আলোকচিত্রে মঞ্চালোক ছবি যেন শুধু ছবি নয়

জাহেদুল আলম | সোমবার , ১ এপ্রিল, ২০২৪ at ১০:৫৮ পূর্বাহ্ণ

মঞ্চ নাটকের আলোকচিত্র নিয়ে প্রথম প্রদর্শনী হয় চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে ১৯৯৭ সালের ২১ ডিসেম্বর থেকে ২৮ ডিসেম্বর; সাইদুল আজাদের একক আলোকচিত্র প্রদর্শনী ‘স্থিরচিত্রে দৃশ্যকাব্য’। এক বছর পর একই স্থানে ১৯৯৮ সালের ২২ নভেম্বর থেকে ৩০ নভেম্বর ‘সাইদুল আজাদের ক্যামেরায় মঞ্চকাব্য’ শিরোনামে মঞ্চ নাটকের ছবি নিয়ে আরেকটি প্রদর্শনী হয়। এরপর ২০০৪ সালে মোরশেদ হিমাদ্রি হিমু প্রদর্শনী করেন চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমিতেই। ২০০৬ সালের ২১ থেকে ২৪ সেপ্টেম্বর তিনি থিয়েটার ইনস্টিটিউটে করেন ‘আলোছায়ায় বাংলাদেশের নাটক’ শীর্ষক আলোকচিত্র প্রদর্শনী। দীর্ঘ বিরতির পর ২০১৮ সালে চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি আর্ট গ্যালারিতে ‘স্কেচ গ্যালারি’র মাধ্যমে নাট্যজন শাহরিয়ার হান্নান ৭ থেকে ১৪ ডিসেম্বর আটদিনব্যাপী ‘আলোকচিত্রে মঞ্চালোক’ শীর্ষক মঞ্চনাটকের ছবি প্রদর্শনী করেন। প্রদর্শনীটির তৃতীয় অধ্যায় সমাপ্ত হলো গত ২৯ ফেব্রুয়ারি থেকে ২ মার্চ অবধি একই গ্যালারিতে। ইতোমধ্যে শাহরিয়ার হান্নান একই গ্যালারিতে দ্বিতীয় অধ্যায় উদ্‌যাপন করেছেন ২০২২ সালের ২৮ থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। তিনি মাঝখানে আরও দুটি প্রদর্শনী করেন ২০১৯ সালের ফেব্রুয়ারি ও মে মাসে যথাক্রমে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জারুলতলায়, নাট্যকলা বিভাগের নাট্যোৎসব উপলক্ষে এবং পূর্ব ফিরোজশাহ কলোনি মাঠে। আরও প্রদর্শনী হয়েছে ফেব্রুয়ারি ২০২০এ টিআইসিতে ও পতেঙ্গার মাইজপাড়ায় ‘আমরা পলাশে’র সাংস্কৃতিক উৎসবে।

১৯৯৭ সালে সাইদুল আজাদের ‘স্থিরচিত্রে দৃশ্যকাব্য’ প্রদর্শনী উপলক্ষে প্রকাশিত স্যুভেনিরে তিনি লিখেছেন, “মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে মঞ্চনাটকের বিস্ময়কর জোয়ার পরিলক্ষিত হয়েছে। বিশ্ববিখ্যাত নাটকগুলোর মঞ্চসফল প্রযোজনা বাংলাদেশের মঞ্চগুলোকে মুখর করে রেখেছিল। সাম্প্রতিক সময়ে এই মুখরতা শতগুণ বৃদ্ধি পেলেও প্রযোজনার মান নিয়ে আজ সবাই উদ্বিগ্ন, শংকিত। এই শংকা উত্তরণে আজকের নাট্যকর্মীদের দরকার অতীতের সমৃদ্ধ প্রযোজনাগুলো নিয়ে আলোচনা করা। কিন্তু সমস্যা এইএই প্রযোজনাগুলো দেখার আর সুযোগ নেই। অধিকাংশ প্রযোজনাই বন্ধ হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে আলোকচিত্র। কেননা আলোকচিত্র কখনো মিথ্যা বলে না। অতীত আর বর্তমানে সেতুবন্ধ রচনা করে।” সাইদুল আজাদ সে সময় ছিলেন নিয়মিত নাট্যকর্মী। সমীকরণ থিয়েটারের টু ইডিয়টস আর ট্রাংক রহস্য নাটক দুটির অভিনেতা। সৌখিন আলোকচিত্রশিল্পী থেকে পরবর্র্তীতে পেশাদার আলোকচিত্রশিল্পীতে পরিণত হন। যতদূর মনে পড়ে, তাঁর ১৯৯৭ ও ১৯৯৮ সালের আলোকচিত্র প্রদর্শনী দুটির নেপথ্যে অনন্য ভূমিকা পালন করেছিলেন তখনকার তুখোড় অভিনেতা, সমালোচক ও সংগঠক এবং এখনকার একনিষ্ঠ নাট্যগবেষক ড. ইউসুফ ইকবাল।

শাহরিয়ার হান্নান একাধারে নাট্যকার, নির্দেশক ও অভিনেতা। তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, তিনি কবে থেকে নাটকের ছবি তুলছেন এবং কেন মঞ্চ নাটকের ছবি তোলার প্রতি আগ্রহী ও মনোযোগী হলেন। তাঁর বক্তব্য থেকে জানা গেলছবি তুলে সংগ্রহ করা তাঁর দীর্ঘদিনের অভ্যাস। তিনি তির্যক নাট্যগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের কর্মী। তির্যকের আগে অধুনালুপ্ত নাট্য সম্প্রদায় শিকড়ের কর্মী ছিলেন। সবসময় তিনি দলের নাটকের ছবি তুলতেন। তির্যকে যোগদানের পর সংগঠনে সিনিয়র সদস্য নির্দেশক সালাউদ্দিন ভূঁইয়ার কাছ থেকে বেশ কিছু পুরনো নাটকের ছবি পেয়েছেন। ২০১২ সালে তির্যকের তিন যুগ পূর্তি উপলক্ষে কিছু কার্যক্রম পরিচালনার দায়িত্ব লাভ করেন। তখন তির্যকের প্রতিষ্ঠাতা ও নাটকে বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত নাট্যব্যক্তিত্ব রবিউল আলম সত্তর দশক থেকে নব্বই দশক পর্যন্ত মঞ্চস্থ অনেক নাটকের ছবি প্রদান করেন। সেবার দলীয় নাটকের সংগৃহীত আলোকচিত্র সমন্বয়ে একটি প্রদর্শনীর আয়োজন করেন চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমিতে। আয়োজনটি বেশ প্রশংসিত হয়। এতে নাটকের ছবি সংগ্রহ ও প্রদর্শনের ক্ষুধা ও দায়বোধ বেড়ে যায় তাঁর। এসব প্রচেষ্টারই ফলস্বরূপ ‘স্কেচ গ্যালারি’র ব্যানারে ২০১৮, ২০২২ ও ২০২৪ সালে চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি আর্ট গ্যালারিতে আয়োজন করেন ‘আলোকচিত্রে মঞ্চালোক’। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় পতেঙ্গা, টিআইসি ও ফিরোজশাহ কলোনির আয়োজনগুলো তো আছেই। নাট্য ব্যক্তিত্ব বাবুল বিশ্বাস পরিচালিত ‘বাংলাদেশ থিয়েটার আর্কাইভস’ থেকেও শাহরিয়ার হান্নান অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।

মঞ্চনাটক জীবন্ত শিল্পমাধ্যম। জীবন্ত মানুষের সামনে জীবন্ত মানুষ সরাসরি অভিনয় নৈপুন্যের মাধ্যমে বিষয় ও কাহিনী উপস্থাপন করেন। একটি নাটক একাধিকবার মঞ্চস্থ হলেও প্রতি সন্ধ্যায় বা মঞ্চায়নে উপস্থিত দর্শক যে অভিজ্ঞতা লাভ করেন, তা স্মৃতির নিউরন ছাড়া ধরে রাখা সম্ভব নয়। যেটা অন্য শিল্পমাধ্যমে ধরে রাখা সম্ভব। এক্ষেত্রে আলোকচিত্রের ভূমিকা অপরিসীম। মঞ্চের নান্দনিকতা আলোকচিত্রে ধরা পড়লে তা দর্শনে দর্শককে যেমন মঞ্চনাটকের প্রতি কৌতূহলী করে তুলবে, তেমনি প্রযোজনাটির মঞ্চায়ন বন্ধ হয়ে গেলেও আলোকচিত্রের কল্যাণে অনেক তথ্যউপাত্ত জানা যাবে। যা পরবর্তী প্রযোজনা নির্মাণে ও দর্শক সৃষ্টিতে অবদান রাখবে।

শাহরিয়ার হান্নানের সাথে আলাপচারিতায় জানা যায়চট্টগ্রামে মোরশেদ হিমাদ্রি হিমুর কাছে যথাযথ প্রক্রিয়ায় মঞ্চ নাটকের অনেক আলোকচিত্র সংগৃহীত আছে। ‘আলোককচিত্রে মঞ্চালোক’ প্রদর্শনীর ছবিগুলো শাহরিয়ায় হান্নান, মোরশেদ হিমাদ্রি হিমু ও আনজীর হোসেন ফাহিম কর্তৃক ধারণ করা বলে প্রকাশিত ব্রুশিয়রে উল্লেখ করা হয়েছে। ব্রুশিয়রে সাইদুল আজাদের আলোকচিত্রের কোনো উল্লেখ নেই। যদিও প্রদর্শনীতে বেশ কয়েকটি আলোকচিত্র দেখে চিনতে পেরেছি এগুলো সাইদুল আজাদের তোলা। ‘আলোকচিত্রে মঞ্চালোক’ এর প্রদর্শনীতে সমতাবিধান পরিলক্ষিত হয়নি। ক্যাপশনে কোনো কোনো নাটকের নাম, নাট্যকার ও নির্দেশকের নাম আছে। আবার কোনো কোনো ক্যাপশানে শুধু নাটকের নাম আছে। কোনো কোনো ক্যাপশনে আলোকচিত্রটি নাটকের কোন দৃশ্য সেটাও উল্লেখ আছে। কোনো নাটকের দুটি আলোকচিত্রের একটিতে নাট্যকারের নাম নেই, অন্যটিতে নাট্যকারের নাম আছে; তবে ইনি এই নাটকের নাট্যকার নন। ‘স্কেচ গ্যালারি’ নাটকও প্রযোজনা করেছে। তাও মাত্র একটি। কিন্তু সেই একটি নাটকের অসংখ্য আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে দেওয়া হয়েছে। এটা পরিমিতিবোধের পরিচয় তো নয়ই, বরং অন্য সংগঠনের প্রযোজনাগুলোর প্রতি অবমাননাকর। আবার গত দুইবছর নিয়মিত মঞ্চায়ন হওয়া অনেক নাটকের কোনো আলোকচিত্র নেই। যে নাটকগুলোর মধ্যে কয়েকটি ইতিমধ্যে প্রশংসিত ও আলোচিত হয়েছে। গত কয়েক বছরের এসব নাটকের কোনো আলোকচিত্র না থাকাটা আয়োজক সংগঠন ও ব্যক্তির ব্যর্থতা হিসেবে পরিগণিত হবে। বিমাতাসুলভ দৃষ্টিভঙ্গির অভিযোগও আসতে পারে। কেননা, প্রদর্শনীতে কোনো কোনো ব্যক্তিবিশেষকে প্রাধান্য দেওয়ায় প্রচেষ্টা পরিকল্পিত হয়েছে। আশা করছি, পরবর্তী প্রদর্শনী থেকে এসব অসংগতি পরিহার হবে।

