সংগীতে চট্টগ্রাম

বাসুদেব খাস্তগীর | রবিবার , ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০২১ at ৬:২৮ পূর্বাহ্ণ


‘সংগীতে চট্টগ্রাম’ এ বিষয়ে আলোচনা একটি বিস্তৃত বিষয়। চট্টগ্রাম শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতি চর্চার অন্যতম পাদপীঠ। হাজার বছরের ঐতিহ্যমণ্ডিত এই বীর চট্টলার কতই না কীর্তি। সংগীতে চট্টগ্রাম বিষয়ে আলোচনায় চট্টগ্রামের সংগীত চর্চা বিষয়ে নানা দিকে দৃষ্টি রাখা যায়। একটি সংগীত সৃষ্টিতে রয়েছে নানা মানুষের বিভিন্নমুখী অবদান। প্রত্যেকের অবদানে একটি গান প্রাণ পায় এবং হয়ে ওঠে সর্বজনীন। এখানে গীতিকার, সুরকার, শিল্পী ও সর্বোপরি যন্ত্রশিল্পীদের অবদান। কারো অবদানকে এখানে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। চট্টগ্রামে শিল্পী গীতিকার, সুরকারদের সৃষ্টিতে এমন কিছু গান আছে সে গান গুলো পেয়েছে চির যৌবনের কীর্তি। গানগুলো মানুষের মুখে মুখে ফেরে। চট্টগ্রামের সংগীত চর্চার সাথে জড়িত অনেক শিল্পী কলাকুশলী চট্টগ্রামের সংগীতকে সমৃদ্ধ করেছেন নানা ভাবে। সুদীর্ঘকাল থেকে এই চর্চা অব্যাহত আছে। চট্টগ্রামে আধুনিক গান, রবীন্দ্রসংগীত, নজরুলগীতি, পল্লীগীতি,ফোক গান, দেশের গান, উচ্চাঙ্গ সংগীত,ব্যান্ড সংগীত, চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান ও মাইজভাণ্ডারীর দর্শন চর্চার গান চর্চিত হচ্ছে এবং এ চর্চার সাথে জড়িত আছেন একদল সংস্কৃতি চর্চার নিবেদিত প্রাণকর্মী। বাংলাদেশ বেতার চট্টগ্রাম, বাংলাদেশ টেলিভিশন চট্টগ্রাম কেন্দ্রে এদের উজ্জ্বল উপস্থিতি। চট্টগ্রামের ঘরোয়া পরিবেশে, মঞ্চনাটক, যাত্রাপালা, টিভি নাটক কিংবা চলচ্চিত্রেও এদের অবদান পরিস্ফুট হয়েছে নানাভাবে। সংগীতে চট্টগ্রামের অবদানকে আমরা আধুনিক, নজরুল, রবীন্দ্র, পল্লীগীতি, ব্যান্ড সংগীত,দেশের গান কিংবা উচ্চাঙ্গ সংগীতকে একটি ধারায়, আঞ্চলিক গানকে একটি ধারায় এবং মাইজভাণ্ডারী গানের দর্শকে অন্য একটি ধারায় ব্যাখা করতে পারি। গীত, বাদ্য, নৃত্য এই তিনটি বিষয়ের সমাবেশই সংগীত। সংগীত এক ধরনের শ্রবণযোগ্য কলা যা সুসংবদ্ধ শব্দের সমন্বয়ে মানব চিত্তে বিনোদন সৃষ্টি করতে বা দোলা দিতে পারে। স্বর ও ধ্বনির সমন্বয়ে সংগীতের সৃষ্টি। এই ধ্বনি হতে পারে মানুষের কণ্ঠ নিঃসৃত ধ্বনি, হতে পারে যন্ত্রোৎপাদিত শব্দ অথবা উভয়ের সংমিশ্রণ। কিন্তু সকল ক্ষেত্রে সুর ধ্বনির প্রধান বাহন। সুর ছাড়াও অন্য যে অনুষঙ্গ সঙ্গীতের নিয়ামক তা হলো তাল। অর্থযুক্ত কথাতে যখন, সুর ও তালের সমন্বয় ঘটে তখন সংগীত সৃষ্টি হয়।
