দূরের টানে বাহির পানে

হাসান আকবর | বুধবার , ১৬ নভেম্বর, ২০২২ at ৭:৪৮ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

ঘুরছিলাম আমরা। কখনো আইফেল টাওয়ারের সামনে তো কখনো তাজমহলের পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম। বাস্তবতায় একটির থেকে অন্যটির দূরুত্ব কয়েক হাজার কিলোমিটার হলেও এখানে যেন প্রতিবেশী। কী অবলিলায় মিলে মিশে রয়েছে পৃথিবীর বিখ্যাত সব স্থাপনাগুলো! আমাজনের জঙ্গল কিংবা আফ্রিকার গ্রাম থেকে উকি দিয়ে দেখা যাচ্ছিল থাই রাজার প্রাসাদ! নায়াগ্রার জলপ্রভাতের ছন্দের সাথে জুরাসিক পার্কের ভয়ার্ত মানুষের আত্মচিৎকার মিলেমিশে একাকার হয়ে উঠছিল। সবই দেখা যাচ্ছিল পা বাড়ালেই। কয়েকশ’ একর জায়গার উপর গড়ে তোলা ‘উইন্ডো অব দ্য ওয়ার্ল্ডে’র পরতে পরতে সৌন্দর্য ছিটিয়ে ছড়িয়ে রয়েছে। ঘুরতে ঘুরতে পায়ে ব্যাথা করলেও অপার ওই সৌন্দর্যই কেবলই সামনে টানছিল।
চীনের শেনজেন শহরের উইন্ডো অব দ্য ওয়ার্ল্ডের পুরোটা ঘুরে দেখতে কমপক্ষে ছয় ঘন্টা সময় লাগে। এত সময় আমাদের হাতে ছিল না। এতক্ষণ ঘোরার শক্তিও নেই আমাদের শরীরে। তাই মোটামুটি যতটুকু না দেখলে মন ভরবে না ঠিক ততটুকু দেখেই সামনে এগুচ্ছিলাম। আলোর বন্যার মাঝ দিয়ে চমৎকার পিচ ঢালা রাস্তা ধরে হাঁটতে হাঁটতে আয়েশীভাব নিয়ে ঘুরছিলাম আমরা। শত শত নারী পুরুষ ঘুরছে, ঘুরছে অসংখ্য শিশু কিশোরও। মানুষের উপস্থিতিই প্রমান করছিল যে উইন্ডো অব দ্য ওয়ার্ল্ড অনেক জনপ্রিয় একটি ট্যুরিস্ট স্পর্ট।
আমরা মোটামুটি বেরিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। কায়সার ভাই বললেন, চলেন বাইরে গিয়ে কিছু একটা খেয়ে নিই। তারপর বাড়ির পথ ধরবো। বাসায় গিয়ে ডিনার করবো। আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। কিন্তু গেটের কাছে পৌঁছেই আমাদের পা থমকে গেল। আলোর ঝলকানি বেশ চোখে লাগছিল। বিশাল একটি মঞ্চ। বিশাল মানে আসলেই বিশাল। চীনের মতো বিশাল। মঞ্চটিকে নানাভাবে সজ্জিত করা হয়েছে। আলোর কারুকাজ মঞ্চজুড়ে। ক্ষণে ক্ষণে পাল্টে যাচ্ছিল আলোর রঙ। একই সাথে যেনো পাল্টে যাচ্ছিল মঞ্চের আদল। কিছু একটা মঞ্চস্থ হচ্ছিল, নাটকের মতো। ভাষার কিছু না বুঝলেও এটুকু বুঝা গেল যে, নাটকটিতে চীনা জাতিস্বত্ত্বার বিকাশ এবং উত্থানসহ বিভিন্ন বিষয় উপস্থাপিত হয়েছে। জাতিস্বত্ত্বার বিকাশের সাথে সাথে মঞ্চে আলো আঁধারির এমন এক মায়াবী খেলা চলছিল যে তার সাথে ওই সময়কার সমাজব্যবস্থাটা যেনো ফুটে উঠছিল। ভাষার কিছু বুঝতে পারছিলাম না, তবে আবহ দেখে সুখ দুঃখ হাসি কান্না যুদ্ধ বিগ্রহ বুঝতে পারছিলাম। অনেকক্ষণ ধরে আমরা নাটক দেখলাম। ফেরার তাড়া ভুলে ঘোরলাগা চোখে মঞ্চ দাবড়ে বেড়ানো শিল্পীদের অভিনয় দেখছিলাম। প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে সাম্প্রতিককাল পর্যন্ত চীনের উত্থান এবং বিভিন্ন সময়কার নানা আলোচিত ঘটনাপ্রবাহ অসাধারণ দক্ষতায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ‘অসাধারণ!’ নিজের অজান্তেই কথাটি মুখ থেকে বেরিয়ে এলো। কায়সার ভাইও একইভাবে সায় দিলেন। বললেন, মন ভালো করে দেয়ার মতো একটি পরিবেশনা দেখলাম। একেবারে জীবন্ত অভিনয়!
