কোন্‌ পথে এগুচ্ছি আমরা? কোথায় গিয়ে ঠেকছে আমাদের মূল্যবোধ?

ববি বড়ুয়া | রবিবার , ৩ জুলাই, ২০২২ at ৪:৫৪ পূর্বাহ্ণ

ছেলেবেলায় একটি রচনা শিখেছিলাম ‘নৈতিক মূল্যবোধ’। আর রচনাটি খুব গুরুত্বপূর্ণ হওয়ায় অর্থাৎ পরীক্ষার প্রশ্নে বারবার আসার কারণে চাপের মুখে শিখতে হতো। হয়তো আমাদের শিক্ষকেরা এই বিষয়ে শিক্ষা দেয়ার লক্ষ্যেই এই রচনায় গুরুত্ব দিতেন বেশি। কিছু লাইন এখনো কানে বাজে। ‘সমাজের বুকে তিল তিল করে গড়ে ওঠা নৈতিক আদর্শ পালনের মধ্য দিয়ে মানব চরিত্র ঠিক ভুল, উচিত অনুচিত সম্পর্কিত যে বোধ তৈরি হয় তাকেই মূল্যবোধ বলে। নৈতিক আদর্শের সুষ্ঠু অনুশীলন ছাড়া এই মূল্যবোধ গড়ে উঠতে পারে না। অর্থাৎ মূল্যবোধ হল কতগুলো মনোভাবের সমন্বয়ে গঠিত অপেক্ষাকৃত স্থায়ী বিশ্বাস। আর যে শিক্ষার মাধ্যমে সমাজে প্রচলিত রীতিনীতি, প্রথা, আদর্শ ইত্যাদির বিকাশ ঘটে তাই হল মূল্যবোধ শিক্ষা। মূল্যবোধ হল সমাজ ও রাষ্ট্রের ভিত্তি।’
তখন রচনাটি বারবার মুখস্থ করেছি ঠিক। আদৌ এর মর্মার্থ উপলব্ধি কতটা করতে পেরেছিলাম জানা নেই। তবে বয়সের এইসময়টিতে এসে মূল্যবোধের অবক্ষয় কিংবা বারবার মূল্যবোধের শরীরে আঘাত হানতে দেখেই উপলব্ধির জায়গাটি আরোও বেশি স্পর্শকাতর হয়ে উঠছে। ইচ্ছে হচ্ছে আবারও রচনার পাতাটি আরেকবার উল্টিয়ে দেখি কী লেখা ছিল তাতে। আমরা যা পড়েছিলাম বা আত্মস্থ করেছিলাম তার সাথে বর্তমান প্রেক্ষাপটের হিসাব মেলানো যায় কিনা।
একের পর এক অঘটন ঘটছে। এই বিষয়ে লিখতে বা ভাবতেই বুক কেঁপে ওঠে। বারবার বুকের মাঝখানটায় টান পোড়ন হচ্ছে এই ভেবে; সভ্যতার কোন পথে হাঁটছি আমরা? আমাদের আগামী প্রজন্ম কোন পথে এগুচ্ছে? আজ শঙ্কিত, দ্বিধাগ্রস্ত আমাদের মন। আমরা আমাদের পরিবার হতে শিখেছি মাতাপিতার পর শিক্ষকের স্থান। আমরাও তা বিশ্বাস করেই এতোটা পথ পাড়ি দিয়েছি। অন্যায় করলে কিংবা অনৈতিক কাজ করলে এমনকি পড়া না শিখলেও শিক্ষকের কতো বকা, চড়, থাপ্পড় কিংবা বেত্রাঘাত খেয়েছি। তা পরিবারে জানালে উল্টো কপালে জুটেছে পিতা মাতার শাসন প্রহার। আমরাও একটি সময় বুঝে গিয়েছিলাম, শিক্ষকই আমাদের জীবনের এমন এক অনন্য গুরুত্বপূর্ণ সদস্য, তিনি যাই করবেন বা বলবেন তা আমাদের মঙ্গলের জন্য করবেন। এর বাইরে আর কিছুই হতে পারে না। কিন্তু এখন? কী হচ্ছে এসব? শিক্ষক শিক্ষার্থীর হাতে হেনস্থা হচ্ছে। যার জন্য নেই কোনো অনুতাপ, নেই কোন অনুশোচনা। একজন শিক্ষক হয়ে আজ বড় লজ্জিত, একাকী, পরাজিত বোধ হচ্ছে। ছেলেবেলা থেকেই উদার, উন্নত চেতনার শিক্ষকের সংস্পর্শে এসে শিক্ষকতা পেশাকে আদর্শ পেশা মেনে, শিক্ষকতা পেশাকে অধিক সম্মানের জায়গায় রেখে, হাজার স্বপ্ন বুকে লালন করে, সেই পেশায় নিযুক্ত হয়েকাজ করে যাচ্ছি একটি সুশীল, আদর্শ সমাজ গড়বো বলে। একের পর এক খবর আজ সেই সিদ্ধান্তকে কিংবা জেনে আসা সম্পূর্ণ বিষয়টিকে ভুল জানান দিতে চাইছে।
ভাবা যায় না কিভাবে একজন শিক্ষার্থী শিক্ষকের অপমানের কিংবা হত্যার কারণ হয়। বাকরুদ্ধ বিবেক থেকে আজ নিন্দা জানানোরও ভাষা নেই। ক’দিন আগেই নড়াইল মীর্জাপুর ডিগ্রী কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস। মহোদয়ের কাছে কয়েকজন ছাত্র ও স্থানীয় লোকজন দিয়ে উত্তেজিত কন্ঠে বলে, ‘আপনার কলেজের হিন্দু ছাত্র রাহুল, আমাদের ধর্মের অবমাননা করেছে; সে নূপুর শর্মার পক্ষে ফেসবুকে পোস্ট দিয়েছে।’ অধ্যক্ষ মহোদয় সঙ্গে সঙ্গে থানায় ফোন করেন। ব্যস এটুকুই। এলাকায় রটিয়ে দেওয়া হয়, অধ্যক্ষ স্বপন কুমার বিশ্বাস রাহুলের পক্ষ নিয়েছেন। হিন্দু শিক্ষকগণের মোটরসাইকেল পোড়ানোর মধ্য দিয়ে শুরু হয়ে যায় ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগসহ নারকীয় তাণ্ডবলীলা। শত শত মানুষের সামনে স্যারের গলায় পরিয়ে দেওয়া হলো জুতার মালা। যা ঘটেছে গ্রামের চেয়ারম্যানের সহযোগিতায় পুলিশ প্রশাসনের সামনে। এইআইন বাংলাদেশের প্রশাসন কোন সংবিধানে পেয়েছে তা আমার জানা নেই। কোন্‌ আইনের ভিত্তিতে পুলিশ কর্মকর্তারা এইবিচার নির্ধারণ করেছেন?
এই ঘটনায় আমাদের বিবেক সম্বিত ফিরে পাওয়ার আগেই ঘটলো আরেকটি লজ্জাষ্কর ঘটনা। আশুলিয়ার চিত্রশাইল এলাকারহাজী ইউনুস আলী স্কুল অ্যান্ড কলেজের প্রভাষক এবং প্রতিষ্ঠানটির শৃঙ্খলা কমিটির চেয়ারম্যান উৎপল কুমার সরকারকে ক্রিকেট স্ট্যাস্প দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করেছে সেই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র আশরাফুল ইসলাম জিতু। তার পরিবার অত্র এলাকায় রাজনৈতিকভাবে প্রভাব ও প্রতিপত্তিশালী। তাদের পারিবারিক সদস্য যুক্ত ওই কলেজ পরিচালনা কমিটিতে। সে নিজেও এলাকার একটি কিশোর গ্যাং এর নেতৃত্ব দেয়। ছাত্রের হাতে শিক্ষক খুন, ছাত্র নামধারীদের হাতে শিক্ষকের গলায় জুতার মালা! কোথায় যাচ্ছে প্রিয় স্বদেশ? আগামী প্রজন্মকে কোন মূল্যবোধে গড়ে তুলছি?
শিক্ষককে হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে পদে পদে। মাত্র ক’মাস হলো বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ড. লতা সমাদ্দার কেন টিপ পরেছেন, এই নিয়ে এক পুলিশ সদস্যের অবমাননাকর আচরণ যা জাতির বিবেককে নাড়া দিয়েছে। আবার মুন্সীগঞ্জের বিজ্ঞানের শিক্ষক হৃদয় মণ্ডল, যিনি ধর্ম ও বিজ্ঞান বিষয় দুটোর উপজীব্য কী, তা বোঝাতে গিয়ে পূর্ব পরিকল্পিত যোগসাজশে কারাগারে যেতে হয়েছে। শিক্ষার্থী ও স্কুল কর্তৃপক্ষের করা মামলায় এই শিক্ষককে কারাগারের পাঠিয়ে দেশকে, দেশের আইন কিংবা আমাদের সংবিধানের চার মূলনীতির জাতীয়তাবাদকে করেছে প্রশ্নবিদ্ধ ।
দেশের আইনশৃংখলা, প্রশাসন, সংবিধান সব যেন আজ কেমন ধূসর মরূদ্যান, নিছক আলেয়ার লুকোচুরি খেলা। উৎপলকুমার সরকার, স্বপন কুমার বিশ্বাস, হৃদয় মন্ডল, শ্যামল কান্তি, উন্মেষ রায়, সঞ্জয় সরকার, লতা সমদ্দার। একেবারে প্রথম জন ছাত্রের এলোপাতাড়ি স্টাম্পের আঘাতে নিহত হয়েছেন। বাকীদের কারো গলায় জুতার মালা, কেউ কানধরে উঠবস আবার কেউ জেল খেটেছেন বা খেটে চলেছেন, আবার নারী শিক্ষক লতা সমদ্দার প্রশাসন কর্মকর্তার হাতেই সরাসরি লাঞ্ছনার শিকার। অদ্ভুতভাবে নামগুলোর মধ্যে একটা মিল রয়েছে। যদিও এখন এটাকে একতরফা সামপ্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়ানোকে একমাত্র দায়ী করছি না। একই সাথে করছি আমাদের প্রজন্মের পারিবারিক শিক্ষার অভাব ও দেশের সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের মধ্য দিয়ে নিষ্ঠুর, দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামোকে।
আমাদের জননেতা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ, এগিয়ে যাচ্ছে মানুষের জীবনাচরণ। একের পর এক সফলতা বিশ্বের বুকে লাগাচ্ছে তাক। আজ সারাবিশ্ব দেখছে বাংলাদেশের স্বমহিমায় সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া। কিন্তু এতো সফলতা এমন ঘটনায় ম্রিয়মান হচ্ছে। যখন যতবার ‘শিক্ষক’ নামক মানুষ গড়ার কারিগর লাঞ্ছিত হচ্ছে, হেনস্থার শিকার হচ্ছে ততোবারই পরাজিত হচ্ছে বাংলাদেশ।
অত্যন্ত ন্যক্কারজনক এবং ঘৃণিত অপরাধের ক্ষমা হতে পারে না, হওয়া উচিত না। অনতিবিলম্বে হত্যাকারীকে এবং হেনস্থাকারীকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় এনে মূল্যবোধের অবক্ষয় থেকে দেশকে বাঁচাতে হবে। এই ঘৃণিত দুঃসাহসিক কাজ আর যাতে না ঘটে তার জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ এখনই এই ক্যান্সার ব্যাধির প্রতিকারে এর যথাযোগ্য আইনানুগব্যবস্থা নিতে হবে। যাতে শিক্ষার্থীদের এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণের মধ্য দিয়ে চরিত্রের অধঃপতন না হতে পারে। শিক্ষকদের মর্যাদার আসন পর্বতসম হোক। তা না হলে দেশের সকল অর্জনের গৌরব নিন্দায় পর্যবসিত হবে।
একজন শিক্ষক হিসেবে একই সাথে একজন মা হিসেবে আগামী প্রজন্মের অধঃপতনের কথা চিন্তা মাথায় এনে এমন মর্মবেদনা, উৎকন্ঠা, অসন্তুষ্টি আর হৃদয় প্রকম্পিত অস্থিরতা থেকে মুক্তি চাই। আদর্শ প্রজন্ম পাওয়ার মধ্য দিয়ে একটি সুস্থ সবল সমাজ, দেশ ও জাতি পেতে চাই।
লেখক : প্রাবন্ধিক; অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ওমরগণি এমইএস কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধআমার দেশ আমার শহর
পরবর্তী নিবন্ধএশিয়ান আবাসিক স্কুলের ফুটবল টুর্নামেন্টে কর্ণফুলী দল চ্যাম্পিয়ন