চট্টগ্রামের আধুনিক, নজরুল, রবীন্দ্র, পল্লীগীতি ধারার গান, ব্যান্ড সংগীত, দেশের গান ও উচ্চাঙ্গ সংগীত চর্চা- চট্টগ্রামের ইতিহাস পর্যালোচনায় দেখা যায় চট্টগ্রামের বর্তমান সংস্কৃতির উন্মেষ হয় ১৭৯৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তনের পর। চট্টগ্রামের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। ইতিহাসের শুরু থেকে চট্টগ্রামে আরাকানী মঘীদের প্রভাব লক্ষণীয়। ফলে গ্রামীণ সংস্কৃতিতেও এর যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। চট্টগ্রামে অনেক গীতিকার বা গীতিকবি আছেন যারা চট্টগ্রাম তথা দেশের জাতীয় পর্যায়ে পরিচিত। যাঁদের লেখা গান বেতার ও টেলিভিশনে নিয়মিত প্রচারিত হয়। আছেন বেতার টিভির তালিকাভুক্ত গীতিকার। তালিকাভুক্ত গীতিকার ছাড়াও অনেকেই ভালো গান লিখেন, যারা সুযোগ পেলে নিজের অবস্থানকে আরো সুদৃঢ় করতে পারেন। বেতার টিভির এমন কিছু শিল্পী আছেন যারা আবার গীতিকার এবং সুরকারও। অনেকেই আছেন যারা বিভিন্ন ধরনের গান গাওয়ার সাথে সম্পৃক্ত আছেন ।

চট্টগ্রামের বেতার টিভির কিছু স্বনামধন্য গীতিকারের নাম এখানে উল্লেখ করতে পারি যারা আধুনিক শ্রেণির গান রচনার কুশলী গীতিকার। যেমন- মোহনলাল দাশ,ময়ূখ চৌধুরী, আবদুল গফুর হালী, এম এন আকতার, এয়াকুব সৈয়দ, মুহাম্মদ ইকবাল চৌধুরী, সালমা চৌধুরী, লিয়াকত হোসেন খোকন, জিকে দত্ত, ডা.গোলাম মোস্তফা, সৈয়দ খালেদুল আনোয়ার,মোমিনুল হক চিশতী, শেখ খুরশিদ আনোয়ার, খোদেজা খুরশিদ অপরাজিতা,পংকজ দেব অপু, আনিস আহমেদ বাচ্চু,ফারুক হাসান,দীপক আচার্য, অপু বড়ুয়া, ডা. প্রণব কুমার চৌধুরী,জসিম উদ্দিন খান, বাসুদেব খাস্তগীর, মোহাম্মদ ওবাদুল্লাহ,ইসমাইল মানিক, শফি সুমন, সুমন চৌধুরী বিকু,এস এম ফরিদুল হক, আবছার উদ্দিন অলি সুরজিত রাহা দাসু, দুদু চৌধুরী, মোহাম্মদ হুমায়ুন চৌধুরী, শাহীন আকতার, নুরুন্নবী রাজু, মোহাম্মদ শাহাবউদ্দীন, ড.আহমেদ মাওলা, খোরশেদুল আনোয়ার, জহুরুল ইসলাম, সৈয়দ মহিউদ্দিন, কোহিনূর সাকী, অনামিকা তালুকদার, তসলিমউদ্দিন আহমেদ, সুজন কুমার মজুমদার, ফরিদ বঙ্গবাসী, ইফতেকার সাদী, আবছার আহমেদচৌধুরী,মাহাবুবুল আলম বাবলু, মহসিন ভূঁইয়া,রেখা নাজনীন, মরিয়ম রহমান,ইমতিয়াজ ইকরাম,সনজিত আচার্য, কল্পতরু ভট্টচার্য,এম এ হাশেম, চৌধুরী সিরাজুল ইসলাম,মৌসুমী সেন, রফিক রহমান ভূঁইয়া,এ কে এম জয়নাল আবেদীন, উত্তম কুমার আচার্য, সঞ্জীত আচার্য, দিলীপ ভারতী, রুমি চৌধুরী, রত্না বণিক,তাপস আচার্য প্রমুখ।