স্কেচ গ্যালারি’ ও শাহরিয়ার হান্নানের ‘আলোকচিত্রে মঞ্চালোকে’র মাধ্যমে চট্টগ্রামে গত পঞ্চাশ বছরের নাট্যচর্চার একটা খণ্ডচিত্র পাওয়া যাবে। এ ধরণের আয়োজন চট্টগ্রামের বাইরে শুধুমাত্র ঢাকায় ‘বাংলাদেশ থিয়েটার আর্কাইভস’ কর্তৃক করার নজির আছে। বেশকিছু প্রতিকূলতা ও সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে শাহরিয়ার হান্নানকে যেতে হচ্ছে। সব নাট্যসংগঠন থেকে সহযোগিতা পাওয়া যায় না। অনেক সংগঠনে ছবির কোনো সংগ্রহ নেই। আলাপচারিতায় তিনি নাট্য সংগঠনগুলোকে যত্নশীলভাবে ও পেশাদার ব্যক্তিকে দিয়ে নাটকের ছবি তোলার প্রতি আহ্বান জানান ও গুরুত্বরোপ করেন। তাঁর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় রয়েছে সারাদেশে প্রদর্শনী করার মাধ্যমে মানুষকে মঞ্চনাটক সম্পর্কে অবহিত ও সচেতন করা এবং দর্শক সৃষ্টি করা, নিবেদিতপ্রাণ নাট্যজনদের সম্মাননা জানানো, একটি সমৃদ্ধ অ্যালবাম প্রকাশ করা ও থিয়েটারের তথ্য সমৃদ্ধ আর্কাইভ গড়ে তোলা। তাঁর এসব মহতি উদ্যোগের সফলতা কামনা করছি। এই প্রসঙ্গে নাট্যকার প্রদীপ দেওয়ানজীর বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। ১৯৯৭ সালে অনুষ্ঠিত হওয়া সাইদুল আজাদের ‘স্থিরচিত্রে দৃশ্যকাব্য’ উপলক্ষে প্রকাশিত স্যুভেনিরে প্রদীপ দেওয়ানজী বলেছেন,“ একটি অন্যরকম আয়োজন, প্রশংসনীয় উদ্যোগ। বাংলাদেশে সৎ এবং কমিটেড নাট্যচর্চা আমাদের সুস্থ সংস্কৃতির শিরদাঁড়া সোজা করে রেখেছেস্বাধীনতার পর থেকেই। সেই বহুমাত্রিক নাট্যচর্চাকে স্থিরচিত্রে গেঁথে সমকালীন প্রয়াসকে চিরকালীন ফ্রেমে ধরে রেখেছে সাইদুল। ইচ্ছার সাথে আন্তরিকতা যুক্ত হলেই এটা সম্ভব। আলোকচিত্রী সাইদুলের কাছে নাট্যকর্মী সাইদুল ঋণী হয়ে রইল।” আমরাও নাট্যজন শাহরিয়ার হান্নানের কাছে ঋণী হয়ে রইলাম।

শেষ করছি প্রবীণ নাট্যব্যক্তিত্ব রবিউল আলমের একটি উদ্বৃতি দিয়ে। উদ্বৃতিটি সংগ্রহ করেছি ১৯৯৮ সালে সাইদুল আজাদের দ্বিতীয় প্রদর্শনী ‘সাইদুল আজাদের ক্যামেরায় মঞ্চকাব্য’ এর প্রকাশনা থেকে। তাঁর কথাগুলো এখনো প্রাসঙ্গিক এবং শাহরিয়ার হান্নানের ‘আলোকচিত্রে মঞ্চালোক’এর উদ্যোগের সাথেও সমার্থক। তিনি বলেছেন, “মুক্তিযুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে শিল্পকলা চর্চায় নাট্যকলা একটি ফলবান সতেজ শাখা। অজস্র নাট্যকর্মীর কর্মকোলাহলে মুখর আজ আমাদের নাট্যপাড়া। বাংলাদেশে নাট্যচর্চার এই জোয়ারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে চট্টগ্রাম। বিখ্যাত সব প্রযোজনার উত্তরাধিকার এই শহরের প্রবীণনবীন নাট্যকর্মীদের সেতুবন্ধ রচনা করতে সাইদুল আজাদের এই পরিকল্পিত ও ব্যতিক্রমী প্রচেষ্টাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি”। আমরাও শুভকামনা ও অভিনন্দন জানাচ্ছি শাহরিয়ার হান্নান ও ‘স্কেচ গ্যালারি’র ব্যতিক্রমী উদ্যোগ ‘আলোকচিত্রে মঞ্চালোক’ এর প্রতি।

নাট্যকর্মী ও শিক্ষক; সম্পাদক, নাট্যমঞ্চ

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের বর্ণিল আয়োজন
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম ডায়াবেটিক সমিতির ৪৮তম বার্ষিক সাধারণ সভা