জীবনের তাগিদে নিজেকে মানিয়ে নিতে হবে পরিবেশের সাথে

ছন্দা চক্রবর্তী | বুধবার , ১৬ নভেম্বর, ২০২২ at ৭:৪৯ পূর্বাহ্ণ

আশা মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে। আশায় মানুষ বাঁধে ঘর। ঘরকে ঠিকঠাক রাখতে হলে প্রত্যেক অনুভূতির সাথে লড়ে যেতে হয়। হাসি, কান্না, পাওয়া না পাওয়া সবকিছু প্রতিটি নদীর ঢেউয়ের মতো জীবনের ঢেউগুলিকে সামলে নেওয়ার দায়িত্বটা কাঁধে চাপে। সেই দায়িত্বগুলো যতোই সমাধান দেওয়া যায়, ততই নদী রূপ সংসার ধারা সামনের দিকে প্রবাহিত হয়।
‘সংসার মানেই অধিকারকে অর্ধেক করে দায়িত্বকে দিগুণ করে সমাধান করা’ (কবিগুরু)। যতই দায়িত্ব পালন করা হবে, ততই সাগররূপী সংসারের বিশালতা বাড়বে। সাগরের ঔদার্য্য, মহত্ত্ব, কৃষ্টি, ঐতিহ্য, বংশপরম্পরা, সবকিছু নদীর ধারা বা গতির উপর নির্ভর করে। সাগরে এসে বিলীন হয় নদীগুলো। জীবনগুলোও তাই সংসারে এসে বিলীন হতে চায়, এখানেই সংসারের সৌন্দর্য।
সংসারের সৌন্দর্য নির্ভর করে সংসারে যিনি হাল ধরে থাকেন তার উপর। মা বা বাবা, যার নেতৃত্বে থাকুক না কেন চলার সূত্র টা যদি সৎ তত্ত্বের সাথে নিবিষ্ট থাকে, তবে অপরাপর সকলেই সেই চর্চায় অভ্যস্ত হয়। অভ্যস্ত হওয়া মানুষের জীবন নানা ঘাত প্রতিঘাত যাই আসুক, ‘সত্যেরে লও সহজে’এই মতকে প্রাধান্য দিয়ে সংসারের মানুষগুলো এগিয়ে যায়।
একটি জীবন অনেক ভালো ঘটনার সমষ্টিও হয়। দুই/একটা খারাপ বা মন্দ ঘটনা নিয়ে ব্যতিব্যস্ত হওয়া উচিত কাজ নয়। সংসার মানে শাখা প্রশাখা সমেত নদীর মতোই অনেকগুলো মানুষে মানুষে এক একটি সম্পর্কের সৃষ্টি। সংসারের পরিধি যত বাড়ে সম্পর্কের ডালপালা তত বিস্তার লাভ করে।
আমরা ভাবি, কিছু পুরানো সম্পর্ক হয়তো ভুলে যাওয়া যায়, কিন্তু না, একবার কোনো সম্পর্ক তৈরি হলে তার রেশ সারা জীবন বয়ে বেড়াতে হয়। অতিরিক্ত খারাপ অভিজ্ঞতার সম্পর্ক, যা আমরা ভুলে যেতে চাই, তা সত্যিই ভোলা যায় না।
আবার অতিরিক্ত ভালো সম্পর্ক তাও মনে দাগ কাটে বলে তাও ভোলা যায় না। স্বাভাবিক সম্পর্ক যেগুলো সাধারণ সেগুলো কালের যাত্রায় বিলীন হতে থাকে বটে কিন্তু পরিবেশ পরিস্থিতি অনুকূল হলেই সেসব সম্পর্ক গুলো আবার মনে পড়ে যায়। শৈশব ও কৈশোরে গড়া সম্পর্ক যেগুলো সৃষ্টি হয়েছিল তা মধ্যবয়সে ভুলে গেলেও ষাট বছর পর সেসব বার বার মনে পড়ে। অতি আবেগপ্রবণ মানুষেরা পুরানো সম্পকের্র কাছে হেরে যেতে থাকে, নিজেরা অনেক কষ্ট পায়। কিন্তু যারা নিজেকে সামলাতে জানে, তৃষ্ণার্ত আবেগের বেগকে বাড়তে না দিয়ে লাগাম ধরার কৌশল জানে, তাদের মনে ম্লান স্পর্শ লাগতে পারে না।