চট্টগ্রামের সুপ্রতিষ্ঠিত কিছু আধুনিক গানের শিল্পী যাদের অনেকের দেশ জুড়ে পরিচিতি রয়েছে। যেমন- প্রবাল চৌধুরী, উত্তম কুমার দত্ত, আবদুল মান্নান রানা, সুজিত রায়,তপন চৌধুরী, কুমার বিশ্বজিৎ,উমা ইসলাম, বীণাপানি চক্রবত্তী, সৈকত দাস,রবি চৌধুরী, আতিক হাসান,সমরজিৎ চৌধুরী, পার্থ বড়ুয়া,সন্দিপন রায়, মোস্তফা কামাল,ফজলুল কবির চৌধুরী, আলমগীর আলাউদ্দীন,সাইফুদ্দিন মাহমুদ খান, আলাউদ্দীন তাহের, রাহগীর মাহমুদ,শাহারিয়ার খালেদ,কায়সারুল আলম, অনামিকা তালুকদার, শুভ্রা চৌধূরী, আবুল কাশেম, তাপস চৌধুরী , রঞ্জন চৌধুরী, কেপিদাশ বাবু, সুতপা চৌধুরী মুমু ,পলি শারমিন, পাপিয়া আহমেদ, আর কে চক্রবর্তী জুয়েল, ফাহমিদা রহমান, ত্রিদিব বড়ুয়া রানা, তন্বী দত্ত,জয়শ্রী ধর, তন্বী বড়ুয়া, নকীব খান, কিশোর দাশ,সাব্বির আহম্মদ,রন্টিদাশ,নিশিথা বড়ুয়া,শুভ দাশ,মো রাশেদ প্রমুখ, রুনা পারভীন, আলেয়া আরিফ, আকলিমা আক্তার মুক্তা,হৈমন্তী রক্ষিত মান, মৌমিতা বড়ুয়া প্রমুখ।
চট্টগ্রামের পল্লীগীতির শিল্পী- মো নাসির, মানস পাল চৌধুরী, শংকর দে, গিরিজা রাজবর, ইকবাল হায়দার, সুবর্ণা রহমান, আবদুল হালিম,মোঃ হারুন, নিতাই চন্দ্র রায়, কল্পনা লালা,সুপর্ণা রায় চৌধুরী,আবদুর রহিম, মোখলেছুর রহমান, রতন কুমার সরকার, চন্দ্র প্রকাশ বড়ুয়া, কংসরাজ দত্ত, মোঃ আবুল কাশেম, মোঃ ফরিদ বঙ্গবাসী, কাকলী দাশগুপ্তা, মোঃ হোসেন, সৃজন কান্তি পাল প্রমুখ পল্লীগীতির শিল্পী হিসাবে যথেষ্ট খ্যাতিমান।
চট্টগ্রামের সুরকার ও সংগীতজ্ঞ- সত্য সাহা, নিরোদ বরণ বড়ুয়া, অমিতাভ বড়ুয়া, জগদানন্দ বড়ুয়া,মনোরঞ্জন বড়ুয়া,আবু নঈম, স্বর্ণময় চক্রবর্তী, মিহির লালা, মিহির নন্দী, জালাল আহমেদ, আনোয়ার মুফতি,সৈয়দ নুরুল ইসলাম মুফতি,বাণী কুমার চৌধুরী, আবু তাহের চিশতী, নির্মল বৈদ্য, স্বপন কুমার কুমার দাশ, অশোক সেনগুপ্ত, নির্মলেন্দু চৌধুরী, অশ্রু বড়ুয়া রূপক, প্রকাশ চন্দ্র শীল, প্রকাশ কান্তি বড়ুয়া,মিলন আর্চায,মাহমুদ হোসেন প্রমুখের নাম চট্টগ্রামের সুরকার ও সংগীতজ্ঞ হিসাবে উজ্জ্বল।
চট্টগ্রাম বেতারে উচ্চাঙ্গ সংগীত চর্চার শিল্পী হিসাবে – মিতালী রায়,শম্পা ভট্টচার্য, রাজেস সাহা,প্রকাশ কান্তি বড়ুযা, অসীম চৌধুরী প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়।
দেশ জুড়ে সাড়া জাগানো এমন কিছু আধুনিক গান আছে যা চট্টগ্রামের শিল্পীদের গাওয়া গান এই গুলো সেই শিল্পীদের মৌলিক গান। অর্থাৎ এই গানগুলো দিয়িেই আমরা শিল্পীকে চিনে নিতে পারি। যেমন-প্রবাল চৌধুরী কণ্ঠে ‘লোকে যদি মন্দ কয়’ ‘,আমি ধন্য হয়েছি ওগো ধন্য’,আবদুল মান্নান রানার কণ্ঠে ‘যেখানেই যাও সুখে থেকো’ কুমার বিশ্বজিতের কণ্ঠে ‘তোরে পুতুলের মত করে সাজিয়ে’, ‘সংসার সুখের হয় রমনীর গুণে’,‘যেখানে সীমান্ত তোমার’ তপন চৌধুরীর কণ্ঠে ‘পলাশ ফুটছে শিমুল ফুটেছে’ কিংবা আকাশের সব তারা ঝরে যাবে’ গানগুলোসহ আরো অনেক শিল্পীর অনেক গান এখানে উল্লেখ করা যায়। আবার কিছু গানের গীতিকার বা শিল্পী চট্টগ্রামের কিন্তু গেয়েছেন বাইরের শিল্পী তার খ্যাতি দেশে বিদেশেও। যেমন- তেমন কিছু উল্লেখযোগ্য গানের কথা-পাকিস্তানের গজল শিল্পী মেহেদী হাসানের কণ্ঠে ‘হারানো দিনের কথা মনে পড়ে যায় ’গানটির কথা মোহন লাল দাশের, এম এন আকতারের লেখা ‘মধুমিতা’ চলচ্চিত্রের গান ‘তুমি যে আমার জীবনের উপহার কী করে তোমায় আমি ভুলবো, বিখ্যাত গানটি গেয়েছিলেন শেফালী ঘোষ।
চট্টগ্রামে রবীন্দ্র সংগীত চর্চা- চট্টগ্রামে রবীন্দ্র সংগীতের চর্চা সেই সুদীর্ঘ কাল থেকেই। নানা প্রতিকূলতার মধ্য দিয়ে রবীন্দ্র সংগীত চর্চা এগিয়েছে আপন মহিমায়। কোন বাধাই চট্টগ্রামের রবীন্দ্র সংগীত চর্চাকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে নি। ১৯০৭ সালে রবীন্দ্রনাথ প্রথম চট্টগ্রাম আসেন এবং পরবর্তীতে আসেন ১৯১৩ সালে। রবীন্দ্রনাথের চট্টগ্রামে আসার মধ্য দিয়ে এ অঞ্চলের রবীন্দ্র প্রেমী মানুষের সাথে সংস্কৃতির এক ধরনের ভাবধারা বিনিময় হয়। কিন্তু ঊনিশ শতকের শেষার্ধে সমাজসেবী যাত্রামোহন সেনের উদ্যোগে চট্টগ্রামে প্রথম রবীন্দ্র সঙ্গীত চর্চা শুরু হয়। প্রথমে ব্রাহ্ম সমাজে রবীন্দ্র কেন্দ্রীভূত থাকলেও পরবর্তীতে ঠাকুর বাড়ির সাথে পরিচয় সুত্রে রবীন্দ্র চর্চা রাউজানের নোয়াপাড়ার কবি নবীন চন্দ্র সেন এবং রায় পরিবার, পটিয়ার রায় বাহাদুর, যামিনী কান্ত সেন, কেদার নাথ দাশগুপ্ত, শরৎ চন্দ্র দাস, ব্যারিস্টার পূর্ণচন্দ্র সেন, কমলকৃষ্ণ সেন, ব্রজকুমার সেন এই সকল পরিবারে ছড়িয়ে পড়ে। ভারতীয় গণনাট্য সংঘের শিল্পী ও খ্যাতিমান রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী কলিম শরাফী ১৯৫০ সালের দিকে চট্টগ্রামে বসবাসের জন্য আসলে সেই সময় গণসঙ্গীত ও রবীন্দ্র সঙ্গীত চর্চা পায় নূতন মাত্রা। বাঙালি সংস্কৃতির ওপর স্বৈরাচারী আক্রমণ ও বৈরী মনোভাব প্রকাশের প্রতিবাদ স্বরূপ চট্টগ্রামে উদ্‌্‌যাপিত হয় সপ্তাহব্যাপী রবীন্দ্র জন্মশত বার্ষিকী’ সেন্ট প্লাসিডস স্কুল প্রাঙ্গণে। এ সঙ্গীত শুধু এ অঞ্চলে নয় বিশ্বের মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হয়।
চট্টগ্রামের নজরুল সংগীত চর্চা– নজরুল আমাদের শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির অন্যতম প্রাণপুরুষ। গানের বৈচিত্র এবং বাঙালির সর্বক্ষেত্রে বিষয় ভিত্তিক গান রচনায় এককক সঙ্গীত প্রতিভা কবি কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুল সংগীত চর্চায় সমৃদ্ধ চট্টগ্রাম। কাজী নজরুল ইসলাম ১৯২৬, ১৯২৯, ১৯৩২ সালে রাজনৈতিক কাজ ও সাহিত্য সম্মেলনে যোগদানের উদ্দেশে তিন বার