আমার দেশ আমার শহর

এলিজাবেথ আরিফা মুবাশশিরা | রবিবার , ৩ জুলাই, ২০২২ at ৪:৫৪ পূর্বাহ্ণ

সুন্দর বাংলাদেশ আমাদের সবার প্রত্যাশা

রূপসী বাংলাদেশের সৌন্দর্যের তুলনা নেই। এ দেশের রয়েছে অপর্যাপ্ত প্রাকৃতিক সম্পদ। অফুরান রোদ, অশান্ত বৃষ্টিধারা, টলমলে গভীর জলে পরিপূর্ণ খাল-বিল-নদী ও সাগর, সবুজ শ্যামল পাহাড়ের শোভা। বেশিরভাগ জনসাধারণ শান্তিপূর্ণ, সহজ সরল জীবন ভালোবাসে, গাড়ি, ফ্রিজ, এসি, চারতলা, সাততলা, এগারো তলা, ফ্ল্যাটের লোভে কোন বড় ধরনের অন্যায় কাজ এদেশের গ্রামে- গঞ্জের মানুষ করে না। চাষী চাষ করে, জেলে মাছ ধরে, তাঁতী তাঁত বোনে, শ্রমিক সারাদিন মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কাজ করে, এমন কি আজকাল বেশিরভাগ সংসারে সাধারণ ঘরের মেয়েরা আনন্দিত মনে কাজ করে সামান্য অর্থ উপার্জন করে সন্তুষ্ট থাকে। অথচ এই সম্পদশালী দেশে সুখি মানুষের জীবনে প্রায়ই দুর্যোগ নেমে আসে। এই দুর্যোগ দুটো কারণে সর্বদা ঘটে থাকে। একটির কারণ প্রাকৃতিক, অন্যটি মানুষসৃষ্ট।
বৈশাখ মাস থেকেই বিপদের আশংকা শুরু হয়। কালবৈশাখী ঝড় হঠাৎ ঝাপটা মেরে অনেক স্থানে তোলপাড় করে বাড়িঘর ধ্বংস করে। ফসল নষ্ট করে। কখনো মানুষ আহত বা নিহত হয়। তারপরও প্রতিবছর মানুষ কোনমতে বিপদের মোকাবেলা করে বেঁচে থাকার জন্য সংগ্রাম করে। সুখি সাধারণ মানুষ বেঁচে থাকার আগ্রহে জীবন কাটায়। নববর্ষের আনন্দ সব দুঃখ ঘুচিয়ে মানুষকে বেঁচে থাকার প্রেরণা যোগায়।
মানুষের সৃষ্ট কিছু ভয়ংকর দুর্ঘটনা অনেক মানুষের জীবনে ভয়ংকর বিপদ নিয়ে আসে যা সারাজীবনেও দূর হয় না। আগুন আমাদের দেশে প্রায়ই অসাবধানে লাগে। তা প্রায় সময় কোন না কোনভাবে নির্বাপিত করা সম্ভব হয়। মানুষের জান মালের ক্ষতি হয়। সীমাহীন দুর্ভোগ অনেক মানুষের জীবনকে তিক্ত করে তোলে। ঢাকায় একবার মালিকের উদাসীনতায় বিশাল ভবন ভেঙে গার্মেন্টসের নারীরা অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করেছিল। সে রকম দুঃসহ কষ্টের স্মৃতি মনে পড়লে আমাদের অন্তরে ক্ষোভ জন্মে। গত ০৭জুন সীতাকুন্ডের বিএম কন্টেনার ডিপোর ভয়াবহ আগুনে মানুষ অসহায়ভাবে অগ্নিদগ্ধ হয়েছে। অনেকে মুহূর্তে দগ্ধ হয়ে মারা গিয়েছে। অনেকে হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করছে। কেন আগুন লাগলো কিভাবে আগুন লাগলো, কী ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ছিল তা রহস্যাবৃত। কাদের কারণে এই সাংঘাতিক আগুন লাগলো। এর পরিণাম জেনেও কি কোন প্রতিকার হয়েছে অথবা কোনদিনও হবে? অন্যায়কারী কিছু মানুষের জন্য বাংলাদেশে বার বার ভয়ংকর বিপদ ঘটছে। এর জন্য কোন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা কি নেওয়া হয়? অথচ একজন জেলে অসময়ে কয়েকটা ইলিশ মাছ ধরলে তাকে লাখ টাকা জরিমানা দিতে হয়।