একটি সম্পর্ক যখন কারো জীবনে ক্ষত সৃষ্টি করে দিয়ে যায়, তখন ভুক্তভোগী মানুষ আহত পাখির মতো ছটফট করে। এমন অবস্থা থেকে উত্তোরণের জন্য কারোর যখন সাহায্যের প্রয়োজন পড়ে সেই সম্পর্ক থেকে বেরিয়ে আসার, তখন তার কাউন্সেলিং বা মনোচিকিৎসার মাধ্যমে তার জীবনের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হয়।
সব মানুষ একভাবে সব কিছু সামাল দিতে পারে না, আলাদা আলাদা মানুষ আলাদা আলাদা অস্তিত্ব। সংসারের অপরাপর মানুষগুলো সাগরের ঔদার্য নিয়ে আহত মানুষকে সুস্থ ও ঠিক পথে চলার যোগান দিতে হয়। সবসময় তার পাশে থাকার চেষ্টা চালিয়ে যেতে হয়, সেখানেই থাকে সম্পর্কের সৌন্দর্য।
বহু বহু গুণীজনদের উপদেশ থেকে একটা বিশ্বাস আত্মস্থ হয়েছে যে, যখন কোনো কঠিন সময় পার করতে হয়, তখন বুঝে নিতে হবে যে, সামনে ভালো কিছু অপেক্ষা করছে। কঠিন সময় টা আত্মবিশ্বাস ধরে রেখে পার করতে পারলে সামনে এগোনো অনেক খানি সহজ হয়। এই সহজে এগোনোর ক্ষেত্রে নিজেকে কিছু সাধনা করে যেতে হয়। যেমন আশপাশ, পরিবার, পরিবেশের সকলের কথা মন দিয়ে শোনা। বিশ্বসংসার এর আছে হাজারো রকমের কণ্ঠস্বর। একেক জনের একেক সুর, ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ, ভিন্ন ভিন্ন রঙ। কিন্তু মনে গেঁথে রাখতে হবে, সকলেই একই রংধনুর অংশ। এই রংধনুতে যতখানি লাল, ততখানি হলুদ, ততখানিই সবুজ, নীল, বেগুনি বা কমলা। সবখানে কিছু না কিছু ভালো আছে। সুতরাং ভালোটা খুঁজে বের করাই কাজের কাজ। এভাবে এগোনো গেলেই এগিয়ে যাওয়ার পথটা মসৃণ হবে।
মার্কিন কবি, ‘রবার্ট ফ্রস্ট’ এর শিক্ষার সংজ্ঞা অর্থাৎ শিক্ষা কী! বলতে গিয়ে এক জায়গায় বলেছেন, ‘মেজাজ ঠিক রেখে, আর বিশ্বাস না হারিয়ে সব কিছু শোনার মতো যোগ্যতার নাম শিক্ষা’। সব কিছুর সাথে, অতীতের সাথে, অতীত এর একগুঁয়েমী তত্ব নিয়ে পড়ে থেকে নয়, ভবিষ্যতের ভাবনার সাথে সামঞ্জস্য রেখে পরিবেশ পরিস্থিতির সাথে মত বদলিয়েই শিক্ষা নিতে হয়।
এই যে আজ দেড় বছর যাবত আমরা ভয়াবহ একটা সময় পার করলাম যাকে আমরা বলছি, কোভিড-১৯এর সময় বা করোনাকালীন সময়। এই সময়ের প্রথম দিকে আমরা নতুনভাবে কত কিছুই দেখলাম, শিখলাম কত নতুন ব্যবস্থা, নতুন শব্দ, নতুন ভাষা, সম্পর্কের নতুন ধারণা, নতুন সামাজিকিকরণ, স্বাস্থ্যবিধি মানা, সামাজিক দূরত্ব মানা, নিরাপদে থাকা, নিরাপদে রাখা, মাস্ক পরা, হাত ধোয়া, সেনিটাইজার মাখা ইত্যাদি আরো কতো কী! এসবের মূল দর্শনগুলোতে আমাদেরকে নতুন করে খাপখাওয়াতে শিখতে অভ্যস্ত হতে হলো।
করোনার করুনায় আমরা যারা এখনোও টিকে আছি, কিন্তু একদম ঠিক নেই, কারণ হারিয়েছি অনেক প্রিয়জন, বিজ্ঞজন, কিংবদন্তিতুল্য ব্যক্তিবর্গ, সাহিত্যিক, লেখক, কবি, শিল্পী, রাজনীতিক, আরও অনেক মহৎপ্রাণ মানুষ। এখন মোটামুটি সামলে উঠা যাকে বলে, সেটা দেখা যাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী এর দূরদর্শী নেতৃত্ব, এবং রাষ্ট্রীয় তৎপরতায় টিকাদান কার্যক্রম অনেকখানি আত্মবিশ্বাসী করতে সক্ষম হয়েছে বাংলাদেশ। বিশ্বের অনেক দেশ এখনো এ কার্যক্রমে অনেক পিছিয়ে। যতদিন পর্যন্ত পুরো বিশ্ব ভ্যাক্সিন এর আওতায় আসছে না ততদিন কেউ নিরাপদ নয়, এই তত্ত্ব আর বলার অপেক্ষা রাখে না।বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য ও গবেষণা মতে তাড়াতাড়ি এই পৃথিবী কোভিড-১৯ মুক্ত হবে না, তাই করোনা ভাইরাস আর মানুষ একসাথে বাস করবে এই পৃথিবীতে। অন্যান্য ভাইরাসের মতো কোভিড- ১৯ও আমাদের পৃথিবীর অংশীদার, সমাজের অংশীদার এমনকি সংসারের একজন। অতীতে আমরা যেরূপ মহামারী রূপ ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়াকে মোকাবিলা করে পৃথিবীকে তাদেরও অংশীদার করা হয়েছে, কোভিড-১৯ ও তাই। এইটি এখন পৃথিবীতে বাসকারী সহযাত্রী। সংসারের মা, বাবা, ভাই, বোন, সন্তান এর সঙ্গে এটি ও একটি সত্তা। এই সহযাত্রী থেকে রক্ষা পেতে হলে জীবন বিধি পাল্টানো ছাড়া অন্য উপায় নেই।
প্রথম জীবন বিধি হলো শরীরে ইমিউন সিস্টেম ঠিক রাখা। আমি করোনার সাথে আছি বা করোনা আমার সাথে আছে, কিন্তু করোনা আমাকে নাড়াতে পারছে না, অর্থাৎ ইমিউন সিস্টেম যদি শক্তিশালী হয়, করোনা পরাজিত হবেই। সেক্ষেত্রে একটি আদর্শ স্বাস্থ্য নীতি মেনে আমাদেরকে খাদ্য, শিক্ষা, বাসস্থান, এবং আচরণে মনোযোগী হতে হবে। আজকের সংসার হবে করোনাকে মোকাবিলারও সংসার।
আমাদের জানা আছে, আদর্শ খাদ্য এর উপকরণ, কিন্তু মানি কই! সকালে এক গাদা কার্বোহাইড্রেট দিয়েই প্রায় সবার ব্রেকফাস্ট সারা হয়। কিন্তু এখন আর তা করা যাবে না। পানি, প্রোটিন, ফলমুল, এর পরিমাণ এর চেয়ে কম পরিমাণ কার্বোহাইড্রেট দিয়েই ব্রেকফাস্ট সারা, এবং দুধ চা এর পরিবর্তে মসল্লা চা এর অভ্যাস করে নিতে হবে। সকালে যোগ ব্যায়াম, ওয়ার্ম আপ, সহ এক ঘণ্টা হাঁটা এসবের মাধ্যমে দিন শুরু করার অভ্যাস করতে হবে। ফিটনেস ঠিক রাখতেই হবে। প্রতি মুহূর্তে মনে রাখতে হবে, আমাদের সংসারে এখন নতুন অতিথি কোভিড-১৯ আছে। তাকে মোকাবিলা করার জন্য একটা প্রচেষ্টা সবসময় রাখতেই হবে। তাই আগের খাদ্যাভ্যাস বদলিয়ে সহজ, সরল, ঘরে বানানো খাবারের উপর নির্ভরতা বাড়াতে হবে।
দ্বিতীয় ধাপ হলো শিক্ষা। শিক্ষা তো প্রতি মুহূর্তে, প্রতিটি কাজে, নুতন করে ভাববার শিক্ষা আয়ত্ত্বে আনতে হবে। যেমন – মুখে মাস্ক কেন পরছি! না পরলে কী হবে! মুখে মাস্ক শুধু আমাকে রক্ষা করে না, নিজেদের আশপাশে যারা থাকে তাদেরকেও রক্ষা করবে। এসব ধারণা সবার মাঝে ছড়িয়ে দেওয়ার শিক্ষাও নিতে হবে। বলতে গেলে কোভিড আমাদেরকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। প্রথমত আমরা ছুটছিলাম সবাই ঘূর্ণি বলয়ের মতো। সেক্ষেত্রে আমাদের বিশ্রামের বড় প্রয়োজন ছিল তাই আমাদেরকে অখণ্ড অবসরে পাঠালো।
