মুয়িন গীতি

মুয়িন পারভেজ | শনিবার , ৩১ ডিসেম্বর, ২০২২ at ১১:৩৬ পূর্বাহ্ণ


ভণিতা

সাধারণ নিম্নবর্গীয় মানুষদের কথাবার্তায় এমন টানটোন থাক্তেএত বিচিত্র স্বরভঙ্গিমায় মানস-প্রতিফলন্তপ্রমিত বাংলায় তার অনুবাদ অসম্ভবপ্রায়। জনপ্রিয় চাটগাঁইয়া গানগুলোর বেশিরভাগই দক্ষিণ চট্টগ্রামের ভাষায় লেখা; উত্তর চট্টগ্রামের ভাষার সঙ্গে সেগুলোর ধ্বনিগত ও শব্দগত প্রভেদ বিস্তর। তাই উত্তর চট্টগ্রামের ভাষায় লেখা গানে ‘ভ্রম’ সংশোধনে উৎসাহী হন অনেকেই। ভূজপুর থানার ইদিলপুর গ্রামের ভাষার সঙ্গে মেলে না কাছাকাছি গ্রাম পশ্চিম ভূজপুরের ভাষা। একই পাড়ার হিন্দু-মুসলমানের উচ্চারণেও দেখা যায় বিশেষ তফাত। এই অবনিবনা ভাষার সমস্যা নয়্তবৈচিত্র্য ও সৌন্দর্য বরং। ‘মুয়িনগীতি’ শিরোনামে যে-গানগুলো লিখতে চাই সেগুলো আশলে প্রলেতারিয়েতের গান্তশিক্ষিত মধ্যবর্তী শ্রেণির মার্জিত ভাষায় তার প্রসাধন চলে না বোধহয়। চাটগাঁইয়া ভাষার ধ্বনি প্রমিত বর্ণমালায় ধরা যায় না ঠিকঠাকমতো্তএও এক ভাষাতাত্ত্বিক সংকট। তবে গান যেহেতু শ্রুতিনির্ভর, তাই বানানসমস্যা রসগ্রহণে খুব বাধা দেবে না, আদৌ রস যদি কিছু থাকে!

টিকা দিলাম হাতত, আঁর ঠ্যাঙত ব্যথা লার
বউ কন্ডে গেল্‌ আবার!

কঅস একখান বাইর গরি আনিল ফাতেমায়
চিবি ধরি সুঁই মাইত্তু লই গেল্‌ পুতারায়
তিন ঘণ্টা লাইনুত থিয়েই কোঁর ফাডি যার
বউ কন্ডে গেল্‌ আবার!

টাইগার বাম কন্ডে রাইলি, ছিরি গেল্‌গই রান
আর নু অইলি রউনুর তেল গরম গরি আন
মালিশ গরি দে চে চাই ভালা লাই নি আঁর
বউ কন্ডে গেল্‌ আবার!

ডাইন কাইত অইলি মনে অয় যে ডোঁয়াত মারের ছেল
নাপা উগ্‌গ খাআই কনঅ পেশার বারি গেল্‌
হাত দিই চা চে ঘেঁডির নীচে কিল্লেই চিকচিগার
বউ কন্ডে গেল্‌ আবার!

বিছেনত আঁই পরি রইলাম, চঅনর মানুষ নাই
কারে পাইয়ুম গরুঘরত ধোঁঅ দিবেল্লাই
চা ত, বালি, বারিচ দি ক্যান কুরঅ কডকডার
বউ কন্ডে গেল্‌ আবার!

[কন্ডে: কোথায়; কঅস: কাগজ; পুতারা: মেয়ের দেবর বা ছেলের শ্যালক; ডোঁয়াত: বাহুতে; ঘেঁডির: ঘাড়ের; বারিচ দি: ঘরের পিছনের আঙিনায়; কুরঅ: মুরগি]

বাইন দুয়র দি খোলা রাখি বাআর দি দিলে তালা
তোঁয়ারে লই জ্বালা, অ ঝি, তোঁয়ারে লই জ্বালা!

আলু ছুইলতাম দিই তোঁয়ারে গেলাম পইরুর ঘাঁডত
পোয়ার বাপে পাইন্যা কচু বেইচতু গেইয়ি হাঁডত
চুলর মুখত পুরি গেল্‌গই নোয়া কাডিমালা
তোঁয়ারে লই জ্বালা, অ ঝি, তোঁয়ারে লই জ্বালা!

ঝর পরেজ্জে ক্যান গরি আঁর ছনর ছানি ঘরত
তোঁয়ারে কই বালটির পানি ছাঁকি লইয়ো কঅরত
পাতাহেঁজা ভিজেজ্জে তুঁই ন দেখন্না, খালা!
তোঁয়ারে লই জ্বালা, অ ঝি, তোঁয়ারে লই জ্বালা!

তোঁয়ারে কই কেঁতাকানি বিলেই দিয়ো ধইনুত
ডেইলের উরে কুরর ছাগুন বাঁধি রাইখখো ঝইনুত
ঝরর মেদ্দি ডেইলে লেপর কন্নান বুঝি ভালা!
তোঁয়ারে লই জ্বালা, অ ঝি, তোঁয়ারে লই জ্বালা!

