অধ্যাপক ড. আবদুল করিম ও তাঁর ইতিহাস চর্চা

ড. সুনীতি ভূষণ কানুনগো | মঙ্গলবার , ১২ অক্টোবর, ২০২১ at ১০:৩৮ পূর্বাহ্ণ


অধ্যাপক আবদুল করিম ১৯২৮ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম সৈয়দ ওয়াইজুদ্দিন, মাতার নাম সৈয়দা রাশিদা খাতুন। তাঁর জন্মস্থান বাঁশখালী উপজেলার অন্তর্গত চাঁপাছড়িগ্রাম।গ্রামে প্রাথমিক বিদ্যা শেষ করে চট্টগ্রাম শহরে গিয়ে ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজে (বর্তমানে হাজী মোহাম্মদ মহসিন কলেজ) ভর্তি হন। এই কলেজ থেকে ১৯৪৪ সালে কৃতিত্বের সাথে হাই মাদ্রাসা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগেদ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন এবং আই.এ.পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে অষ্টম স্থান অধিকার করেন।
আবদুল করিমের মাদ্রাসায় শিক্ষালাভ তাঁর আরবি ফারসি ভাষায় দক্ষতা যথেষ্ট বৃদ্ধি করেছিল। পরবর্তীকালে গবেষণার কাজে আরবি ফারসি দক্ষতা তাঁর খুব কাজে এসেছিল। আই.এ. পাশ করবার পর তিনি ইতিহাস নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক শ্রেণিতে ভর্তি হন। ইতিহাসের অনার্স পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণীতে তৃতীয় হয়ে তিনি স্নাতক ডিগ্রী লাভ করেন। বি.এ.ডিগ্রী লাভ করার পর তিনি এম.এ. ক্লাশে ভর্তি হন। এক বছর পরে ইতিহাসের এম.এ. পরীক্ষায় তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে উর্ত্তীণ হন (১৯৫০)।
অধ্যাপক আবদুল করিম কর্তৃক ভাল ফলাফল অর্জন তাঁর শিক্ষকবৃন্দকে চমৎকৃত করেছিল। তাঁরা অধ্যাপক করিমকে ইতিহাস গবেষণায় ব্রতী হবার জন্য পরামর্শ দেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন অধ্যাপক কালিকা রঞ্জন কানুনগো, অধ্যাপক মাহমুদ হাসান, অধ্যাপক আহমদ হাসান দানী, অধ্যাপক আবদুল হালিম, অধ্যাপক সন্তোষ কুমার ভট্টাচার্য। এঁরা প্রত্যেকেই নিজ খ্যাতিতে উজ্জল।
অধ্যাপক আবদুল করিমের কর্মজীবন আরম্ভ হয় ১৯৫১ সালে। এ বছরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে প্রভাষক নিযুক্ত হন। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে অধ্যাপক আবদুল করিম গবেষনার কাজ আরম্ভ করেন। তাঁর গবেষণার বিষয়বস্তু ছিল বাংলায় মুসলিমদের সামাজিক ইতিহাস, তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন প্রথিতযশা ঐতিহাসিক অধ্যাপক ড. আহমদ হাসান দানী। ১৯৫৮ সালে তিনি পিএইচ.ডি. ডিগ্রী প্রাপ্ত হন।