এই অবসরে পরিবারের অপরাপর মানুষগুলোর সাথে একসাথে থাকার সুযোগ হলো, একসাথে সময় কাটানো, একসাথে খাওয়া, একসাথে কাজ করা, সংসার এর যাবতীয় কাজে সকলের অংশগ্রহণ করার সুযোগ সৃষ্টি হওয়া, এসব সুন্দর অনুভূতির অভিজ্ঞতা ভবিষ্যতে আর পাওয়া যাবে কিনা সন্দেহ।
একবার যদি গভীরভাবে ভাবা হয় যে, প্রথম তিন মাস ধৈর্যের সাথে একে অপরের পাশে থাকা হয়েছে ঘরের ভিতর অখণ্ড অবসরে। শ্রমবণ্টন পদ্ধতি যথেষ্ট দক্ষতার সাথে পরিচালিত হয়েছে প্রায় প্রতিটি সংসারে। এসব শিক্ষাগুলো হয়তো মৌমাছি বা পিঁপড়ের শ্রমনীতিকেও হার মানিয়েছে।
বাসস্থান এর কথা যদি বলি- চারদিক পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা, ধোয়া-মোছার কাজও বেড়েছে কয়েক গুণে, সবাই মিলে যার যার কাজ ছাড়াও সংসারের সাধারণ কাজ ভাগাভাগি করে অংশগ্রহণ করা হয়েছে তাতে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের আগের চেয়ে বহুগুণে কর্মদক্ষতার সুযোগ বেড়েছে।
এখন সবাই সচেতন। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার অভ্যাস হয়েছে, দূরে থেকে কথা বলা, গণ জমায়েতে যোগ না দেওয়া, ভার্চুয়ালী যুক্ত হওয়া, ভার্চুয়াল হওয়ার কলা কৌশল রপ্ত করা, জীবনকে ডিজিটাল করা, অনলাইনে কাজ করার কৌশল শেখা, কত ঋদ্ধ, সমৃদ্ধ হওয়ার সুযোগ পেলাম আমরা।
আমরা হারিয়েছি অনেক কিছু, সেটা যেমন ঠিক, শিখেছিও কি কমকিছু। কত দক্ষতা, কতভাবে আয়ত্ত করেছি। করোনা আমাদেরকে সাম্যবাদের ধারনাকে জাগরিত করেছে। ধনী-গরীব, ক্ষুদ্র -বৃহৎ, রাজা-প্রজা, সুখী-দুখী সবাই সমান। সবাই এই পৃথিবীর সন্তান। জীবন সবার এক রকম হবে না, সবার চাহিদা ভিন্ন, মহামারি ও ভিন্ন ভিন্ন পরিবেশ পরিস্থিতিতে নিজেকে মানিয়ে আরও শক্তিশালী হতেও জানে। তাই সবাইকে পাল্টাতে হবেই। এই পৃথিবীটাতে সবাই সাম্যবাদ তত্ত্বে বেঁচে থাকবে। এটাই আজকের পৃথিবীর তৃষ্ণা। তৃষ্ণাকে মিটাতে হলে যার যা কর্তব্য তাকে ঠিক সেটিই করে যেতে হবে। এই বিশ্বে ঠিকে থাকার জন্য খাপখাওয়ানোর যোগ্যতা যার যার, তার তার, অনেকটা চাতক পাখির ধারা জলের চাহিদার মতো। শত শত নদ-নদী, সাগর মহাসাগরে বিপুল জলরাশি চাতকীর কোনো প্রয়োজনে আসে না, সে শুধু বৃষ্টির ধারা জলেই তৃষ্ণা মিটায়ে বেঁচে থাকার লড়াই চালিয়ে যায়। আমাদেরকেও করোনার লড়াইয়ে লড়ে যেতে হবে যার যার প্রয়োজন মতো।
লেখক : অধ্যক্ষ, হুলাইন ছালেহ নূর কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধমূল্যস্ফীতি ও সম্ভাব্য খাদ্যসংকট