বুলবুলের গল্প

বিপুল বড়ুয়া | বুধবার , ২৮ অক্টোবর, ২০২০ at ১০:৩২ পূর্বাহ্ণ

দুপুরের রোদ বেশ তেতে উঠেছে। সূর্যের তাপ গলে গলে পড়ছে. যেনো চোখ খোলা দায়।
গুটি গুটি পায়ে একে একে এসে পড়েছে রবীন, মেহেদি, বাবলু, অনিল। আড্ডা-খেলাপাঠ জমে ওঠলো বলে।
কিন্তু সব্বাই কেমন যেনো উসখুস করছে।
ব্যাপারটা কি? সবার দৃষ্টি চা দোকানের গলির দিকে। এই ভরদুপুরে আমানিয়া স্টিলের লোহার পাতবাহী ট্রাক কি গলিতে ঢুকছে? না ট্রাকের কোনো সাড়াশব্দ নেই।
লিপু সবাইকে দেখছে আড়চোখে। অনিল পকেট হতে এক মুঠো লাল-নীল মার্বেল বের করল। বেশ নেড়ে চেড়ে দেখাচ্ছে সবাইকে। মেহেদি ব্যস্ত পেট মোটা লাটিমের পেরেক ধার করা নিয়ে। ঘষছে আর ঘষছে পাকা চাতালে। বাবলু এরি মধ্যে ক’বার ঘুরে এসেছে পিছনের ভাঙাচোরা বারান্দার পাশের বরইতলায় ঝরে পড়া কটা বরই পায় কিনা।
কি ব্যাপার সব্বাই ভারি চুপচাপ আজ। কি হবে না মার্বেল খেলা লাটিম ঘোরা। কারো নড়াচড়া নেই যে।
সবার ঝিম মারা অবস্থা। কারো খেলাপাতিতে মন নেই।
মেহেদি এক সময় কথা বলে ওঠে-‘লিপু, বুলবুল তো এখনো আসেনি। কী করছে ব্যাটা এতক্ষণ বাসায়?
হ্যাঁ তাই তো। সাঁ করে মাথা ঝরঝরে হয়ে যায় লিপুর। ঠিক তো বুলবুলকে তো দেখছি না। সে জন্যে তো সবাই চুপ মেরে আছে। বুলবুল না হলে কি খেলা জমে-আড্ডা জমে। নূতন নূতন দুষ্টুমি বুদ্ধি সব তো তার মাথায় জমা।
লিপুরও মনে পড়ে বুলবুলকে। সেই আমাদের বুলবুল। ছিপছিপে শুকনো-পাতলা, বাদামি হাফপ্যান্ট গায় শাদা ধবধবে সেন্ডো গেঞ্জি। অনেকটা লালচে বুলবুলের দুটি চোখ। বুদ্ধিবিদ্যায় বুলবুলের জুড়ি নেই। বুলবুল নেই তো খেলা নেই ছোটা নেই, কারো যেনো কিছু করার নেই।
বুলবুল আসেনি। আসবে। কখন আসবে এতো সব ভাবনা লিপুও তার বন্ধুদের খুব করে পেয়ে বসেছে। লিপুও ভাবছে-হৈ চৈ আড্ডা-লাটিম ঘোরা-টক্কর দেওয়া, লাল-নীল মার্বেলের টোকাটুকিতে বুলবুল থাকছে না-মানাই যায় না।
জমেই উঠে না। গপ্পের আসর। ফজু সওদাগরের স’মিলের ঘোর আবছা দঙ্গল-জঙ্গলে ভয়তরাসে ঢু মারা, নাক চেপে সেই চামড়ার গন্ধ বাঁচিয়ে লুকিয়ে চুকিয়ে ছররাগুলিতে ঝাঁঝরা চিতার শুকনো চামড়া উঁকিঝুঁকি মেরে দেখা চামড়ার আড়তে, হোসেনদের বাড়ির পাশে শৈর্যাখালার বেড়া ঘেরা কাগজি লেবু গাছ হতে লেবু ছেঁড়ার জন্য হাঁসফাঁস করা কিংবা টুনিপুকুরের পাড়ের মধুফুল গাছ হতে ঝরে পড়া মধুফুল হতে মধু চুষে খাওয়া-এতসব সব কাজে বুলবুলের মুনশিয়ানার ধারে কাছে আমরা কেউ নেই। এতসবে বুলবুল একাই একশো। তাই বুলবুল নেই তো কিছু নেই। সব পানসে…।
সেই বুলবুল এখনো এসে পৌঁছেনি চামড়া গুদাম-লবণ আড়তের এক চিলতে মাঠে। কোথায় গেলো বুলবুল। লিপু নিশ্চিত বুলবুল এই ভরদুপুরে ঘরে নেই। লিপু ঠিক জানে সে চুপচাপ ঘরে বসে থাকার ছেলে নয়, কোথায় কোথায় বুলবুল?
এই মুহূর্তেই হঠাৎ মেহেদির কথায় কেমন যেনো খটকা লেগে যায় লিপুর। এই আজ সকালের দিকে তাকে দেখেছে সুড়সুড় করে ওই স’মিলের ঝোপঝাপড়ার দিকে চুপচাপ ছুটে যেতে। অনেকটা নিঃশব্দে। কাউকেও খোঁজেনি সঙ্গে যেতে। সেই সকাল হতে এই দুপুর-কি হল? বুলবুল লাপাত্তা। কোথায় খেলা, কোথায় দুষ্টুমি।
রবীন, বাবলু, অনিল, মেহেদির ম্যালা গবেষণা-বুলবুল এখনো এলো না। কোথায় কী কাজে আটকেছে যে মাঠ ছাড়া। ভেবে কূল পায় না লিপু। ডানে-বাঁয়ে উঁকিঝুঁকি দেয় অনিল-বাবলুরা।
মাথায় কতো ঝামেলা ঘুরপাক খাচ্ছে লিপুর আজ সোমবার। কাল বাদে পরশু পাথরঘাটার মডার্ন ক্লাবের সঙ্গে ফুটবল ম্যাচ নিয়ে বসে আছে। আনোয়ার হাত মচকে বসে আছে। তার তো গোলে খেলা হবে না। নিমাই হঠাৎ বোনের বাড়ি বেড়াতে গেছে। যত্তো সব। সেভেন স্টার ক্লাবের একটা মানসম্মান আছে না। বাইর থেকে এক দু’জন খেলোয়াড় ‘হায়ার’ করতে হবে না। মডার্ন ক্লাবের সাথে হারা মানে তো লজ্জায় মরে যাওয়া।
বুলবুলকে কালই বললাম-দুপুরে একটু আসিস। ম্যাচ নিয়ে কথা বলবো। খেলোয়াড়দের লেবু-চুয়িংগামের জন্য কিছু পয়সাপাতি জোগাড় করতে হবে। পুরনো ফুটবলটায় একটু সেলাই-টেলাই দিতে হবে-পাড়ার সবাইকে একটু বলতে হবে-আরো কতো কাজ। এসব চটজলদি কাজ বুলবুলকে ছাড়া হয়? অথচ বুলবুলের টিকিটিরও দেখা নেই। গায় যেনো জ্বর কাঁপুনি এসে যায় লিপুর।
লিপুর ম্যালা ভাবনা। বুলবুলতো কাউকে ঝামেলায় ফেলার ছেলে নয়। ক্লাবের ফুটবল ম্যাচ হলে তো তার নাওয়া-খাওয়া সারা। তার ওপর মডার্ন ক্লাবের ম্যাচ। গির্জার মাঠে। হেরে গেলে যে আশরাফ আলী রোড-মনোহর পাড়া-ব্রিকফিল্ড রোড দিয়ে স্কুলে আসা-যাওয়া যাবে না-যা খেপাবে হরিপদ-বাতেন-আকমলরা। অথচ ম্যাচের যা কিছু সামাল দিতো বুলবুল-তার দেখাই নেই।
নির্ঘাত কোনো ঝামেলায় পড়েছে বুলবুল। না হলে এমনটি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু কী হলো বুলবুলের? ভেবে ভেবে কোনো কূলকিনারা পায় না লিপু মেহেদিরা। ব্যাপারটা বেশ গোলমেলে ঠেকে সবার।
এতসব ভাবতে ভাবতে সবাই যখন অস্থির-বুলবুলের দেখা নেই-ঠিক তখনই ঘটে গেলো ব্যাপারটা। সবাইকে হঠাৎ চমকে নিয়ে ভোজবাজির মতো দেখা গেলো-স’মিলের ওদিক হতো কেমন যেনো ম্রিয়মান হয়ে হেঁটে আসছে বুলবুল, অনেকটা স্তব্ধ চুপচাপ।
কাছাকাছি হতেই সবাই ঘিরে ধরে বুলবুলকে। বুলবুল এতক্ষণে আসছে। তাও বাসার দিক হতে নয়-স’মিলের ঝোপঝাড়ের দিক হতে। যে বুলবুল মাঠে আসতেই হৈ চৈ ফেলে দিতো-একে ডাকতো-ওকে খুঁজতো। সেই বুলবুল কিনা নীরবে নিঃশব্দে অনেকটা মন খারাপ করা নিয়ে এসে পড়েছে। সবাই কেমন যেনো ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়। এ কেমন চুপচাপের বুলবুল। তাকে তো চেনাই যায় না। হতবাক হয়ে যায় লিপু-মেহেদি-অনিল-বাবলু-রবীন।
রোদ কিছুটা কমেছে। বেশ সুনসান হয়ে এসেছে মস্তিয়া টি স্টলের পিছনের চামড়া-লবণ আড়তের পিছনের মাঠ। মনে মনে বেশ ফুঁসেছিলো বুলবুলের ওপর লিপুরা।
লিপু আড়চোখে বুলবুলকে দেখে। কিছুটা পরখও করে। বুলবুলও কেমন যেনো ইতিউতি করছে খানিকটা। কী হচ্ছে বা বুলবুল কী ভাবছে লিপুও ঠিক বুঝে ওঠতে পারে না।
ঠিক সে সময় অবাক হয়ে দেখে লিপুরা বুলবুলের কাণ্ড। বুলবুল নূতন তিনটি কড়কড়ে বিশ টাকার নোট লিপুর হাতে দিয়ে বলে-‘মডার্ন ক্লাবের সঙ্গে পরশুর ম্যাচের কথা আমার ঠিক মনে আছে। এই টাকাটা পাড়ার বাদশা ভাই থেকে এনেছি ম্যাচের দিন চুয়িংগাম-লেবুর জন্য। চাক্তাই-ফিশারিপাড়া-কলাবাগিচা থেকে কয়েকজনকে ‘হায়ারের’ কথা পাকা করেছি। খেলার আগেই মাঠে এসে যাবে। টি স্টলের মস্তি মামা খেলার শেষে আমাদের কেক-বরফি খাওয়াবে তার টি স্টলে। আমরা ঠিকই ম্যাচ জিতবো দেখিস-লিপু-মেহেদি…।’
কারো মুখে কোনো কথা নেই। ‘লিপু জানিস আজ সারাদিন আমি ওই স’মিলের পিছনের এঁদো জঙ্গলে ছিলাম। ঘুরতে ঘুরতে দেখি-কী একটা পাখি বেশ কটা ডিম পেড়ে কোথায় উড়ে গেছে বাসা ফেলে। আর কটা দুষ্টু কাক ঠোকরে ডিমগুলো খেয়ে ফেলতে চাইছে। তাই গাছের ডাল ভেঙে কড়া পাহারা দিলাম। কাক তো আমাকে এই ঠোকরায় ওই ঠোকরায় অবস্থা। আমার খুব মায়া লেগেছে মেহেদি ডিমের ভেতরের বাচ্চাগুলোর জন্য।’ একনাগাড়ে অনেক কথা বলে যায় বুলবুল। অবাক লিপু-মেহেদিরা।
‘আমি না থাকলে ডিমগুলো ঠিক ঠোকরে-বাচ্চাগুলো খেয়ে ফেলতো কাকগুলো। তাই এদিকে না এসে দেখে রাখলাম ডিমগুলো-কাকগুলো তাড়িয়ে। মা পাখিটা এই এসে যখন বাসায় ডিমগুলোর ওপর বসলো তখনই নিশ্চিন্ত হয়ে তোদের এদিকে আসলাম…।’
ম্যাচের সব খরচাপাতি জোগাড় করেছে, পাখির ডিমগুলো বাঁচিয়ে বাচ্চাদের রক্ষা করেছে আমাদের বুলবুল। এতসব শুনে থ্‌ হয়ে যায় লিপু-মেহেদিরা। সত্যি বুলবুল কতো বড়ো কাজ করেছে। আমাদের রাগ যেনো জল হয়ে গেলো। বুলবুল কী শেখালো আমাদের?
বুলবুল আর কথা বাড়ায় না। লিপুর হাতে হাত রেখে আমি ‘একটু আসি’ বলে পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় স’মিলের ঝোপজঙ্গলের পাখির বাসাটার দিকে। বুলবুলের চোখে যেনো ভাসছে নীলচে কটা ডিম-ঝরঝরে বাসা এবং মা-পাখির সুখী সুখী চোখ মুখ। লিপু মেহেদিরা দেখে বুলবুল ততক্ষণে ঢুকে পড়েছে স’মিলের ঝাড়-জঙ্গলে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রবাহ
পরবর্তী নিবন্ধচারদিকে কাশফুল