১৯৬২ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগে রীডারের পদলাভ করেন। ১৯৬৬ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাস বিভাগে বিভাগীয় প্রধান হিসাবে কার্যভার গ্রহণ করেন। ১৯৬৯ খ্রীষ্টাব্দে তিনি প্রফেসর পদে উন্নীত হন। তিনি কলা অনুষদের ডীন পদেও নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিযুক্ত হন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি ১৯৯২ থেকে ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত সুপার নিউমেরারি অধ্যাপক পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন এবং ২০০১ সালের নভেম্বর থেকে আমৃত্যু প্রফেসর ইমেরিটাস পদে আসীন ছিলেন।
পিএইচ.ডি. ডিগ্রী লাভ করার পর পরেই অধ্যাপক আবদুল করিম লেখক জীবনে প্রবেশ করেন। কয়েকটি নির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়েই তিনি রচনার কাজে অগ্রসর হন। লক্ষ্য গুলি হলো:
ক. মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাসকে ধারাবাহিক ও সুসামঞ্জস্য রূপ দেওয়া
খ. ইতিহাসকে যথাসম্ভব প্রাসঙ্গিক তথ্য সমৃদ্ধ করা এবং
গ. ভবিষ্যৎ গবেষকদের পথ নির্দেশ দেওয়া।
অধ্যাপক আবদুল করিম বহু গ্রন্থ প্রনেতা ছিলেন। বর্তমানে তাঁর দু’টি গবেষণা গ্রন্থ এবং একটি শিলালিপি ভিত্তিক গ্রন্থের অতি সংক্ষিপ্ত আলোচনা করা গেল।
Social History of the Muslims in Bengal গ্রন্থটি অধ্যাপক আবদুল করিম রচিত সর্বপ্রথম এবং সর্বশ্রেষ্ঠ গ্রন্থ। এই গ্রন্থটি তাঁর পিএইচ.ডি. অভিসন্দর্ভের ভিত্তিতে রচিত। গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য উপাত্ত পেয়েছিলেন প্রধানত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগার থেকে। এছাড়া স্থানীয় মাদ্রাসা সমূহের গ্রন্থাগার গুলি তাঁর খুব সহায়ক হয়েছিল। গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ড. আহমদ হাসান দানী ব্যক্তিগতভাবে ড. করিমকে অত্যন্ত স্নেহ করতেন। তিনি নিজে যেমন পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন তেমনি ড. করিমও গুরুত্ব সহকারে পড়াশুনা করতেন। স্বাভাবিকভাবেই ড. করিম ড. দানীর আনুকুল্য লাভ করেছিলেন। অনেক পরিশ্রম করে পরিশোধন ও পরিমার্জন করে পিএইচ.ডি. থিসিসটাকে গ্রন্থের রূপ দিলেন ড. করিম। গ্রন্থটি প্রকাশ করেছেন এশিয়াটিক সোসাইটি অব পাকিস্তান। গ্রন্থটি প্রকাশিত হবার সাথে সাথে পণ্ডিত সমাজ কর্তৃক উচ্চ প্রশংসিত হয়। সে সঙ্গে ড. করিমের সুনাম ও ছড়িয়ে পড়ে। গ্রন্থটি পড়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উপমহাদেশের স্বনামখ্যাত ঐতিহাসিক অধ্যাপক কালিকা রঞ্জন কানুনগো অধ্যাপক আবদুল করিমকে অভিনন্দন জানিয়ে চিঠি লিখেছিলেন। অধ্যাপক কালিকা রঞ্জন কানুনগো সাক্ষাতে আমাকে গ্রন্থটির প্রশংসা করেছিলেন।
Murshid Quli Khan and His Times গ্রন্থটি অধ্যাপক আবদুল করিমের লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁর দ্বিতীয় বারে প্রাপ্ত পিএইচ.ডি.ডিগ্রীর অভিসন্দর্ভের ভিত্তিতে রচিত। থিসিসের তথ্য সংগ্রহের জন্য তাঁকে ব্রিটিশ মিউজিয়াম ও ইন্ডিয়া অফিস গ্রন্থাগারে পড়াশুনা করতে হয়েছিল। তাঁর গবেষণার তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বিখ্যাত ইতিহাসবিদ মেজর জে. বি. হ্যারিসন। হ্যারিসন সাহেব খুব আন্তরিকতার সাথে করিম সাহেবের কাজ পরিচালনা করতেন।একটি কৌতূহলের বিষয় হলো অধ্যাপক আবদুল করিম খুব অল্প সময়ের মধ্যে লন্ডনে তাঁর গবেষণা কাজ শেষ করেন। মাত্র এক বছরের মধ্যেই তাঁর থিসিস লেখা সম্পূর্ণ হয়। এটি একটি রেকর্ড। উপমহাদেশের আর কোন পিএইচ.ডি. পরীক্ষার্থী এত অল্প সময়ের মধ্যে তাঁদের থিসিস লেখা সম্পূর্ণ করতে পারেননি।
Corpus of the Arabic and Persian Inscriptions ইংরেজ লিপি বিশারদেরা মুসলিম শাসনামলের বহু শিলালিপি আবিস্কার করেছেন, ইংরেজিতে অনুবাদ করেছেন এবং লিপিগুলির ঐতিহাসিকতা বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। তখনও পর্যন্ত বহু শিলালিপি অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে। অধ্যাপক আবদুল করিম অনাবিষ্কৃত শিলালিপিগুলি আবিষ্কৃত করে একটি পূর্ণাঙ্গ শিলালিপি ভিত্তিক গ্রন্থ রচনা করেছেন।
সুলতানি আমলের শিলালিপি গুলির ঐতিহাসিক মূল্য অনেকখানি। বুকাননের সংক্ষিপ্ত বিবরণী এবং রিয়াজ উস সালাতিন ব্যতীত সুলতানি আমলে রচিত কোন গ্রন্থ পাওয়া যায় না। কিন্তু রিয়াজ উস সালাতিন গাল গল্পে ভরা কাহিনী মাত্র, ইতিহাস নয়। এ অবস্থায় সুলতানদের দ্বারা উৎকীর্ণ শিলালিপি সমূহ ইতিহাসের প্রধান উৎস রূপে আত্মপ্রকাশ করে। শিলালিপি গুলিতে সুলতানের নাম ও কুনিয়াৎ, উচ্চ রাজ কর্মচারীদের উল্লেখ, রাজ্যের রাজনৈতিক বিভাগ ইত্যাদি জানা যায়। অধ্যাপক আবদুল করিম শিলালিপি গুলিতে বর্ণিত তথ্য সমূহ বিশ্লেষণ করেছেন এবং তাদের উপর পাণ্ডিত্যপূর্ণ আলোচনা করেছেন। এর ফলে তাঁর লিখিত গ্রন্থটি একটি মূল্যবান আকর গ্রন্থে পরিণত হয়েছে।
প্রাচীন যুগের বাংলার এবং আধুনিক যুগের বাংলার ইতিহাস সম্বন্ধে প্রচুর লেখালেখি হলেও মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস সম্বন্ধে উল্লেখযোগ্য কিছু রচিত হয়নি। বলা যেতে পারে মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস কিছুটা অবহেলিত রয়ে গেছে। বিষয়টি অধ্যাপক আবদুল করিমের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। তিনি যথাযথ গুরুত্ব সহকারে মধ্যযুগের বাংলার ইতিহাস অনুশীলনে প্রবৃত্ত হন। এর ফলে কয়েকটি উৎকৃষ্ট মানের গ্রন্থ রচিত হয়। উপরোক্ত তিনটি গ্রন্থ ছাড়া আরও প্রায় বিশটি গ্রন্থ অধ্যাপক করিম রচনা করেছেন। এদের মধ্যে কয়েকটি হলোঃ