আমরা উইন্ডো অব দ্য ওয়ার্ল্ডের নানা স্থাপনা দেখে ফিরে যাচ্ছিলাম, সেখানে এমন চমৎকার একটি নাটক সত্যিই বাড়তি পাওয়া। পর্দা পড়ার পর ইংরেজীতে নাটকটির গল্পও বলে দেয়া হলো। একই সাথে বলা হলো যে, নাটকটিতে অংশগ্রহণকারী শিল্পী রয়েছেন শতাধিক। এতে কেবল দেশীই নয়, বহু বিদেশী শিল্পীও রয়েছেন। তাদের সবাইকে একই সাথে মঞ্চে আহ্বান জানানো হলো। অভিনয়ের সাজে অভিনয়হীন ভাবে তারা একইসাথে মঞ্চে এসে দাঁড়ালেন। শতাধিক শিল্পী একই সাথে মঞ্চে! মঞ্চের আকার কি কিছুটা বোঝা গেল! তারা সবাই হাত নেড়ে দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকশ’ দর্শককে ধন্যবাদ জানালেন। বিদেশী শিল্পীরাও দেখলাম চীনা রীতি বেশ রপ্ত করেছেন। তারা চীনা স্টাইলে দর্শকদের হাততালীর জবাব দিলেন। বিদায় বেলায় এমন চমৎকার একটি শো’ দেখে মনটি ভরে গেল।
গেটের বাইরে খাওয়া দাওয়ার বেজায় আয়োজন। ফুডকোট টাইপের ব্যাপার স্যাপার। ছোট ছোট দোকানে খাবার বিক্রি করা হচ্ছে।
আমরা খাবারের অপেক্ষা করছি। বসে আছি উন্মুক্ত চত্বরে। পার্কের আবহ বিরাজ করছে চারদিকে। অনতিদূরে উইন্ডো অব দ্য ওয়ার্ল্ডের আলোর ঝলকানি। আইফেল টাওয়ার কিংবা ল্যূভর মিউজিয়ামের কাঁচের উল্টো পিরামিড। সবই মুগ্ধতা ছড়াচ্ছিল। রাত হয়েছে বেশ আগে। কিন্তু অন্ধকারের কোন চিহ্ন ছিল না ধারে কাছে। চারদিকে এত আলো যে দিনের মতো স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল সবকিছু। গল্প করছিলাম আমরা। চীনের উত্থান নিয়ে দেখা নাটকটির প্রসঙ্গ তুলে কথা বলছিলাম। কোত্থেকে কোথায় চলে গেছে একটি দেশ। মাত্র আধা শতাব্দি আগেও খাদ্যের অভাবে যে দেশে হাজার হাজার মানুষ অনাহারে থাকতো। ১৯৫৯ থেকে ১৯৬১ সালে চীন ভয়াবহতম যে দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছিল তাতে মারা গিয়েছিল অন্তত তিন কোটি মানুষ। শুধু ওই দুর্ভিক্ষই বা কেন, পরবর্তীতে আরো বহুদিন চীনের মানুষ দারিদ্রতার সাথে যুদ্ধ করেছে। অসংখ্য শিশুসহ লাখো মানুষ রাতে না খেয়ে ঘুমাতে যেতো, আফিম খেয়ে বুদ হয়ে পড়ে থাকতো যে দেশের লাখ লাখ যুবক, দারিদ্রতা ছিল যাদের নিত্যসঙ্গী, সেই জাতি কী করে বিশ্বের সুপার পাওয়ার হয়ে উঠলো তা যেন বিশ্ব ইতিহাসে এক বড় বিস্ময়। যাকে অর্থনীতিবিদেরা বলেছেন ‘অলৌকিক অর্থনীতি’ বা ‘মিরাকল ইকোনমি’।
মাত্র আধা শতাব্দি আগে চীনা নেতা মাও জে দং বা মাও সে তুং রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহণের পর ‘গ্রেট লিপ ফরোয়ার্ড’ নামে যে কর্মসূচি শুরু করেছিলেন তাতেই কী এমন সোনার কাঠি ছিল যে দেশটি তরতরিয়ে এগিয়ে গেল! চীনের উত্থানের পেছনে বহু কথা আছে, আছে বহু ঘটনাও। কিন্তু আমরা যেহেতু ইতিহাসচর্চা করতে বসিনি তাই অতসব তাত্ত্বিক আলোচনায় গেলাম না। শুধু এটুকু বুঝলাম যে গণমুখী নেতৃত্ব এবং কঠোর পরিশ্রমই চীনকে আজকের অবস্থানে নিয়ে এসেছে। আরো একটি ব্যাপার আমি খেয়াল করেছিলাম, সেটি হচ্ছে নারীর ক্ষমতায়ন। চীনের জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি নারী। এই বিপুল সংখ্যক নারীকে ঘর থেকে বের করে কর্মশক্তিকে পরিণত করার ফলেই চীন হু হু করে এগিয়েছে বলেও মনে হলো আমার। আমার এই মন্তব্যে কায়সার ভাইও সায় দিলেন। চীনের সর্বত্র নারীর জয়জয়কার। স্কুল, কলেজ, দোকান, কারখানা, ট্যুরিজম, ড্রাইভিং, শৃংখলাসহ সব কাজই করছেন নারীরা। ইউরোপ আমেরিকার চেয়ে বহু বেশি নারী চীনের ব্যবসা বাণিজ্য থেকে শুরু করে সাধারণ অফিস কিংবা দোকান পাট সামলান। ক্যান্টন ফেয়ারে যে পরিমাণ নারী শিল্প কারখানার প্রতিনিধিত্ব করছিলেন তার সিকিভাগও পুরুষ দেখিনি। এই যে ‘উইন্ডো অব দ্য ওয়ার্ল্ডে’র সামনের এই খাবারের রেস্টুরেন্টগুলোও সামলাচ্ছেন নারীরা। কোটি কোটি নারীর হাতকে কর্মীর হাতে পরিণত করার মাধ্যমে চীন শুধু বিশ্বের মেগা কারখানাই নয়, একইসাথে বৃহৎ অর্থনীতির দেশেও পরিণত হয়েছে। মিরাকল ইকোনমির ‘মিরাকল’ কি তা নিয়ে নানামত রয়েছে, কিন্তু আমার মনে হয় নারীই এই মিরাকল বা অলৌলিকতা!
ডিজিটাল ডিসপ্লেতে আমাদের টোকেন নম্বর শো হচ্ছিল। অর্থাৎ আমাদের খাবার তৈরি হয়ে গেছে। আমরা তিনজনই একই সাথে কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। চীনা তরুণী ট্রেতে সাজিয়ে খাবারগুলো আমাদের দিকে এগিয়ে ধরলো। অত্যন্ত সুশ্রী মেয়েটির হাতের দিকে তাকিয়ে আমি যেন সত্যি সত্যি ‘মিরাকল’ টের পাচ্ছিলাম!
(চলবে)
লেখক : চিফ রিপোর্টার, দৈনিক আজাদী।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপ্রকৃতির পালাবদলের সৌন্দর্য
পরবর্তী নিবন্ধজীবনের তাগিদে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে পরিবেশের সাথে