পারিবারিক সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে দরকার সুস্থ সামাজিক মেলবন্ধন

| বৃহস্পতিবার , ১১ মে, ২০২৩ at ৫:৩৪ পূর্বাহ্ণ

সমাজে পারিবারিক সহিংসতার মাত্রা ক্রমে বেড়েই চলেছে। যেহেতু আমাদের পরিবারগুলো সমাজেরই অংশ, তাই এখানে সহিংসতার প্রবণতা লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে। গত ৯ মে দৈনিক আজাদীতে ‘সমঝোতা বৈঠকে ছুরিকাঘাত পাহাড়তলীতে নিহত ২, বান্ধবীর সাথে বেড়াতে যাওয়া নিয়ে দুই কিশোর গ্রুপের মারামারি ছুরিকাহত দুই ভাই হাসপাতালে ভর্তি’ শীর্ষক এক সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, নগরীর পাহাড়তলী থানার বিটাক মোড় এলাকায় নারীঘটিত বিষয়কে কেন্দ্র করে দুই কিশোর গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষে ছুরিকাঘাতে দুজন নিহত হয়েছে। গত সোমবার রাত ৭টার দিকে স্থানীয় এক শ্রমিকলীগ নেতার অফিসে দুই পক্ষের সমঝোতা বৈঠকে এই ঘটনা ঘটে। নিহতরা হলেন মোহাম্মদ মাসুম (৩০) ও মোহাম্মদ সজীব (২০)। চমেক হাসপাতালের কর্তব্যরত চিকিৎসক জানান, ছুরিকাঘাতে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে এই দুইজন মারা গেছেন। এই ঘটনায় ছুরিকাহত হয়ে চমেক হাসপাতালে শিহাব ও মেহেদী নামে দুই ভাই ভর্তি আছে। নিহত মো. সজীব স্থানীয় মো. গিয়াস উদ্দিনের ছেলে। মায়ের নাম সামছুন নাহার। তিনি পেশায় অটো রিকশা চালক। অপরজন হচ্ছেন মো. মাসুম, পিতা মো. এবাদুর রহমান। তিনি পেশায় ব্যাটারির মিস্ত্রি। তারা পাহাড়তলীর ভাড়া বাসায় থাকেন। পাহাড়তলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, এক তরুণ ও তরুণীকে নিয়ে তার বন্ধুদের মধ্যে ঝগড়া হয়। বিষয়টি নিয়ে সন্ধ্যায় বৈঠকে বসে উভয়পক্ষ। সেখানে বিরোধ মিটমাটের সময় দুষ্কৃতকারীরা পেছন থেকে ছুরিকাঘাত করে। তিনি আরও বলেন, হত্যাকাণ্ডের সঠিক কারণ জানার চেষ্টা চলছে। আমাদের পুলিশের একটি দল জড়িতদের ধরতে কাজ করছে।

বেসরকারি সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ইতোপূর্বে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। সেখানে বলা হয়েছে, পারিবারিক কলহের জেরে তিন মাসে ৬৬ নারী ও ৩১ শিশু খুন হয়েছে। এর মধ্যে ৪৮ নারী স্বামীর হাতে খুন হয়েছেন বলে অভিযোগ এসেছে। নিহতদের ১৪ জনের বয়স ২৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। সংস্থাটি জানিয়েছে, গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর ও নিজস্ব অনুসন্ধানের ভিত্তিতে তারা এই তথ্য পেয়েছে। এদিকে মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের তথ্য মতে, নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতা, ধর্ষণ ও হত্যার ঘটনা আগের তুলনায় বাড়ছে। এক মাসে সারা দেশে ৩৯৭টি নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পরিবার নাগরিকের প্রথম সোপান, এখানে সহিংসতা বাড়া মানে জাতীয়ভাবে বিরূপ প্রভাব ফেলার মতো একটি বিষয়। পারিবারিক সহিংসতার ধরন পাল্টেছে এবং সহিংসতা বাড়ছে। উল্লেখ্য, দেশে সার্বিক অপরাধপ্রবণতার কোনো একক চিত্র পাওয়া যায় না। নেই কোনো সমন্বিত জরিপও। এর পরও সামপ্রতিক বেশ কিছু ঘটনা, আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তথ্য এবং বিভিন্ন সরকারিবেসরকারি সংস্থার প্রকাশিত তথ্যউপাত্তের ভিত্তিতে বিশেষজ্ঞরা বলেন, ‘পারিবারিক সহিংসতা বৃদ্ধির পেছনে পারিবারিক বন্ধন শিথিল হওয়া, যৌতুক, মাদক, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক, প্রযুক্তির অপব্যবহার, ব্যক্তিগত স্বার্থ, সুস্থ বিনোদনের অভাব, অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা এবং সামাজিক অবক্ষয়ের প্রভাব কাজ করছে। পরিবারে শারীরিকমানসিক নির্যাতনের পাশাপাশি হত্যাকাণ্ডের মতো ঘটনা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আরেকটি বিষয় হলো, আমাদের দেশে বেশিরভাগ পরিবারে ব্যক্তির মানসিক সমস্যাগুলো সেভাবে চিহ্নিত করা হয় না। এ কারণে তারা মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কাছেও যান না। ফলে মানসিক সমস্যা ও সমাজের বিভিন্ন বিশৃঙ্খল পরিবেশ পারিবারিক অপরাধ বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে। তবে পরিতাপের বিষয়, সমাজ ও পারিবারিক পর্যায়ে সংঘটিত সহিংসতার সঠিক চিত্রটি অজানা, যা অনভিপ্রেত।’ তাঁদের মতে, শুধু আইন থাকলেই হবে না; সে আইন বাস্তবায়ন জরুরি। দেশে দীর্ঘ দিন ধরে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে, সেটি থেকে দ্রুত বেরিয়ে আসতে হবে। নতুবা অপরাধ না কমে আরো বাড়বে বৈকি। আইন থাকলেও অনেক সময় পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা থানাআদালত পর্যন্ত গড়ায় না। বেশির ভাগ ঘটনাই স্থানীয় সালিসে নিষ্পত্তি হয়ে যায়। কিন্তু এই সমঝোতার বৈঠকেও ঘটলো নৃশংস হত্যাকাণ্ড। এই সহিংসতা আমাদের পশ্চাৎপদ সমাজ ও পারিবারিক কাঠামোর ফল। এর থেকে বের হয়ে আসা জরুরি। আর এটি করতে না পারা মানবিক এবং আধুনিক সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ার ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়।

গবেষকরা বলছেন, পারিবারিক সহিংসতার পেছনে ব্যক্তি পর্যায়ে অস্থিরতা অনুঘটক হিসেবে কাজ করছে। সামাজিক, রাষ্ট্রীয়, ধর্মীয় যেসব মূল্যবোধ রয়েছে, সেগুলো মেনে চললে ব্যক্তি কিংবা পরিবারএই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে সহায়ক হবে। অপরাধ বেড়ে যাওয়া, মূল্যবোধের অবক্ষয়এসবের জন্য বেশি দায়ী ঐতিহ্যগত শিষ্টাচারগুলোকে অবজ্ঞা করা। মোটকথা, পারিবারিক সহিংসতা নিয়ন্ত্রণে দরকার সুস্থ পারিবারিক, সাংস্কৃতিক, সামাজিক মেলবন্ধন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে