা একসাথে উপভোগ করা যেতো। দুঃসময়েও আশার কথা হচ্ছে সদিচ্ছা থাকলে ঐতিহ্যবাহী এই প্রতিষ্ঠানকে দু’একটি সিদ্ধান্তের মধ্যদিয়ে আমূল পরিবর্তন আনা সম্ভব। সর্বপ্রথম সরকার যদি একটি প্রজ্ঞাপন জারি করত; সরকারি, আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানের সকল ডকুমেন্ট ডাক পোস্টের মাধ্যমে আদান-প্রদান করার নীতিমালা গ্রহণ করেন, রাতারাতি ঘুরে দাঁড়াবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে থাকা এই ডাক বিভাগ। নতুনভাবে প্রাণ ফিরে পাওয়ার সাথে সাথে আরও দ্বিগুণের অধিক প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি হবে নিঃসন্দেহে।

লেখক : সমাজসেবী ও সংস্কৃতিকর্মী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ২০২১ সালে শিক্ষকদের সরকারি প্রণোদনার টাকা গেলো কোথায়?
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে