আমার দেশ আমার শহর

এলিজাবেথ আরিফা মুবাশশিরা | বুধবার , ২৭ অক্টোবর, ২০২১ at ৬:৩৮ পূর্বাহ্ণ

লাল সবুজের পতাকা হাতে উন্নতির পথে এগিয়ে যাবো ঐক্যবদ্ধভাবে

১৯৪৭ সালের পূর্বে ভারত, বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান প্রচীনকাল থেকে একটি বিশাল ভূখন্ড ছিল যা ইতিহাসে ভারতবর্ষ নামে পরিচিত। রাজা দুষ্মন্ত এবং রাণী শকুন্তলার পুত্র সম্রাট ভারত সমগ্র ভরত জয় করেছিলেন। তাই তার নামানুসারে ভারতবর্ষ নামকরণ করা হয়। তাঁর বংশধর ছিলেন পান্ডবরা। ভারতবর্ষ হিন্দু সম্প্রদায়ের বাসস্থান ছিল। যুগে যুগে তারা ভারতবর্ষে বাস করতেন ও পূজা অর্চনা করতেন। ভারতের সুনাম এক সময় সমগ্র পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়ে। কারণ ভারতবর্ষে ছিল মূল্যবান পাথরের খনি ও দারচিনি, লবঙ্গ প্রভৃতি গরম মশলার উৎপত্তিস্থল। পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার সূর্যালোকে সমৃদ্ধ ধান, গম, পাটের আধিক্য, বুড়িগঙ্গা নদীতীরের মসলিন, ভারতের কাশ্মিরি শাল ইত্যাদি জগৎ বিখ্যাত ছিল। তাই পর্তুগীজ, ফরাসী, গুলন্দাজ, আরবীয়, ইংরেজ প্রভৃতি দেশের জনগণ বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে অথবা ভারতবর্ষ দখলের লক্ষ্যে বার বার ভারতবর্ষে গভীর লোভ-লালসার সাথে আগমন শুরু করে। কলম্বাস ভারতবর্ষে আসতে চেয়েছিলেন জলপথে কিন্তু পৌঁছে গিয়েছিলেন আমেরিকায়। ১৪৯২ খ্রীষ্টব্দে পুর্তগালের ভাস্কো ডা গামার ভারত আগমনের জলপথ আবিস্কারের পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষ ব্যবসা বাণিজ্যকে কেন্দ্র করে ভারতে আগমন করে। ইংরেজরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির নামে বাণিজ্য করতে এসে কৌশলে মীরজাফরের বিশ্বাসঘাতকতার সুযোগে বাংলা, বিহার ও উড়িষ্যার নবাব সিরাজদ্দৌলাকে পরাজিত করে ভারতবর্ষের শাসন পত্তন করে।
প্রাচীনকালে হিন্দু রাজাগণ ভারতবর্ষ শাসন করতেন। মুসলমান তখন ছিল না। ৭০০ খ্রিস্টাব্দে মুহম্মদ বিন কাসিম সিন্ধ্‌ প্রদেশ দখল করেন। ১২০৬ থেকে ১৫২৬ পর্যন্ত তুর্কি এবং আফগান বংশ ভারতের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের রাজাদের পরাজিত করে দিল্লি দখল করেন। খিলজি, তুঘলক, সৈয়দ, লোদী, কুতবুদ্দিন আইবেক প্রভৃতি এবং রাজিয়া সুলতানা দিল্লীর মসনদে বসে ছিলেন। সুলতান ইলতুতমিসের কন্যা রাজিয়া সুলতানা (১২৩৬-১২৪০) ভারতবর্ষের প্রথম মহিলা শাসক ছিলেন। তিনি তার সাম্রাজ্যে শান্তি শৃংখলা বজায় রেখেছিলেন। তিনি নারীর পোশাক পরিত্যাগ করে পুরুষের পোশাক পরে প্রশাসন ও যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হতেন। স্বভারত নারী শাসক পুরুষ প্রজাদের পছন্দ হয় নি। ১২৪০ সালে তাঁকে খাদ্যে বিষ মিশিয়ে হত্যা করা হয়।২০১৭ সালে আফগানিস্তানের ইখতিয়ার উদ্দিন বখতিয়ার খিলজি বাংলাদেশের দখল করেন।
দিল্লির সুলতানদের আমলে ভারতীয় সভ্যতার সাথে ইসলামী সভ্যতার মিশ্রণ ঘটেছিল। অনেক সুফি, দরবেশ, আওলিয়া ভারতবর্ষে এসেছিলেন। ফলে সমগ্র ভারতে মুসলমান সম্প্রদায়ের উদ্ভব হয়। ১৫২৬ সালে দিল্লীর সালতানাত মুঘল সাম্রাজ্যের কাছে পরাজিত হয়। ১৫২৬ সালে পানি পথের যুদ্ধে বিজয় লাভ করে।
২০১৭ সালে আফগানিস্তানের ইখতিয়ারউদ্দিন মুহাম্মদ বখতিয়ার খিলজি পানি পথের যুদ্ধে বিজয় লাভ করে, জহিরুদ্দিন মুহাম্মদ বাবর দিল্লীর শাসনভার গ্রহণ করেন। ১৪ফেব্রুয়ারি ভ্যালেনটাইন্স ডে’তে তাঁর জন্ম। বর্তমান উজবেকিস্তানের আন্দিজানে তাঁর জন্ম হয়েছিল। ঐতিহাসিকদের মতে সম্রাট বাবর হচ্ছেন প্রথম শাসক যিনি প্রথম আত্নজীবনী লেখেন (বাবর নামা) মোগল আমলে অনেক তুর্কি ও ফারসী শব্দ বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত হতে থাকে। ভাষা, সংগীত, চিত্রকলা, স্থাপত্য পোশাক, খাবার ইত্যাদি প্রতিটি ক্ষেত্রে ভারতীয় সংস্কৃতির সাথে মুসলমানদের সংস্কৃতি মিশে যায়। ভারতবর্ষে হিন্দু ও মুসলমান মিলিতভাবে বসবাস করতে থাকেন। সম্রাট পুত্র বুদ্ধদের রাজ্যত্যাগ করে তপস্যা করে মানুষের শান্তি ও সুখের জন্য বৌদ্ধ ধর্মের সূচনা করেন। খৃস্টান মিশনারিগণ খৃস্টানধর্ম প্রচার করেন। ফলে ভারতবর্ষে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খৃস্টান প্রভুতি বিভিন্ন ধর্মের মানুষ যুগ যুগ ধরে সম্প্রীতি ও ভালবাসার সাথে মিলিতভাবে বসবাস করতে থাকে।
ইংরেজরা ১৭৫৭ সালে বাংলা, বিহার উড়িষ্যা দখল করে ভারতের বিভিন্ন রাজ্য দখল করতে শুরু করে। ঝাঁসির রানী, রাজা টিপু সুলতান ও তীতুমীর প্রভৃতি দেশপ্রেমিক ব্যক্তি বাধা প্রদান করেও ইংরেজদের প্রতিহত করতে পারেন নি। ক্রমে ভারতবর্ষে স্বাধীনতাকামী মানুষ ইংরেজদের শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে ইংল্যান্ডে দারিদ্র, বিক্ষোভ, বেকারত্ব প্রভৃতি দেখা দেয়। তাই যুদ্ধবিধ্বস্ত ইংরেজদের পক্ষে আর ভারতবর্ষে শাসন করা সম্ভব হচ্ছিল না। তখন ইংরেজরা কংগ্রেস ও মুসলিমলীগকে হাতিয়ার করে এদেশের জনগণের মধ্যে বিরোধের সূত্রপাত করে। এর ফলে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে সংঘাত শুরু হয়। ১৯৪৭ সালে প্রচণ্ড দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল। ইতিহাসের সেই কলংকময় অধ্যায় আবার ১৯৭১সালে পাকিস্তানি শাসকদের প্ররোচনায় পাকিস্তানি সৈনিকরা বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত করেছিল। তবুও সম্প্রীতির বাঁধন অটুট ছিল। হিন্দু ও মুসলমান এক হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিল। তারপর আকস্মিক পট পরিবর্তন হলো। ভোট অথবা অকারনে সমস্যা সৃষ্টি করে হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মুসলমান জনগণকে উত্তেজিত করা হয়। এক দল লোভী ও স্বার্থপর ব্যক্তি হিন্দু সম্প্রদায়ের ভিটাবাড়ি ও সম্পদ দখলের জন্য হিন্দু সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে গোপনে কাজ করছে। ফলে অসহায় মানুষগুলো নিজ মাতৃভূমি ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। বিচারের বাণী সবসময়ই নিভৃতে ফাঁদে। সবাই শোনে ও দেখে কিন্তু বিচার হয় না।
শৈশব থেকে দেখেছি আমাদের চারপাশে হিন্দু, বৌদ্ধ, খৃস্টান, আদিবাসী রয়েছে আজ আমরা সবাই বাংলাদেশি। আমার শৈশব ও কৈশোরের বান্ধবী, শিখা, শান্তা, নীভা, শুক্লা, অরুণা, আরোমা কেউ মুসলমান না। কিন্তু আমাদের মধ্যে ধর্মকে কেন্দ্র করে কখনো সদ্ভাব নষ্ট হয় নি। আমরা ঈদ-কুরবানি করেছি। তারা পূজাদাবন করেছে।
চিকিৎসা করতে ভারতে যেতে আপত্তি নেই। ভারতের পিঁয়াজ, আদা, রসুন, টমেটো, আঙ্গুর, কমলা, আপেল খুব ভাল লাগে, ভারতীয় পোশাক পরে সবাই আহ্লাদিত হয়। তবে এদেশে আজও জঘন্য সাম্প্রদায়িকতা কেন?
আমরা ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার শিক্ষক, নাচ গানে শিক্ষক, এমনকি, পারিবারিক চিকিৎসকও হিন্দু সম্প্রদায়ের ছিলেন। মৌলভী সাহেব নামাজ ও পবিত্র কোরান শরীফ পড়া শিখিয়ে ছিলেন। ইস্পাহানি স্কুলের বিজ্ঞানের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ভৌমিক বাবু না পড়ালে আমার ছেলে মেয়েরা বিজ্ঞানের বিষয়ে স্টার মার্কস অথবা এ প্লাস পেতো না। অনিন্দিতা নতুন কুঁড়িতে নাচে পুরস্কার পেয়েছিল। তন্ময়ের সংগীতে তেমন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু গানের শিক্ষক শ্রী অরুণবাবু কল্যাণে পুত্র তন্ময়কে রবীন্দ্র সঙ্গীত, নজরুল সংগীত ও দেশাত্নবোধকে চট্টগ্রাম জেলায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিল। ১৯৯৭ সালে মুজিবের হার্টের বাইপাস অপারেশন হবে, আমি দিশেহারা, সে সময় বাংলাদেশে চিকিৎসার তেমন সুবিধা ছিল না। অনিন্দিতার নাচের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক শ্রী অনিল বাবু (প্রাচ্য ছন্দ গীতিকা প্রতিষ্ঠানে তৎকালীন কর্ণধার) অত্যন্ত সুন্দর করে কাগজে লিখে দিয়েছিলেন আমরা কিভাবে কলকাতায় যাব, সেখান থেকে কিভাবে মাদ্রাজের বিশেষ ট্রেনে মাদ্রাজ যাবো, তারপর ভেলোরে গিয়ে কিভাবে চিকিৎসা করাবো। আমি তাঁর কাছে চিরকৃতজ্ঞ। আমরা মুসলমান সে জন্য চিকিৎসা করাতে কোন অসুবিধা হয় নি।
কাজী নজরুল ইসলামকে আজকাল অনেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চেয়ে বড় বলে প্রমাণ করতে চান অথচ এক সময় মুসলমানরা নজরুল ইসলামকে “কাফের” সম্বোধন করতো। বেগম রোকেয়া মেয়েদের স্কুলে ভর্তি করেছিলেন বলে তাঁকে ভয় দেখানো হতো তিনি দোজখে যাবেন।
যুগে যুগে কিছু মানুষ থাকে যারা মানুষকে শান্তিতে বসবাস করতে দেয় না, আনন্দ করতে দেয় না। যুগে যুগে এরাই যীশু খ্রিস্টকে ক্রুশবিদ্ধ করে, জোয়ান অব আর্ককে আগুনে পোড়ায়, গান্ধীজীকে হত্যা করে, আব্রাহাম লিংকনকে হত্যা করে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করে।
ধর্মকে ধ্বজা করে এক শ্রেণির লোভী স্বার্থপর মানুষ নিরীহ ভাল মানুষকে হত্যা করে আনন্দ লাভ করে অথচ সবাই হযরত মুহাম্মদ (দ:) বিদায় হজ্জের বাণীতে নির্দেশ দিয়েছেন ‘কেউ ধর্ম নিয়ে বাড়াবাতি করবে না’ ইসলাম অর্থ শান্তি। শান্তির ধর্ম, সাম্যের ধর্ম, মৈত্রীর ধর্ম ইসলাম। সব ধর্মের মূল কথা মানুষকে ভালোবাসো তবে স্রষ্টার ভালবাসা ও নৈকট্য লাভ করবে। তবে কেন ধর্মকে হাতিয়ার করে বিদ্বেষ সৃষ্টি, মানুষ মানুষ মারামারি।
আরব লেবানন, সিরিয়া, আমেরিকা ইংল্যান্ডে কি ঘটছে তাতে আমাদের প্রয়োজন নেই। আমরা বাঙালি, আমরা সবাই বাংলাদেশের নাগরিক। মিলেমিশে থাকবো। তবেই তো এক আঁটি লাঠির মত কেউ আমাদের আঘাত করে ভাঙতে পারবে না। আমরা একসাথে মিলে মিশে লাল সবুজের পতাকা হাতে উন্নতির পথে এগিয়ে যাবো ইনশাল্লাহ। যারা দেশের শান্তি ভঙ্গ করে, যারা নিরীহ মানুষের ঘরবাড়ি ধ্বংস করে, যারা নারীর সম্ভ্রম নষ্ট করে, যারা অসহায় মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে, তারা দোজখের পথে পা বাড়ায়। পুলসিরাতের পুল তারা পার হতে পারবে কি?
লেখক : সাহিত্যিক, কলামিস্ট। অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, মহিলা কলেজ চট্টগ্রাম।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদূরের টানে বাহির পানে
পরবর্তী নিবন্ধরাউজানে অস্ত্র ইয়াবাসহ ৫ বহিরাগত গ্রেপ্তার