[বাইন দুয়র: পিছনের দরজা; বাআর দি: বাইরের দিকে; পইরুর ঘাঁডত: পুকুরের ঘাঁটে; পাইন্যা কচু: বর্ষাজাত কচুবিশেষ; কাডিমালা: নারকেলের খোল ও কাঠি দিয়ে বানানো পাত্রবিশেষ যা চুলার ছাই বা কয়লা তোলার কাজে লাগে; ঝর: বৃষ্টি; কেঁতাকানি: কাঁথা; ডেইলে: ঘরের দাওয়া; কুরর ছাগুন: মুরগির ছানাগুলো]

অ দি, চঅ না, কন চোরুনি কইল্লু এই কাম!
বেইন্যেকালে ছাদত উডি ফুল ত ন পাইলাম!

আজুয়া আঁর একাদশী, মাথাত ভাঙিল বেল!
রঙ্গন নাই টবত, আঁর গাঁদাফুলঅ গেল্‌!
অইন্যে আঁই ঠাকুরঘর কী দি সাজাইতাম!
বেইন্যেকালে ছাদত উডি ফুল ত ন পাইলাম!

হউশ করি লাগাইলাম আঁই উগ্‌গ নয়নতারা
আঁর পুতে নার্সারিত্তুন কিনি আইন্নিল চারা
চোরা ফুলুর পুঁজঅ দিতি দেইখ্যু না? এ রাম!
বেইন্যেকালে ছাদত উডি ফুল ত ন পাইলাম!

পাথরঘাঁডা বাসা আছিল, ভারা বেশি ন
কিল্লেই এন্ডে মইত্তাম আইলাম শাঁকচুন্নির ল
ঠান্ডা জলত সিয়ান করি নিয়েস অই গেল্‌ জাম
বেইন্যেকালে ছাদত উডি ফুল ত ন পাইলাম!

[বেইন্যেকালে: ভোরবেলা; আজুয়া: আজ; অইন্যে: এখন; হউশ: হাউস বা শখ]

অ বাআজিঅল, তোঁয়ারার কাছে
শমশুইয়ের বিচের আছে
নোয়াজের পর সালাম ফিরেই এক্কানা বইস্যু

আঁরঅ ঘাঁডার গাছর আম পারি খাইয়ি শুউর
আঁরে দেখি ছচছরাই নামি দিইয়ি দুর
আমস্‌ সোঁলা মাইল্লু মেলা্তচঅ না কী দইস্যু!
নোয়াজের পর সালাম ফিরেই এক্কানা বইস্যু

হাঁঝিন্যে আঁর পিঁছুর পইরুত আঁধাবরকি দি
টুগুরটুগুর মাছ চাজ্জে খপ গরি ধইয্যি
ফইরগুন ফেলাই ইতেরে নিই পাডার লয় ঘঁইষ্যু!
নোয়াজের পর সালাম ফিরেই এক্কানা বইস্যু

বিশুদবাদ্দিন আঁর মাইয়্যের পানসল্লাত আআই
কঁত্তে-কঁত্তে শুঅরিগুন নিল্‌গই নঅ চাই
তিন পণর দাম কত আইয়ি হিশেবগান কইষ্যু!
নোয়াজের পর সালাম ফিরেই এক্কানা বইস্যু

[বাআজিঅল: বাবাজিগণ; নোয়াজ: নামাজ; এক্কানা: একটু; ঘাঁডা: বাড়ির প্রবেশমুখের খোলা জায়গা; শুউর: শূকর; আমস্‌ সোঁলা: আমের খোসা; হাঁঝিন্যে: সন্ধ্যা; পিঁছুর পইরুত: পিছনের পুকুরে; আঁধাবরকি: ফাতনাবিহীন বড়শিবিশেষ; ফইরগুন: আঁশগুলো বা পালকগুলো; বিশুদবাদ্দিন: বৃহস্পতিবার, পানসল্লা: বিবাহপূর্ব পরামর্শসভা; কঁত্তে-কঁত্তে: কখন-কখন; শুঅরিগুন: সুপারিগুলো]

অ মানিক্যে, জলদি যাই চা, আর বিরি ন টানিস
ওয়াবিল লই আইবের সমত উগ্গ পান আনিস

হাকিমপুরী জর্দা বারাই খেয়াল গরি লইস
আরেক খিলি চুনছারা পান এশটা দিতু কইস
কাক্কু মিয়া কন হাঁডত্তুন পান কিনি লয় জানিস
ওয়াবিল লই আইবের সমত উগ্গ পান আনিস

বদ্দা, তোঁয়ার আকল নাই না? কী কইতাম, কঅ!
পেটটউ লাগাই দিইয়ু আঁর বডির লগে, চঅ!
চাবি দিলি কইবে আঁরে, ‘কানার পোয়া কানিস!’
ওয়াবিল লই আইবের সমত উগ্গ পান আনিস

কইখ্যে চঅর, অ মানিক্যে, চউখ অইয়ি না লিক?
হালকা বেরেক ন ধইল্যি ত যাইতু পেলাস্টিক!
কাম শিখিলি ঠিক গরি শিখ, কথা কইলি মানিস!
ওয়াবিল লই আইবের সমত উগ্গ পান আনিস

[ওয়াবিল: সাধারণত দূরপাল্লার বাসের জন্য লাইনম্যানের দেওয়া রশিদ (ইংরেজি Waybill-এর কথ্যরূপ); উগ্গ: একটি; কইখ্যে: কোন দিকে; চউখ: চোখ]
মুয়িন পারভেজ। কবি। জন্ম ফটিকছড়ি, বসবাস করেন চট্টগ্রাম শহরে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের লোকনাট্য
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান