মোহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার, দৈনিক আজাদী এবং গণতন্ত্র

এস. এম. জামাল উদ্দিন | শুক্রবার , ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৬:২০ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রামের সংবাদপত্র শিল্প, মুদ্রণ ও প্রকাশনা জগতে মোহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের অবদান ঐতিহাসিক। তিনি আজ আমাদের গৌরবময় ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছেন। বাংলাদেশ অঞ্চলের সেই প্রতিকূল আর্থ-সামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থায় শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং এ পাশ। এই তীক্ষ্ণ, দূরদর্শী ও মেধাবী ব্যক্তিত্ব আপন আরাম-আয়েশ-বিলাস বৈভবের প্রতি বিন্দুমাত্র আকর্ষণবোধ না করে সুদূরপ্রসারী অথচ ঝুঁকিপূর্ণ লক্ষ্য নিয়ে প্রকাশনা জগতের প্রতিকূলতাসংকুল পথে যাত্রা শুরু করেন। প্রথমে সাপ্তাহিক ও পরে দৈনিক পত্রিকা প্রকাশের মাধ্যমে সংবাদপত্র জগতে দিকপালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। তিনি নিজেও সাহিত্যসেবা করেছেন এবং বহু শিক্ষণীয় গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। আমাদের বাংলা ভাষার আন্দোলনের দিনগুলোতে প্রতিরোধের একেবারে প্রথম প্রহরে ১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী সর্বপ্রথম প্রতিবাদী কবিতা মুদ্রণ ও প্রকাশনার অবিসংবাদিত গৌরব ও মর্যাদার অধিকারী তাঁরই প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত কোহিনূর ইলেকট্রিক প্রেস। এই মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান আজ আমাদের বাংলাভাষার সংগ্রামের নজিরবিহীন ইতিহাস ও ঐতিহ্যের উজ্জ্বল অংশ। ১৯৬০ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তাঁরই সম্পাদনায় প্রকাশিত দৈনিক আজাদী ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর হানাদার ও ঔপনিবেশিক দখলকারী মুক্ত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের উজ্জ্বল সূর্যালোকের স্পর্শধন্য মাটিতে প্রথম প্রকাশিত দৈনিক হিসেবে আবির্ভাবের গৌরবের অধিকারী। একদিকে বাংলা ভাষা আন্দোলনের কালে প্রথম সফল প্রতিরোধ রচনা এবং অন্যদিকে এ ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে সূচিত মুক্তি স্বাধীনতা সংগ্রামের সফলতা প্রথম মুহূর্তে রক্তাক্ষরিক সুসংবাদ বহন করে, জনগণের কাছে পৌঁছে দেবার অভিন্ন গৌরবের অধিকারী যে অভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সে প্রতিষ্ঠানের স্থপতি হিসেবে মোহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার আমাদের জাতীয় ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক ভাস্বর মিনার। ব্যক্তি জীবনে অত্যন্ত সৎ ও ধর্মপ্রাণ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারকে কোন প্রকার সংকীর্ণতা ও একদেশদর্শিতা কোনদিন স্পর্শ করতে পারেনি। ধর্মপ্রাণ মানুষদেরকে একটু অবজ্ঞার চোখে দেখে পশ্চাদপদ ভাববার বাতিকগ্রস্ত ও বিভ্রান্ত শ্রেণীর মেকি প্রগতিবাদীরা মোহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের জীবন, রীতি, আচরণ, বিশ্বাস ও আদর্শ নিবিড়ভাবে পর্যালোচনা করলে নিজেদের ভ্রান্তি বিচার বুদ্ধির অসম্পূর্ণতা ও অপরিণত মানসিক স্বাস্থ্য বুদ্ধিভিত্তিক চিকিৎসার অবকাশ পাবেন। আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের মধ্যে ধর্ম ও প্রগতির সুষম সমন্বয় তাঁকে এক অনবদ্য আধুনিকতার প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। যে পূর্ণাঙ্গ জীবনবোধ ও মানবতাবোধে উজ্জীবিত হয়ে তিনি বাংলাদেশ অঞ্চলের সকল প্রগতিশীল, রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংষকৃতিক ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রথম কাতারের সহযোগী ও যোগানদারের সফল ভূমিকা পালন করতে পেরেছিলেন, সেই পূর্ণাঙ্গ জীবনবোধ ও মানবতাবোধ আমাদের প্রজন্মতরে সঞ্চারিত হোক এটাই আজকের দিনে আমাদের একান্ত কামনা। ঢাকার বৃহৎ পত্র-পত্রিকার সাংবাদিকরা যেমন মুক্তিযুদ্ধে গৌরবময় অবদান রেখেছে, তেমনি ঢাকার বাইরের সাংবাদিকরাও সর্বশক্তি নিয়ে এগিয়ে এসেছিলেন মুক্তিযুদ্ধকে বিস্তৃত ও সংহত করার কাজে। হানাদার বাহিনী যেহেতু একেবারে সব জেলায় আক্রমণ করতে পারেনি, তাই ঢাকার বাইরের অনেকগুলো জেলা একাত্তরে মার্চের পরও কয়েকমাস মুক্ত ছিল। এসব মুক্ত জেলা এবং মুজিবনগর থেকে সে সময় প্রচুর পত্র-পত্রিকা বেরিয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি, দেশের ভেতরে ও বাইরে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সবচেয়ে বেশি সহায়তা করেছে যে দুটি মাধ্যম তার মধ্যে একটি এসব পত্র-পত্রিকা, অন্যটি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। ব্যক্তিগত, গোষ্ঠীগত বা দলগত উদ্যোগে প্রকাশিত এসব পত্র-পত্রিকা সংখ্যায় বিপুল, আদর্শে একক এবং প্রকাশ ভঙ্গিতে বিচিত্র। নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের পর স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাংলা সংবাদপত্র হচ্ছে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত মরহুম মোহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার প্রতিষ্ঠিত গণ-মানুষের পত্রিকা দৈনিক আজাদী। সংবাদপত্র জগতে দৈনিক আজাদী ক্ষুরধার লেখনীর মাধ্যমে বৃহত্তর চট্টগ্রামের আপামর জনসাধারণের প্রাণের দাবী স্বাধীন মতামত সত্যিকার অর্থেই তুলে ধরেছে।
সাধারণ পাঠকের নিরপেক্ষ সংবাদপত্র চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী মানুষের মনে চির জাগ্রত থাকবে। মোহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের মৃত্যুর পর দৈনিক আজাদী সম্পাদনা করেছিলেন প্রবীণ সাংবাদিক সাবেক গণপরিষদ সদস্য অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ। এবং তাঁর মৃত্যুর পর থেকে দৈনিক আজাদী সম্পাদনা করছেন জনাব এম.এ. মালেক। এর আগে দীর্ঘদিন পরিচালনা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন তিনি। বর্তমানে পরিচালনা সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন জনাব ওয়াহিদ মালেক।
দেশে সংসদীয় গণতন্ত্র চালু হয়েছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে জনগণ ও রাজনৈতিক দলের পাশাপাশি সংবাদপত্রগুলো সূদুরপ্রসারী ভূমিকা পালন করেছে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিকাশ সাধনেও সংবাদপত্র তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। আমরা স্বাধীন সংবাদপত্রে বিশ্বাসী। দায়িত্বশীলতা সবরকমের স্বাধীনতারই পূর্বশর্ত। যারা সংবাদপত্র বের করছেন এবং যিনি সাংবাদিক তাকে অবশ্যই দায়িত্বশীল হতেই হবে। দেশে এখন সংবাদপত্র প্রকাশনার ভরা জোয়ার। নবলব্দ গণতান্ত্রিক অধিকার মুদ্রিত মাধ্যমের জগতে এক নয়া বিপ্লবের সূচনা ঘটিয়েছে। দৈনিক, সাপ্তাহিক, অর্ধসাপ্তাহিক, পাক্ষিক, মাসিক, বিশেষ এবং সাধারণ রাজনৈতিক, রঙিন ও বর্ণহীন বিচিত্র নাম চেহারা বক্তব্য নিয়ে প্রায় প্রতিনিয়ত ঢাকা থেকে কিংবা ঢাকার বাইরে থেকে পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। পাঠকদের পক্ষে সব পত্রিকা কেনা কিংবা পড়া দূরে থাক, নিত্যনতুন কাগজের হিসেব রাখাও মুশকিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংবাদপত্র প্রকাশে এই সুযোগ এবং সকল মত প্রকাশের এই স্বাধীনতা আমাদের সমাজে এক অভূতপূর্ব পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে। এর আগে আর কখনো সংবাদিকতার ক্ষেত্রে এমন করে শতফুল প্রস্ফুটিত হয়নি। মানুষের রুদ্ধ আবেগ এখন খুঁজে পেয়েছে প্রকাশের পথ। সুতরাং সংবাদপত্রগুলো রীতিমত স্বাধীনভাবে যেমন প্রকাশিত হচ্ছে – ঠিক তেমনি রুচিশীল এবং দায়িত্বশীল সাংবাদিকতার মাধ্যমে পাঠক সৃষ্টির প্রয়াস চালাবেন বলে আমার বিশ্বাস। সংবাদপত্র ঠিকিয়ে রাখে পাঠক সমাজ। পাঠক না থাকলে স্বাধীন সংবাদপত্র টিকবে কি করে? উল্লেখ্য যে, মরহুম মোহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, সাহিত্যিক মাহবুব উল আলম, কবি আবদুস সালাম, হাবিবুর রহমান খান, এম.এ.কুদ্দুস, শরীফ রাজা, কবি ওহীদুল আলম, আবদুল্লাহ আল ছগীর, অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, সায়ফুল আলম, বি.এ.আজাদ ইসলামাবাদী, সাধন ধর, নুর সাঈদ চৌধুরী, নজির আহমদ, বিমলেন্দু বড়ুয়া, সৈয়দ মোস্তফা জামাল, মোহাম্মদ ইউসুফ চৌধুরী, এস.এম.আফজল মতিন সিদ্দিকী, ওসমানুল হক, মঈনুল আহসান সিদ্দিকী, ইমামুল ইসলাম লতিফী, এম. ওবায়দুল হক, মোহাম্মদ মোসলেম খান, মঈনুল আলম, আ.জ.ম.ওমর, শিব্বির আহমদ সিদ্দিকী প্রমুখের মত সাংবাদিকরাই চট্টগ্রামের সাংবাদিকতার ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করেছেন। তাই তাদেরকে আমরা গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি। মোহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার প্রতিষ্ঠিত দৈনিক আজাদী রীতিমত অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। মহান রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু থেকে ’৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধ, সর্বোপরি ’৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে দৈনিক আজাদী প্রশংসনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছিল – যা অবশ্যই স্মরণযোগ্য। গণতন্ত্রের পথকে সুগম করতে স্বাধীনভাবে লেখনী চালিয়েছে দৈনিক আজাদী। স্বাধীন সংবাদপত্রের অস্তিত্বে বিশ্বাসী জনগণ দৈনিক আজাদীর ধারাবাহিক প্রকাশনাকে আন্তরিকভাবে স্বাগত জানাই। মরহুম মোহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার প্রতিষ্ঠিত দৈনিক আজাদী বহুল প্রচারিত এবং জনগণ কর্তৃক স্বীকৃত স্বাধীন গণতান্ত্রিক চেতনার এক অনন্য ইনস্টিটিউশন। স্বৈরাচারী শাসনের কবল থেকে জাতিকে রক্ষা করে গণতন্ত্রকে সুদৃঢ় মজবুত ভিত্তির উপর দাঁড় করাতে চট্টগ্রামের দৈনিক আজাদী পত্রিকার ভূমিকা ও গুরুত্ব অপরিসীম। দেশে আজ গণতান্ত্রিক শাসন বিদ্যমান। পরমতসহিষ্ণুতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা গণতন্ত্রের পূর্বশর্ত। আশা করি অতীতের মত দৈনিক আজাদী ভবিষ্যতেও স্বাধীন সংবাদপত্র বের করে গণতন্ত্র হত্যাকারী এবং অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে সোচ্চার থাকবে। সংবাদপত্র জনগণের মুখপত্র, সাংবাদিকরা জাতির জাগ্রত বিবেক এবং পাঠকরাই সংবাদপত্রের প্রাণশক্তি। ১৯৬২ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের কৃতীপুরুষ মোহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার আন্দরকিল্লা জেনারেল হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। ৫৯তম মৃত্যুবার্ষিকী পালনের এ দিনে মহান আল্লাহর নিকট মোনাজাত করছি। মহান আল্লাহ যেন মোহাম্মদ আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার সাহেবকে জান্নাতুল ফেরদাউস বেহেস্ত নসীব করুন-আমিন।
লেখক: স্বাধীন সংবাদপত্র পাঠক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি, সাংবাদিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধশহীদ বীরকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার
পরবর্তী নিবন্ধজুম’আর খুতবা