Dhaka the Mughal Capital, Corpus of the Muslim Coins of Bengal, History of Bengal (Mughal Period) Vol I-II, The Rohingya Muslims: Their History and Culture, বাংলার ইতিহাস (সুলতানী আমল), ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম শাসন, ঢাকাই মসলিন, চট্টগ্রামে ইসলাম, মুসলিম বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য, বাংলা সাহিত্যের কালক্রম (মধ্যযুগ), আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ: জীবন ও কর্ম, আবদুল হক চৌধুরী ও তাঁর গবেষণা কর্ম, বাঁশখালীর ইতিহাস ও ঐতিহ্য, চট্টগ্রামে ইসলাম ও ঐতিহ্য, হযরত শাহ্‌ আমানত, সমাজ ও জীবন (দুই খণ্ডে বিভক্ত)এই বিপুল সংখ্যক গ্রন্থ রচনা করতে অধ্যাপক আবদুল করিমকে ধৈর্য্য সহকারে অক্লান্ত পরিশ্রম করতে হয়েছিল।
ইতিহাস গ্রন্থ রচনা করা সহজ কাজ নয়, ইতিহাস রচনা সম্বন্ধে আমরা যা ভাবি তার চেয়েও কঠিন কাজ। এর জন্য প্রয়োজন তথ্যের প্রাচুর্য ও সহজলভ্যতা। তথ্য প্রধানত আকর গ্রন্থ সমূহ থেকে পাওয়া যায়। অধ্যাপক আবদুল করিম অত্যন্ত অধ্যয়নশীল ছিলেন। এই পরিশ্রমের সুফল ও তিনি পেয়েছেন। তাঁর গ্রন্থগুলি তথ্য সমৃদ্ধ এবং বিশ্লেষণ ধর্মী।কেবলমাত্র বিপুল পরিমাণে তথ্য উপস্থাপনের দ্বারা লেখক হওয়া যায় না। তথ্যের প্রাচুর্যের দ্বারা পিএইচ.ডি.ডিগ্রী লাভ করা যায়, লেখক হওয়া যায় না।
লেখক হতে গেলে আরও কিছু গুণ আয়ত্ত করতে হয়। অধ্যাপক আবদুল করিম এ সমস্ত গুণের অধিকারী ছিলেন বলে তিনি সফল লেখক হতে পেরেছিলেন। বলা যেতে পারে, তাঁর সমগ্র রচনাই গবেষণা ধর্মী। তিনি ছিলেন শক্তিমান লেখক। হিসাব করে দেখলে দেখা যাবে যে তিনি অন্তত দশ হাজার পৃষ্ঠা লিখেছেন। চিন্তার অবিরাম স্রোত ধারা, হাতের মাংসপেশী এবং কলমের জোর তাঁকে এ কাজে ব্রতী করেছে। কোন প্রকারের প্রতিকূল অবস্থা তাঁর লেখনী চালনাকে স্তব্ধ করে দিতে পারে নি, ঝর্ণা ধারার মত চলেছে তাঁর লেখার কাজ।
প্রত্যেক খ্যাতিমান লেখক নিজস্ব রচনা রীতি অনুসরণ করে থাকেন। এই রচনা রীতি বাইরের লোকের কাছ থেকে পাওয়া যায় আবার নিজের মধ্যেও গড়ে উঠতে পারে। অধ্যাপক আবদুল করিমের রচনা রীতিতে প্রথাগত ইতিহাস গ্রন্থ রচনা পদ্ধতি অনুসূত হয়েছে।
তবে বিপুল সংখ্যক গ্রন্থ রচনা করতে গিয়ে তাঁর একটা নিজস্ব রচনা রীতি গড়ে উঠেছিল। অধ্যাপক আবদুল করিম বিভিন্ন ধরণের রচনা লিখেছেন, যেমন ঘটনার বর্ণনা মূলক, জীবন চরিত ভিত্তিক, ধর্মীয়, মুদ্রাতত্ত্বীয়, শিলালিপি তত্বীয় প্রভৃতি। বলা যেতে পারে প্রতিটি গ্রন্থের জন্য পৃথক রচনা রীতি অনুসরণ করা হয়েছে। এরূপ করতে গিয়ে তাঁকে বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে হয়েছে। রচনার বিভিন্নতা তাঁর রচনাকে বৈচিত্র্য দান করেছে। এতে তাঁর রচনার সাহিত্যগত গুণ বৃদ্ধি পয়েছে।
অধ্যাপক আবদুল করিম লিখতেন অনুসন্ধিৎসু পাঠকদের জন্য, গবেষকদের জন্য, বিশ্ববিদ্যালয়ের উচ্চ শ্রেণীর ছাত্রদের জন্য। তাঁর রচনাবলী পড়ে পাঠক নতুন নতুন তথ্য দ্বারা উদ্বুদ্ধ হোক এটাই তিনি চাইতেন। ইতিহাসে শেষ কথা বলতে কিছু নাই। যতই গবেষণা করা যাবে ততই নতুন তথ্য আবিষ্কৃত হবে, ইতিহাস সমৃদ্ধ হবে। এতে করে পাঠকদের মনে জানবার কৌতূহল বৃদ্ধি পাবে। এখানেই ইতিহাস রচনার সার্থকতা। অধ্যাপক আবদুল করিম যথাসম্ভব সত্যনিষ্ঠ হয়ে ঘটনাবলী পরিবেশন করেছেন। তিনি আকর গ্রন্থ সমূহের দোষ ত্রুটি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন ছিলেন।
অধ্যাপক আবদুল করিম প্রচুর লিখেছেন কিন্তু তাঁর কোন রচনাই পাঠকের বিরক্তি উৎপাদন করেনা। অনেক লেখক আছেন যাঁরা পাণ্ডিত্য প্রদর্শন করতে গিয়ে বর্ণিত বিষয়কে জটিল, দুর্বোধ্য ও শুষ্ক করে ফেলেন। একেত ইতিহাস একটি শুষ্ক বিষয়, বর্ণনার দোষে তা শুষ্কতর হয়ে উঠে। অধ্যাপক আবদুল করিম সহজ সরল ও প্রাঞ্জল ভাষায় লিখতেন। এর ফলে তাঁর রচনা ঝরঝরে ও গতিময় হয়ে উঠেছে এবং পাঠকের কাছে উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।
প্রচুর লিখলেই যে পণ্ডিত হবে এমন কোন কথা নাই। পণ্ডিত ব্যক্তি লেখক হতে পারেন কিন্তু লেখক পণ্ডিত নাও হতে পারেন। লেখক যা ইচ্ছা তাই লিখতে পারেন, সে স্বাধীনতা তাঁর আছে। কিন্তু পণ্ডিত ব্যক্তি লেখার গুণাগুণ সম্বন্ধে নিশ্চিত না হয়ে লিখতে যান না। ইংরেজিতে একটি কথা আছে Quantity is not quality. অধ্যাপক আবদুল করিমের লেখায় Quantity Ges quality দুই ই আছে। এখানেই অধ্যাপক করিমের শ্রেষ্ঠত্ব।
বিস্ময়ের বিষয় এই যে নানা প্রকারের প্রশাসনিক কাজে ব্যস্ত থাকার মধ্যেও তিনি গ্রন্থ প্রণয়নের কাজ চালিয়ে গেছেন। তাঁকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল এত কাজের মধ্যে বই লেখার সময় কখন পান? উত্তরে তিনি বলেছিলেন সময় আপনা থেকে আসেনা, সময় করে নিতে হয়। অন্য কোন কাজ তাঁকে লেখার কাজ থেকে বিরত রাখতে পারত না। দুই আলমারী বই তাঁর সেবায় প্রস্তুত ছিল। বলা যেতে পারে সারাদিনে কাজের ফাঁকে যেটুকু অবসর পেতেন তা তাঁর লেখার কাজে ব্যয়িত হতো। ছুটির দিনগুলিতেও অধ্যাপক আবদুল করিম লেখার কাজে সময়ের পরিপূর্ণ সদ্ব্যবহার করতেন। ছুটির দিনের আনন্দ উপভোগ করার ভাগ্য তাঁর কপালে ছিল না। তাঁর বিশাল আকারের গ্রন্থগুলি লিখতে প্রচুর সময়ের দরকার ছিল। তাঁকে যে করেই হোক সময় বের করে নিতে হতো। এমনকি ব্যক্তিগত সুখ স্বাচ্ছন্দ্যের বিনিময়ে হলেও।
নির্ভীক নির্মোহ হয়ে ঘটনার বিবরণ ও ব্যক্তি চরিত্রের বিচার বিশ্লেষণ করা ঐতিহাসিকের অন্যতম কর্তব্য কর্ম। একদেশদর্শিতা এবং সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতা সঠিক ইতিহাসের অন্যতম প্রধান শত্রু। অধ্যাপক আবদুল করিম এ সমস্ত দোষ সযত্নে পরিহার করে চলতেন।অধ্যাপক আবদুল করিম যা লিখতেন খুব চিন্তাভাবনা করেই লিখতেন, বলা যেতে পারে সর্তক হয়েই লিখতেন। ঝোঁকের মাথায় মনগড়া তথ্য নিয়ে তিনি ইতিহাস লিখতেন না। এর ফলে তাঁর রচনা তথ্য নির্ভর বিভ্রান্তি মুক্ত,সমৃদ্ধ ও মূল্যবান হয়ে উঠেছে।
কেহ কেহ রসিকতা করে বলেন ইতিহাস মরা রাজার কাহিনী মাত্র। কথাটা একেবারে ভুল নয় কারণ অতীত কাহিনীর বর্ণনাই ইতিহাস আলোচনার প্রধান বিষয়। কিন্তু বর্ণনার গুণে মৃত ব্যক্তিরাও সজীব হয়ে উঠেন। অধ্যাপক আবদুল করিম ভাষার ব্যবহারে যথেষ্ট সচেতন ছিলেন। তাঁর রচনা রীতি স্বচ্ছ সাবলীল এবং প্রাণবন্ত। তাঁর রচনাবলী পাঠকদের মনযোগ আকর্ষণ করে।
ব্যক্তিগত জীবনে অধ্যাপক আবদুল করিম ছিলেন বন্ধু বৎসল এবং ছাত্র বৎসল। তিনি তাঁর বন্ধু চট্টল গবেষক আবদুল হক চৌধুরীর জীবন ও কর্মের উপর একটি গ্রন্থ লিখে বন্ধুত্বের মর্যাদা দিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক মফিজুল্লাহ কবিরের সাথে তাঁর আন্তরিক সম্পর্ক ছিল। সে সম্পর্ক এতই গভীর ছিল যে মফিজুল্লাহ কবির বিভাগের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে অধ্যাপক আবদুল করিমের সাথে পরামর্শ না করে সিদ্ধান্ত নিতেন না। তিনি সাধারণত ছাত্রদের তিরস্কার করতেন না, করলেও তা করতেন অত্যন্ত মৃদুভাষায়। তাঁর তত্ত্বাবধানে গবেষণা করে অনেক ছাত্র ছাত্রী পিএইচ.ডি.ডিগ্রী লাভ করেছেন। গবেষক ছাত্র ছাত্রীদের প্রতি তিনি অত্যন্ত সহানুভূতিশীল ছিলেন।
অধ্যাপক আবদুল করিম ইতিহাসকে ভালবাসতেন, ইতিহাস পড়তে ভালবাসতেন, ইতিহাস পড়াতে ভালবাসতেন, ইতিহাস লিখতে ভালবাসতেন। ইতিহাস চর্চায় তিনি মনপ্রাণ ঢেলে দিয়েছিলেন। ইতিহাস চর্চায় তিনি নিবেদিত প্রাণ ছিলেন। অধ্যাপক আবদুল করিমের সান্নিধ্য আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে, অহংকৃত করেছে। তাঁর ছাত্ররা তাঁকে স্মরণীয় করে রাখবে, তাঁর রচনাবলী তাঁকে অমরত্বদান করবে। কোনটি বড়, তাঁর ব্যক্তিগত কৃতিত্ব নাকি তাঁর রচিত গ্রন্থগুলি? কবির কথায় এর উত্তর দেওয়া যেতে পারে-
তোমার কীতির চেয়ে তুমি যে মহৎ
তাই তার জীবনের রথ
পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার
বারংবার।
(চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ আয়োজিত প্রফেসর আবদুল করিম স্মারক বক্তৃতা ২০২১এ পঠিত প্রবন্ধের অংশবিশেষ)

লেখক : প্রাক্তন প্রফেসর, ইতিহাস বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধসাতকানিয়া ও চন্দনাইশে দুই শিশুর মৃত্যু
পরবর্তী নিবন্ধআজাদী : ‘আঁরার সেরা পত্রিকা, আঁরা গর্ব’