সিলেট, কুড়িগ্রাম প্রভৃতি বিভিন্ন জায়গায় হাজার হাজার মানুষ পানিবন্দী হয়ে মানবেতর জীবন কাটাচ্ছে। ভারত বিরোধী ব্যক্তিরা বলে ভারত বাংলাদেশে বন্যা সৃষ্টি করেছে। আবার খবরে শোনা যায় অনেক জায়গায় বাঁধ ভেঙে পানিতে গ্রাম তলিয়ে গিয়েছে। এদেশে বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য, অনেক রকমের অজুহাতের শেষ নেই। পাকিস্তান আমলে রাঙ্গামাটি ও চট্টগ্রামের অনেক গ্রামে বন্যা হতো। কৈশোরে একবার বর্ষাকালে গ্রামে ছিলাম। দেখেছিলাম বেশির ভাগ মানুষ নৌকা অথবা ভেলায় আসা- যাওয়া করছে এবং সাগ্রহে কখনো বা প্রতিবেশির খোঁজ নিচ্ছে। তখনও গ্রামের চেয়ারম্যান ত্রাণ সামগ্রী অল্পস্বল্প দিতেন। চিরদিনই কি বাংলাদেশের দুস্থ মানুষগুলো ত্রাণের সামান্য মালের জন্য ঘন্টার পর ঘন্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকবে? এ বছর টেলিভিশনে একটা অত্যন্ত দুঃখজনক ঘটনা দেখেও নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। জনৈক চেয়ারম্যান বন্যাদুর্গত মানুষকে ত্রাণ দিচ্ছে সাথে সাথে দুস্থ মানুষটির গালে একট চড়ও দিচ্ছে। এ রকম সাহস তার কী করে হলো। অসহায় নিরপরাধ মানুষগুলোর গালে কেন চড় দেবে। এসব দৃশ্য দেখে কেউ প্রতিবাদ করে না। কারণ সবার আজকাল সব ধরনের অত্যাচার দেখতে দেখতে বিবেক লোপ পেয়ে গিয়েছে। পত্রিকা খুললেই দেখা যায় গাছের সাথে বেঁেধ কয়েকজন লোক মিলে অসহায় মানুষকে পেটাচ্ছে। শিক্ষককে অবমাননা করছে, জুতার মালা পরাচ্ছে। বাসে কয়েকজন মিলে নারীর উপর অত্যাচার করছে। কয়েকজন তরুণ বন্ধু মিলে একজন তরুণ বন্ধুকে হত্যা করছে। প্রতিবাদ করার সাহস অনেকের আছে। কিন্তু মানুষ আজকাল হতাশাগ্রস্ত। কারণ প্রতিকারের আশা বৃথা। এ যেন দাবা খেলার মত। ধৈর্য ধরে জয় লাভের আশায় সময় অতিবাহিত হয়। চতুর ব্যক্তি ঠিকই জয় লাভ করে। তবে, মানুষ অমৃতের সন্তান। তাই অনেক ভালো মানুষ আছেন, যাদের বিবেক আছে, হৃদয়ে মায়া আছে, তাই তো প্রাণ তুচ্ছ করে অগ্নিদগ্ধ মানুষকে বাঁচাবার জন্য শত শত মানুষ ছুটাছুটি করেছেন, রক্ত দিয়েছেন ও ওষুধপত্র কিনে দিয়েছেন। বন্যায় প্লাবিত মানুষগুলোর জন্য ত্রাণসামগ্রী নিয়ে ছুটে যাচ্ছেন। ‘মানুষ মানুষের জন্য’ একথা কিছু লোক ভুলে গেলেও বেশির ভাগ নারী-পুরুষ দুর্গতদের আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেছেন এবং এখনো করছেন।
পদ্মা সেতুর উদ্বোধনী দৃশ্য সবার অন্তরকে অসীম আনন্দে ভরিয়ে দিয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অটুট মনোবল ও মানুষের প্রতি অকৃত্রিম ভালবাসা অসম্ভবকে সম্ভব করেছে। তাহলে এবার আমরা আশা করবো প্রতি বছর বন্যা নিরসনের জন্য যদি এরকম কিছু পরিকল্পনা বা বাঁধ দেবার স্থায়ী প্রকল্প গ্রহণ করা হয়, তবে হয়তো বন্যা কবলিত স্থানগুলো রক্ষা করা সম্ভব হবে। আমরা সবাই জানি ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়। দেশের জনপ্রতিনিধিরা পদ্মা সেতুর বাস্তবায়ন দেখে একটু যদি নঢ়েচড়ে গদিতে বসেন তাহলে দেশবাসী উপকৃত হবে।
গত ২০/০৬/২০২২ তারিখ দিবাগত রাতে এবং কয়েকদিনের তুমুল বৃষ্টিতে চট্টগ্রামের বেশিরভাগ স্থান নালা নর্দমার ও বৃষ্টির পানিতে তলিয়ে গিয়েছিল। তবে আশার কথা এ ব্যাপারে কমিটি হয়েছে ও আলোচনা চলছে। যখনই বর্ষাকাল আসে এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন রাস্তা ঘরবাড়ি পানিতে ডুবে যায়, তখন টেলিভিশন এবং পত্রিকার খবরে পড়ি কমিটি হয়েছে। আলোচনা চলছে। পানি নিষ্কাশন অচিরেই হবে। “মশা মাছি গেল তল, হাতি বলে কত জল”? মশা মাছি পানিতে ডুবে যায়। হাতির কোন ক্ষতি হয় না। যা হোক মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতি অসীম কৃতজ্ঞতা তিনি ফ্লাইওভারের ব্যবস্থা করে আরাকান রোড, বহদ্দারহাট ও চান্দগাঁওয়ের কিছু এলাকায় অন্তত যাতায়াতের অনেকখানি সুবিধা করে দিয়েছেন। তবে একটা কথা বুঝতে পারলাম না আরাকান রোডের বিশাল নর্দমা খোলা রেখে পাশে সিমেন্টের রঙিন ফুলের গাছ লাগানো হচ্ছে। খোলা নর্দমার গন্ধ ও মশা-মাছির উপদ্রব কি সুগন্ধি ফুলের শোভার দূর করা সম্ভব হবে? মশা-মাছি ও নালার দুর্গন্ধে এলাবাসীর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। বৃটিশ আমলে জামালখান রোডে রাস্তার পাশে খোলা বিশাল নর্দমা করা হয়েছিল। তখন মানুষের জীবন এতো উন্নত ছিল না। ৭০-৮০ বছর পরেও কি ২০২২ সালে সেরকম বিশাল নর্দমা থাকবে। আরাকান রোড নতুনভাবে সুন্দর করে করা হয়েছে। কিন্তু নর্দমার কোন উন্নতি হয় নি। বৃষ্টির পানিতে নর্দমার পানি রাস্তার ও বাড়িঘরে দোকানপাটে প্রবেশ করেছে। নর্দমার পাশে এক হাত উঁচু একটা ইটের দেওয়াল দিলে অন্তত দুর্ঘটনা এড়ানো যায়। নালার পাশে টব দিয়ে কি হবে। বৃষ্টির পানি পড়লে নর্দমার পানি টব ডিঙিয়ে সব কিছু সয়লাব করে দেবে। নালার পাশে টবের কি প্রয়োজন। ফুটপাথে হাঁটতে গিয়ে টবের সাথে হোঁচট খাবে। বরং নালার পাশে বিভিন্ন রঙের কলাবতী, দোলনচাঁপা, (বেশি বড় হয় না) ইত্যাদি গাছ লাগালে ঝোপের মত হবে এবং বাইরে থেকে কদর্য নালা দেখা যাবে না, পয়সার সাশ্রয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিশেষ সুবিধা হবে। সিংগাপুর অত্যন্ত মনোরম একটি দেশ। সেখানে দেখেছি প্রায় জায়গায় বিভিন্ন রঙের কলাবতী গাছ রয়েছে। রাস্তা ও দোকানের আশেপাশে যেখানে বড় জায়গা রয়েছে সেখানে অন্য ধরনের গাছ লাগানো হয়েছে। আমরা চেরি, বেলি, রংগম প্রভৃতি গাছ লাগাতে পারি যেখানে রাস্তার পাশে একটু বেশি জায়গা আছে। অবশ্য আমি সাধারণ মানুষ। যারা নগর সুন্দর রাখার দায়িত্বে আছেন, তাদের কত বুদ্ধি কত অভিজ্ঞতা! তাই আশা করবো আমার ধৃষ্টতায় ক্ষিপ্ত হবে না কেউ। একজন দেশপ্রেমিক মানুষ হিসেবে বাংলাদেশকে সুন্দর দেখা অনেকের মত আমারও আকাঙ্ক্ষা। পদ্মা সেতুর উদ্বোধন আমাদের বাসনাকে আরও বর্ধিত করে দিয়েছে।
বাংলাদেশের মত উন্নয়নশীল দেশে সবচেয়ে বড় সমস্যা প্রতি বছর বন্যায় বিভিন্ন জেলা ও অঞ্চল বন্যার পানিতে তলিয়ে জনসাধারণের শান্তিপূর্ণ জীবনকে অসহ্য কষ্টে ভরিয়ে দেয়। এর নিরসন কবে হবে? চট্টগ্রাম জেলার বড় দুর্গতি জলাবদ্ধতা। প্রতি বছর বর্ষায় মানুষের কষ্টের সীমা থাকে না। তবে আশা করছি চট্টগ্রামের সমস্যার সমাধান একদিন হবে। তবে কবে হবে তা জানার জন্য জনগণের আগ্রহ আজ আর নেই। কারণ ‘বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে’?
লেখক : প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক; অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, মহিলা কলেজ-চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদেশ হতে দেশান্তরে
পরবর্তী নিবন্ধকোন্‌ পথে এগুচ্ছি আমরা? কোথায় গিয়ে ঠেকছে আমাদের মূল্যবোধ?