মহান একুশের রক্তাক্ত সিঁড়ি বেয়ে আজকের সোনার বাংলা- আমাদের সমস্ত অর্জন। মুক্তিযুদ্ধের রক্তক্ষয়ী মৃত্যুর সমুদ্র পাড়ি দেওয়ার পর একটি লাল-সবুজের পতাকা ও ‘আমার সোনার বাংলা’ কন্ঠে নেওয়ার অমূল্য অধিকার। বস্তুত মহান একুশই হলো বীজতলা। চেতনার অগ্নিস্ফূলিঙ্গ প্রজ্বলনের প্রথম শক্তি। ‘একুশ মানে মাথা নত না করা’- এই বিস্ফোরক-মন্ত্র ধারণ করেই পরবর্তীতে ইতিহাসের অনেক যুগান্তকারী বাঁক বদলের প্রেরণদাতা ও আদ্যশক্তি তো একুশ।
পূর্ববঙ্গের অন্ত্যজ শ্রেণির চির নিগৃহীত মার খাওয়া কৃষককূলের মুক্তির মন্ত্র ছিলো ইংরেজ বিতাড়ন-পরবর্তী স্বতন্ত্র নিজস্ব জমিন। খণ্ডিত দেশের যে আপাত-স্বাধীনতা অর্জন করেছিলো বাঙালি মুসলমান, সেই স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা অচিরেই ধুলিস্যাৎ হয়ে যায়। প্রথমেই আঘাত আসে মায়ের বোল-ভাষার ওপর। ভাষার অধিকার হরণ মানেই হাজার বছরের বাংলা ও বাঙালির আত্মপরিচয়ের বাহন ছিন্ন করে দেয়ার প্রয়াস। সেটি উপলব্ধি করতে পেরেছিল বাঙালি বিদ্বৎ সমাজ এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। ধর্মের ভিত্তিতে ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির চাপিয়ে দেয়া দেশ বিভক্তি হলো। পৃথিবীর বুকে জন্ম নিলো এক অদ্ভুত কিম্বুতাকারের দেশ যার দুই অংশের ব্যবধান হাজার মাইলেরও অধিক। বাংলাভাষী জনগণ মেনে নিলো। কিন্তু জিন্নাহ যখন তথাকথিত স্বাধীনতার এক বছরের মধ্যে ১৯৪৮ সালে ঢাকার কার্জন হলে ‘উর্দু’ কে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথা ঘোষণা করলেন, তখন সভাকক্ষেই প্রতিবাদের ঝড় ওঠলো। সদ্য প্রতিষ্ঠিত দেশটির পর্বতসমান জনপ্রিয় জাতির জনক জিন্নাহর মুখের ওপরেই বাঙালির তরচণ প্রাণ গর্জে ওঠেছিলো। বাঙালি উপলব্দি করলো ধর্মের নামে যাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধে নতুন দেশ অর্জন করলো তারাই বাঙালির লালিত স্বপ্ন ভেঙ্গে চুরমার করে দেবে। সর্বজন শ্রদ্বেয় বাঙালি মনীষী ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ, ড. এনামুল হক, সৈয়দ মুজতবা আলী রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে কলম ধরলেন। সংসদে প্রতিবাদ জানালেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত। পক্ষান্তরে এটাও সত্য যে, সে পথেই প্রতিষ্ঠিত হলো আওয়ামী মুসলিম লীগ। বঙ্গবন্ধু সেই দলের তরচণ নেতা। এই যুবনেতা বৃটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামে ছিল লড়াকু সৈনিক। কিন্তু অচিরেই যখন বাঙালি জাতির স্বপ্ন ভঙ্গ হলো, তখন থেকেই তিনি একটি স্বাধীন- সার্বভৌম রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখা শুরচ করলেন। আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি তুলে দিয়ে এই রাজনৈতিক দলকে সম্পূর্ণ অসাম্প্রদায়িক চেতনায় পুষ্ট করে তোলার ব্রত নিয়ে জেল-জুলুম হুলিয়া-নির্যাতন বরণ করে নিলেন।
৫২’র ভাষা আন্দোলনে রফিক, শফিক, জব্বার, সালাম, বরকতের রক্তের স্রোত বেয়ে বাঙালি ভাষার মাধ্যমে আত্মচেতনা বা আত্ম-আবিষ্কার ও হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক একটি জনপদের মূল মর্ম অনুধাবন করলো।
ভাষা আন্দোলনেও ছিলো বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ ভূমিকা। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শিক্ষার্থী। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন। যখন ঢাকার রাজপথ ভাষা শহিদদের রক্তে রঞ্জিত, তখন বঙ্গবন্ধু ছিলেন কারা প্রাচীরের লৌহ কপাটের অভ্যন্তরে। কিন্তু মহান ভাষা আন্দোলনে তাঁর ভূমিকা প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়নি। বস্তুত ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস রচয়িতা এবং অন্যরা ছিলেন অধিকাংশই বাম ঘরানার ইতিহাসবেত্তা। ফলে ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা গৌণ হিসেবে চিহ্নিত হবে সেটিই অনুমেয়। বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ ও ‘কারাগারের রোজনামচা’ প্রকাশিত হওয়ার পর মহান ভাষা আন্দোলনে জাতির পিতার সক্রিয় সম্পৃক্তি দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়। এই প্রসঙ্গে একটা ঘটনাক্রম উল্লেখ করতে হয়। বঙ্গবন্ধু একবার ব্রাক্ষণবাড়িয়া গিয়েছিলেন একটি বিদ্যালয়ের দ্বার উন্মোচন করতে। সেই আয়োজনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়া আব্বাস উদ্দীন, বেদার উদ্দিন মাহমুদ প্রমুখ ফিরছিলেন নৌকাযোগে। আব্বাস উদ্দিন ও বেদারউদ্দীনের গান শুনে বঙ্গবন্ধু আপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন। এই কথা সুষ্পষ্টভাবে মুদ্রিত হয়েছে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতে। সেই পঞ্চাশের দশকের প্রথমভাগে, যখন সমগ্র দেশ ভাষা-সংগ্রামে উত্তাল, সেই প্রেক্ষাপটে ভাওয়াইয়া সম্রাট আব্বাস উদ্দীন বাংলা ভাষাকে রক্ষা করার জন্য বঙ্গবন্ধুর কাছে আকুতি জানিয়েছিলেন।
৫২’র ভাষা আন্দোলন- সালাম, বরকত, রফিক প্রমুখের জীবন-উৎসর্গ, সমগ্র দেশকে সংগ্রামমূখর ও বিক্ষুব্ধ করে তোলে। বাঙালি আত্মপরিচয়ের গৌরব-ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন ছিল। তাদের বুকের রক্ত-উচ্চারণ ঘোষিত হয়- এক একটি বাংলা অক্ষর এক একজন বাঙালির প্রাণ। দেশ ও জাতির চিন্তক সমাজ কবি-শিল্পী সাহিত্যক বুদ্ধিজীবীরা তাদের সৃষ্টিকর্মে একুশের চেতনা ধারণ করে বাংলা ভাষার প্রাণ সঞ্জীবনী রচনায়, সৃজন প্রক্রিয়ায় নিবেদিত হয়ে ওঠেন। সমস্ত রক্তচক্ষু, জেল-জুলুম, নিপীড়ন উপেক্ষা করে চট্টগ্রাম থেকে মাহবুব উল আলম চৌধুরী কবিতায় ঘোষণা করেন- ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। সেসময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তরচণ কবি মাতৃ-অলংকার বিক্রি করে প্রকাশ করেন একুশের প্রথম সংকলন যার প্রকাশক ছিলেন প্রগতিশীল সাংস্কৃতিক কর্মী মোহাম্মদ সুলতান। ওই সংকলনে প্রকাশিত হয় আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী রচিত ‘আমার ভাইয়ের রক্তের রাঙানো একুশে ফেব্রচয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি…’। আলতাফ মাহমুদ সুরারোপিত এই গান আজ বাংলা ও বাঙালির অহংকারের স্মারক। আলাউদ্দিন আল আজাদ লিখলেন ‘স্মৃতির মিনার’ নামে কালজয়ী কবিতা ‘স্মৃতির মিনার ভেঙেছো তোমরা, আমরা বেঁচে আছি সাত কোটি পরিবার’। শামসুর রাহমানের অমর কবিতা ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’ আজ একটি কালজয়ী রচনা। এছাড়া, ৫২’র শহিদদের আত্মোৎসর্গ একুশের চেতনা ধারণ করে শিল্পকলার সব ক’টি মাধ্যমে যে সুবর্ণ ফসল ফলেছে, তা বাঙালির গৌরব বাঙালির অহংকার।
জনৈক লোককবি লিখলেন- ‘ঢাকা শহর রক্তে ভাসাইলি’ কিংবা গণসংগীত শিল্পী আবদুল লতিফের ‘ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়’-আমরা কীভাবে বিস্মৃত হই। ‘আগামী ফাগুনে আমরা দ্বিগুণ হবো’ এই অমোঘ বাণী উচ্চারণ করে জহির রায়হানের ‘আরেক ফাল্গুন’ উপন্যাস বাংলা কথাসাহিত্যের এক প্রতিবাদী ও অমূল্য নিদর্শন। জেলখানায় লেখা মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটক কারা প্রকোষ্টে হারিকেনের আলো জ্বালিয়ে মঞ্চস্থ হয়। চিত্রকর মুর্তজা বশীর, রশীদ চৌধুরী, কাইয়ুম চৌধুরী, দেবদাস চক্রবর্তী আঁকলেন প্রতিবাদী কার্টুন। এছাড়া প্রাক-স্বাধীনতা লগ্নে জহির রায়হান নির্মিত চিরায়ত ছবি ‘জীবন থেকে নেয়া’র মূল মর্ম ছিলো একুশের চেতনা।
সাহিত্য-সংস্কৃতি হলো অধিকাঠামো। উপরিকাঠামো হলো রাজনীতি। একুশ পরবর্তী সমস্ত বাঁক বদলকারী আন্দোলন-সংগ্রাম সংঘটিত হয়েছিলো ‘৫২’ এর ভাষা আন্দোলনের চেতনা ধারণ করেই। ‘৫৪’ এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ‘৬২’ এর ছাত্র আন্দোলন, ‘৬৬’ এর ছয় দফা আন্দোলন, ‘৬৯’ এর গণ-আন্দোলন, ‘৭০’ এর নির্বাচন এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধ, সবকিছুরই বীজতলা বস্তুত মহান একুশে।
প্রতিবছর প্রথম ভোরের পবিত্র লগ্নে যখন লাখো কন্ঠে ধ্বনিত হয়- ‘আমার ভাইয়ের রক্ত রাঙানো একুশে ফেব্রচয়ারি’। খালি পায়ে প্রভাতফেরির এই মন্ত্র বার বার প্রতিবার নতুন চেতনায়, নতুন উদ্দীপনায় নবায়িত হয়। প্রাণ সঞ্চারিত হয়।
দেশে আজ গণতান্ত্রিক সরকার। বঙ্গবন্ধু তনয়া শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ধারাবাহিক সরকার পরিচালনায় দেশ আজ উন্নয়নের মহাসমুদ্রে চলমান। নিজেদের অর্থেই পদ্মা সেতু বাস্তবায়িত হয়েছে। কর্ণফুলীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু ট্যানেল সমাপ্তির পথে। কক্সবাজার হয়ে ঘুমধুম পর্যন্ত রেললাইন স্থাপনের মাধ্যমে আমরা বিশ্বায়িত যোগাযোগ ব্যবস্থার মূল ধারায় অন্তর্ভুক্ত হতে চলেছি। রাজধানীতে মেট্রোরেল উদ্বোধনের অপেক্ষায়। এছাড়া পায়রা বন্দর, রূপপুরে পারমাণবিক প্রকল্পসহ অন্যান্য উচ্চাকাঙ্ক্ষী পরিকল্পনাসমূহ এই সরকারের সামর্থের নমুনা। পাশাপাশি রোহিঙ্গাদের আশ্রয়দানের মানবিক প্রয়াস, কোভিড মোকাবেলায় অভূতপূর্ব সক্ষমতা বাংলাদেশের উন্নত ভাবমূর্তির পরিচায়ক।
বঙ্গবন্ধু ৭ই মার্চের ভাষণে দীপ্তকন্ঠে উচ্চারণ করেছিলেন- ‘কেউ আমাদের দাবায়ে রাখতে পারবে না’ ; যা ছিলো মূলত স্বাধীনতার আন্তঃপ্রেরণা। সেই ভাষণ এখন জাতিসংঘের ইউনেস্কো কর্তৃক ঘোষিত “মেমোরি অব ওয়ার্ল্ড রেজিস্ট্রারে স্মারক হিসেবে গৃহীত। এর পূর্বে ২১ ফেব্রচয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত হয়। বাঙালির দুই বৃহৎ অর্জনই ছিল রক্তঋণে ভাস্মর। ভাষা আন্দোলন, মহান স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে যেমন বাঙালিকে দমিয়ে রাখা যায়নি, তেমনি বঙ্গবন্ধুর আদর্শে ও মুক্তির সংগ্রামে বাঙালির পথচলাকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারবে না। বঙ্গবন্ধুরই সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা একাদশ সংসদ অধিবেশনের সমাপনী বক্তব্যেও একই কথা উচ্চারণ করে বলেছিলেন ‘বাঙালিকে কেউ দাবায়ে রাখতে পারবে না’। তাতেই প্রমাণিত হয় শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্থিতিশীল গণতান্ত্রিক সরকারের মাধ্যমে তাঁর মিশন ও ভিশন বাস্তবায়িত হবে। রূপকল্প- ৪১’ এর স্বপ্নযাত্রায় আগামী বাংলাদেশ হবে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত উন্নত বাংলাদেশ।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক; সাবেক ডিন, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।