চট্টগ্রামে আসেন। তাঁর এই আগমন বরাবরই এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলে নতুন এক প্রেরণা যুগিয়েছে। প্রতিটি সভায় নজরুল নিজের গান করেছেন নিজে। তাঁর আগমনে এই অঞ্চলের কবি শিল্পী, সাহিত্যিক ও সুরকার ও গীতিকাররা ঋদ্ধ হয়েছেন নানাভাবে। চট্টগ্রামে ১৯৬০ সালে ওয়াজিউল্লাহ ইনস্টিটিউটে নজরুল হীরক জয়ন্তী উদযাপন করা হয়। চট্টগ্রামে নজরুল চর্চা এক সময় ছিল গ্রামোফোনমুখী। বেতারে গাওয়ার শিল্পীও তখন তৈরি হয়েছে ধীরে ধীরে। চট্টগ্রামে আর্য্য সঙ্গীত এ নজরুল বিভাগ খোলার মাধ্যমে নজরুল সংগীত চর্চা ব্যাপকতা লাভ করে। এইভাবে নজরুল প্রভাবিত করেছেন চট্টগ্রামের সংস্কৃতি অঙ্গনকে এবং এগিয়ে গেছে নজরুল চর্চা। তাঁর রচনার ‘সিন্ধুহিন্দোল’ এবং ‘চক্রবাক’ এ চট্টগ্রাম এর কর্ণফুলী, সীতাকুণ্ডুর পাহাড়ী ঝর্ণা, ফতেয়াবাদ, রাউজান, সন্দ্বীপ, পার্বত্য চট্টগ্রাম এর স্মৃতি বিজড়িত অনেক স্মৃতিই নানাভাবে ফুটে উঠেছে।
চট্টগ্রামের ব্যান্ড সংগীত চর্চা- চট্টগ্রামের ব্যান্ড দলগুলোর সফলতা যেমন আছে তেমনি ব্যর্থতাও আছে। তবুও আমরা এখনও ব্যান্ড সংগীতের চিরায়ত ঐতিহ্য ধরে রাখতে পেরেছে বলে মনে হয়। ব্যান্ড সংগীতে চট্টগ্রামের যে সুনাম সুখ্যাতি সর্বজনবিদিত। ব্যান্ড নানা পথ পরিক্রমায় এখনও আপন মহিমায় উজ্জ্বল। জনপ্রিয় ব্যান্ড সোলস, এল আর বি, রেঁনেসা, নগরবাউল এর জন্ম চট্টগ্রাম থেকেই। আইয়ুব বাচ্চু, কুমার বিশ্বজিৎ, রবি চৌধুরী, নকীব খান, পার্থ বডুয়া, সন্দীপন, নাসিম আলী খান, মিলা ইসলাম চট্টগ্রামের সন্তান। ৪৫ বছরের বেশি সময় ধরে চট্টগ্রামে ব্যান্ড সংগীতের গোড়াপত্তন হয়। বাংলাদেশের সেরা দলগুলোর বেশিরভাগই চট্টগ্রামে সৃষ্টি। তাদের কেউ না কেউ এখনো বীরদর্পে তাদের সৃজনশীলতা’কে দর্শক শ্রোতাদের পৌঁছে দিচ্ছে। এছাড়াও চট্টগ্রামের উল্লেখযোগ্য ব্যান্ডগুলো হলো- অন্থিম, অন্বেষণ, আমুস, এ্যামিথিউর, এ-৯৯ বি.হর্নেট, অরণ্য, আর্তনাদ, বিন্দু, ব্লাক হার্ট, বর্ণ, ব্ল্যাক ওয়ারিয়র্স, ব্লু বার্ডস, ব্লাক সিন, বিস্বর্গ, বনসাই, কেকটাস, কেসকাড, নেঙাস, ড্রীমস, দ্রাঘিমা, দিশারী, ডিবাইন, তেপান্তর, ডেজার্ট, ইস্কপ, আর্থ, এনার্জি সোল, ফেরারী, ফেইথ, প্রিডম, জিপসী, হেভেন, সোলডার্স, হার্ট রিলেশান, ইন চিটাগাং, জোবিয়াল, ওয়্যারফেয়ার, সিক্রোসেন্ট,স্টীলার,এলএসবি, লাইনার্স, মুখোশ, মেনগ্রোব, নভেম্বর-১১, অব ট্রাক, তৃর্ষ্ণাত, অসময়, প্লেজার রক, প্রান্তর, রিভার্ব, রিসেন্ট, রোজেস, স্পাইডার, টানট্রিক, তিরন্দাজ, টিউন স্পার্ক, দ্বিতীয় পৃষ্ঠা, সাসটেইন, স্ট্রীম, সোয়েভ, সরগম, স্লাক, স্যাডো, স্কাই টাচ, সীমান্তহীন, রুটস, রাইজিং ফোর্স, রেইনড্রপস, রিয়ার, রেইন, রেইন ম্যাকার, মিলেনিয়াম,রেসিটাল, রেবিলিয়াস, ট্রিও, ট্রাংগেল, উইংস, ওয়্যারিওর, উইলস, ওয়াইআরবি, ফিউচার, নাটাই ইত্যাদি। যাদের অনেকরই কার্যক্রম হয়তো তেমনভাবে নেই। চট্টগ্রামে এখন প্রায় একশ কাছাকাছি ব্যান্ড সদস্য আছে। এভাবেই এগিয়েছে চট্টগ্রামের আধুনিক, নজরুল, রবীন্দ্র, পল্লীগীতি ধারার গান, ব্যান্ড সংগীত, দেশের গান ও উচ্চাঙ্গ সংগীত চর্চা।
যন্ত্রসঙ্গীতঃ যন্ত্রসংগীতে চ্‌টগ্রামের অনেকেই আছেন যারা জাতীয় পর্যায়ে অনেক সুনামের সহিত কাজ করছেন। তবলায় দেবু ভট্টাচার্য, মিলন চক্রবর্তী, রাজু চৌধুরী, অভিজিৎ চক্রবর্তী, মিঠু চক্রবর্তী, কী বোর্ডে নকীব খান,রূপতনু শর্মা,বিনোদ রায়,মাসুম,তাপস কান্তি চৌধুরী, পেয়ার, পারকিউশানে, উজ্জ্বল ভট্টাচার্য, মিঠুন দাস, গীটারে দোলন কানুনগো, টুটুল বড়ুয়া দোতরায় নির্মল, এস্রাজে অসিত বিশ্বাস ও বেহালায় শ্যামল দাস প্রমুখের নাম উল্লেখ করা যায়।
এখানে প্রাসঙ্গিকক্রমে চট্টগ্রামের বেশ কিছু শিল্পী সুরকার গীতিকার ও সংগীতজ্ঞের সংগীত বিষয়ক গ্রন্থ প্রকাশের বিষয়টিও উল্লেখ করা যায়। কণ্ঠশিল্পী,প্রাবন্ধিক ও সঙ্গীত গবেষক রওশন আর বিউটি সঙ্গীত শিল্পীর কর্ম ও জীবন নিয়ে ‘সুরের আকাশে শুকতারা’ বই প্রকাশ করেন। ২০১৯ সাল পর্যন্ত বইটির পঞ্চম খণ্ড প্রকাশিত হয়েছে। এছাড়াও সংগীত বিশারদ ওস্তাদ নিরোদ বরণ বড়ুয়ার ‘আরোহ অবরোহ’, সংগীতজ্ঞ স্বপন কুমার দাশের ‘গীতি মাধুরী’ ও চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের বই ‘সাম্পানওয়ালা’, শিল্পী কেশব জিপসীর গীতি আলেখ্যগ্রন্থ ‘কথার ভেলা গানের মেলা’, গীতিকার পংকজ দেব অপুর গানের বই ‘গানগুলি মোর’, গীতিকার খোরশেদুল আনোয়ারের আধুনিক গানের বই ‘এতদিন পরে হলো এভাবে দেখা,ও সীমাহীন সীমানায়,গীতিকার জিকে দত্তের গানের বই ‘ শতাব্দীকে বলে দিও’ ডা. প্রণব কুমার চৌধুরীর গানের বই ‘প্রেমের গান’, শিল্পী ইকবাল হায়দারের লেখা ‘আমার যত রচিত গান’, গীতিকার বাসুদেব খাস্তগীরের স্বরলিপিসহ আধুনিক গানের বই ‘স্মৃতিময় গীতিময়’(সুর ও স্বরলিপি-দিলীপ দাশ) ও স্বরলিপি সহ শিশুতোষ ছড়াগানের বই ‘ছড়ায় ছড়ায় সারেগামা’ ( সুর ও স্বর স্বরলিপি- নির্মল বৈদ্য) বইগুলোর নাম উল্লেখযোগ্য।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান- চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের কথা আসলেই শ্যামসুন্দর বৈষ্ণব আর শেফালী ঘোষের কথা প্রথমেই চলে আসে। দুজনেই আজ প্রয়াত। এই দু’জন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানকে নিয়ে গেছেন খ্যাতির শীর্ষে। খুব ছোট বেলায় টেপ রেকর্ডারে যখন আঞ্চলিক গান শুনতাম, কী এক দারুণ মাদকতায় যেন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনেই যেতাম। শ্যাম-শেফালীর জুটি তখন থেকেই জনপ্রিয় এক জুটির নাম। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী অনেক আগে থেকেই চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের চর্চা। মলয় ঘোষ দস্তিদারের লেখা ‘ছোড ছোড ঢেউ তুলি,লুসাই পাহাড় উড়তুন নামিয়ারে যারগই কর্ণফুলী।’ গানটি এখনো সমান জনপ্রিয়। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে কোরাসে গানটি পরিবেশিত হয় । আর আঞ্চলিক গানের খ্যাতি ও প্রসারের ক্ষেত্রে আবদুল গফুর হালীর নাম চিরস্মরণীয়। আবদুল গফুর হালীর নাম দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও উজ্জ্বল। আঞ্চলিক গান লিখে তিনি খ্যাতি পেয়েছেন। তিনি লিখেছেন এ অঞ্চলের জনপ্রিয় অসংখ্য মাইজভান্ডারী গানও। এক্ষেত্রে চট্টগ্রামের আরেক খ্যাতিমান গীতিকার সৈয়দ মহিউদ্দীন। শ্যাম- শেফালী জুটির অনেক জনপ্রিয় গান আবদুল গফুর হালীর ও সৈয়দ মহিউদ্দীনের লেখা। শ্যাম- শেফালী চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। সিনেমার নায়ক নায়িকাদের মত গানেও যে জনপ্রিয় জুটি হতে পারে শ্যাম -শেফালী তার প্রমাণ। পরবর্তীতে সনজিত আচার্য ও কল্যাণী ঘোষ তাঁদের পরবর্তী জুটি হিসাবে আমাদের সামনে এসেছেন। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান তেমন একটি গান,যার জনপ্রিয়তা আজ দেশ কাল গণ্ডি পেরিয়ে পৃথিবীর অনেক দেশে দেশেও। এমন কিছু জনপ্রিয় গান আছে যা মানুষের মুখে মুখে। বিশদ আলোচনার সীমাবদ্ধতার কারণে গানের কথা এখানে উল্লেখ হয়নি। বেশ কয়েক বছর আগে সিরাজুল ইসলামের আজাদের গাওয়া ‘হেড মাস্টরে তোঁয়ারে তোয়ার’। গানটি তুমুল জনপ্রিয়তা পায়। হাটে ঘাটে মাঠে মানুষের মুখে মুখে ছিলো গানটি। আঞ্চলিক ভাষার দেশের গানও রচিত হয়েছে,আছে চট্টগ্রামের নানা ইতিহাস ঐতিহ্যের দেশপ্রেম মূলক গানও।
মাইজভাণ্ডারী গান-বাংলা সংগীতের একটি ব্যতিক্রমী ধারা – চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গানের পাশাপাশি চট্টগ্রাম থেকে উদ্ভুত আরেক বিশেষ ধারার গানের নাম মাইজভাণ্ডারী গান। জানা যায় মাইজভাণ্ডারী গানের উদ্ভব ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগে। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার মহান ধর্মসাধক হযরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (১৮২৬-১৯০৬) প্রবর্তিত মাইজভাণ্ডারী তরিকার অনুষঙ্গ হিসাবে মাইজভাণ্ডারী গানের প্রচলন। একজন মহান সুফী সাধক ও মাইজভাণ্ডারী তরীকার প্রতিষ্ঠাতা তিনি। আহমদউল্লাহ মাইজভাণ্ডারী নামেই তিনি বহুল পরিচিত। মাইজভাণ্ডারী ধারার অনুসারীদের গাওয়া এক ধরনের মরমী গানই হচ্ছে মাইজভাণ্ডারী গান। মাইভাণ্ডারী গানের এই ক্রমবিকাশমান ধারায় এবং সারা বিশ্বে তার আবেদন ছড়িয়ে দেবার পেছনে তিনজন অন্যতম দিকপালের নাম অগ্রগণ্য। তাঁরা হলেন মওলানা আব্দুল হাদী কাঞ্চনপুরী, কবিয়াল রমেশ শীল ও আব্দুল গফুর হালী। তাঁরা তিনজন মাইজভাণ্ডারী গানের তিন কালের মহান রচয়িতা। মওলানা হাদী কাঞ্চনপুরীকে মাইজভাণ্ডারী গানের উদ্ভাবক বলা যায়। জানা যায় মাওলানা হাদী ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে মাইজভাণ্ডারী গান রচনা করে প্রথম আলোচনায় আসেন। কবিয়াল রমেশ শীল যে ধারার মাইজভাণ্ডারী গানের প্রবক্তা তাঁর সময়কাল বিংশ শতাব্দীর বিশ থেকে ষাটের দশক পর্যন্ত বিস্তৃত। আর আব্দুল গফুর হালী হলেন এই মাইজভাণ্ডারী গানের আধুনিক নবযুগের অন্যতম দিকপাল। যাঁর গান নিয়ে দেশে বিদেশে বহু গবেষণা হয়েছে। ষাটের দশক থেকে আমৃত্যু মাইজভাণ্ডারী গান রচনা, সুরারোপ ও সর্বোপরি গাওয়াতে নিবেদিত ছিলেন গফুর হালী। অবশ্য গাওয়ার চেয়ে মাইজভাণ্ডারী গান রচনা এবং তা প্রচার প্রসারের ক্ষেত্রে তাঁর অবদান চিরস্মরণীয়। মরমী শিল্পী ফিরোজ সাঁইয়ের কণ্ঠে রমেশ শীলের লেখা মাইজভাণ্ডারী গান ‘ইশকুল খুইলাছে রে মওলা ইশকুল খুইলাছে, গাউছুল মাইজভাণ্ডারী ইশকুল খুইলাছে’ মাইজভাণ্ডারী গানের সাড়া জাগানিয়া এক গান। এরপর আবদুল গফুর হালীর লেখায় কল্যাণী ঘোষের কণ্ঠে গাওয়া গান ‘দেখে যারে মাইজভাণ্ডারে হইতাছে নূরের খেলা, ওরে মন বসাইলো প্রেমের মেলা’ আরেক জনপ্রিয় গান। নজরুল ইসলাম সাধকপুরীর লেখা মাইজভাণ্ডারী গান ‘আমার গাউছুল আজম মাইজভাণ্ডারী আয়নার কারিগর, আয়না বানাইয়া দেনা তলবের ভিতর’ গানটিও মাইজভাণ্ডারী গানের এক মাইলফলক। এ গানগুলো বিভিন্ন শিল্পীর কণ্ঠে পরবর্তীতে রেকর্ড হয় এবং এখনো গানগুলো সমান জনপ্রিয়। গীতিকার ও শিল্পী এম এন আখতারের লেখা সাবিনা ইয়াসমিনের কণ্ঠে গাওয়া ‘আমি ঐ গাউছিয়া একটি নামের দিওয়ানা’ গানটির কথাও এখানে উল্লেখ করা যায়। (সংক্ষেপিত)
তথ্যসূত্র: ১। শিল্পী কোষ: চট্টগ্রাম সঙ্গীত রাশেদ রউফ সম্পাদিত
২। হাজার বছরের চট্টগ্রাম। দৈনিক আজাদী বিশেষ সংখ্যা।
৩। চট্টগ্রাম বেতারের স্মৃতিময় দিনগুলো, ফজল হোসেন সম্পাদিত।
৪. কৃতজ্ঞতা-মৃণালিণী চক্রবর্তী, নির্মল বৈদ্য,নিতাই চন্দ্র রায়, কেশব জিপসী, জসিম উদ্দিন খান ও আবছার উদ্দিন অলি।
লেখক : শিশুসাহিত্যিক; প্রাবন্ধিক ; সহকারী অধ্যাপক, বিএমসি কলেজ

পূর্ববর্তী নিবন্ধফিনলে সাউথ সিটি : আগামীর নতুন ঠিকানা
পরবর্তী নিবন্ধঢাবির হল খুলছে ৫ অক্টোবর, আগেই খুলবে গ্রন্থাগার