পতেঙ্গা সৈকত রক্ষায় একগুচ্ছ সিদ্ধান্ত

কমছে পার্কিং ফি, দিতে হবে নিরাপত্তা।। তদারকে থাকবে ২৪ সেবক ।। ইজারা দেওয়া ৪৫ দোকানকে রাজস্ব খাতে আনা হচ্ছে

মোরশেদ তালুকদার | সোমবার , ১৬ জুন, ২০২৫ at ৮:১৪ পূর্বাহ্ণ

গত কয়েকদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ছবি নিয়ে আলোচনা চলছে সর্বত্র। ছবিটি ছিল, নগরের পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে গাড়ি পার্কিংয়ের ভাড়ার মূল্য তালিকা সম্বলিত একটি সাইনবোর্ড। বিভিন্ন ধরনের গাড়ির জন্য নির্ধারিত ভাড়ার অংকের পাশাপাশি ওই সাইনবোর্ডে লেখা আছে, ‘বিঃ দ্রঃ গাড়ি নিজ দায়িত্বে রাখুন’। পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে টাঙানো সাইনবোর্ডটির ছবি শেয়ার করে সাধারণ লোকজন প্রশ্ন তুলেছেন, নিরাপত্তা দিতে না পারলে পার্কিং ফি কেন নেওয়া হবে?

ছবিটি নজরে আসে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেনের। একইসঙ্গে গত ঈদুল আজহার দিন পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে গিয়ে তিনি দেখতে পান, সেখানে বেড়িবাঁধে মানুষের হাঁটা ও বসার জায়গায় অবৈধভাবে দোকানপাট বসানো হয়েছে। এরপর পতেঙ্গা বিচের সৌন্দর্য ফেরাতে উদ্যোগ নেন তিনি। এর প্রেক্ষিতে উচ্ছেদ করা হয় অবৈধ দোকানপাটগুলো। সর্বশেষ গতকাল সিডিএ, জেলা প্রশাসন এবং পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত এলাকার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে পার্কিং ফি কমানো এবং ইজারাদার কর্তৃক গাড়ির নিরাপত্তা নিশ্চিতসহ এক গুচ্ছ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।

এছাড়া সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, বেড়িবাঁধে জেলা প্রশাসনের ইজারা দেওয়া ৪৫টি দোকানকে রাজস্ব খাতে এনে এর আয় থেকে খরচ করা হবে বিচ ম্যানেজমেন্টে। বিশেষ করে সমুদ্র সৈকত এ স্থাপিত লাইটের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ, বিচের সৌন্দর্য রক্ষায় পরিচ্ছন্ন কার্যক্রমে এ টাকা খরচ করা হবে। এছাড়া তদারকির জন্য নিয়োগ দেওয়া হবে ২৪ জন সেবক। তারা তিন শিফটে কাজ করবেন সেখানে।

সং্‌শ্িলষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আগামী বুধবার সন্ধ্যা ৭টায় সার্কিট হাউজে বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সভা হবে। সেখানে আনুষ্ঠানিকভাবে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত রক্ষায় গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো চূড়ান্ত হবে। ওই সভায় চসিক, সিডিএ, জেলা প্রশাসন ছাড়াও স্থানীয় ব্যবসায়ী সমিতির চারজন প্রতিনিধি, দুজন স্থানীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ সংশ্লিষ্টরা উপস্থিত থাকবেন। বিষয়টি আজাদীকে নিশ্চিত করে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন।

গৃহীত সিদ্ধান্তগুলো : ডা. শাহাদাত হোসেন গতকাল বিকালে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত পরিদর্শনে যান। এ সময় উপস্থিত ছিলেন সিডিএ চেয়ারম্যান মোঃ নুরুল করিম, প্রধান প্রকৌশলী কাজী হাসান বিন শামস, জেলা প্রশাসন, ট্যুরিস্ট পুলিশ ও পতেঙ্গা থানা পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। পরিদর্শন শেষে সেখানে স্থানীয় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করে বিচ রক্ষায় এক গুচ্ছ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

কি কি সিদ্ধান্ত হয়েছে জানতে চাইলে শাহাদাত হোসেন আজাদীকে বলেন, বিচের প্রধান এলাকা যেখানে মানুষজন হাঁটে, বসে; সেখানে কোনো ধরনের স্থাপনা থাকবে না। সেখানে ব্যবসায়ীরা কোনো ধরনের চেয়ার, টেবিল বা ছাতা বসাতে পারবে না। সেটা সম্পূর্ণ ক্লিন রাখা হবে।

মেয়র আজাদীকে জানান, জেলা প্রশাসক সেখানে আগে থেকে ৪৫টি দোকান বরাদ্দ দিয়েছে। জেলা প্রশাসন একটা পার্কিংও ইজারা দেয়। সেখান থেকে যে আয় হবে সেটা সম্পূর্ণ বিচ ম্যানেজমেন্ট বা বিচ পরিষ্কারে খরচ হবে। এ আয় দিয়ে সেখানে বিদ্যুৎ বিলও পরিশোধ করা হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ওখানে যে লাইট আছে তার বিপরীতে মাসে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল আসে। এত টাকা সিডিএ পরিশোধ করতে পারছে না। সেজন্য জেলা প্রশাসনের বরাদ্দ দেওয়া ৪৫টি দোকান এবং পার্কিং ইজারাকে রাজস্বের আওতায় আনা হবে। ফলে এ আয় থেকে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করা যাবে এবং নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ নিশ্চিত করা হবে।

তিনি বলেন, এখানে প্রতি মাসে দুই থেকে আড়াই লাখ টাকা বিদ্যুৎ বিল আসে। সেটা সিডিএ দিতে পারছে না, তাই বিদ্যুৎ লাইন কেটে দেওয়া হয়েছে। এটা চট্টগ্রামবাসীর জন্য অত্যন্ত দুঃখজনক। আমরা সবাই মিলে কাজ করব, তখন এই দুঃখ আর আমাদের থাকবে না।

জেলা প্রশাসনের বরাদ্দ দেওয়া ৪৫ দোকানের বাইরে থাকা দোকানগুলো নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়েছে কিনা জানতে চাইলে বলেন, আরো প্রায় ১০০ থেকে ১৫০টি দোকান আছে সেখানে। এগুলোও রাজস্বের আওতায় আনা হবে। এ বিষয়ে ১৮ জুন সিদ্ধান্ত হবে। তবে আপাতত যেদিকে লোক কম হাঁটে, ৩ নং গেটের আপাতত দোকানগুলো করবে। তবে বিচের যে অংশে মানুষ বসে সেখানে না, তার পেছনে বসবে।

কমছে পার্কিং ফি, দিতে হবে নিরাপত্তা : সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পার্কিং ইজারাদারের জন্যও কিছু বিধিবদ্ধ নিয়ম থাকবে। ইজারাদার কারমাইক্রোর জন্য ৫০ টাকা এবং সিএনজি ও মোটরসাইকেলের জন্য ২০ টাকা ফি আদায় করতে পারবে। বর্তমানে কারমাইক্রোর জন্য ৭৫ টাকা এবং সিএনজি ও মোটরসাইকেলের জন্য ২৫ টাকা ছিল। বর্তমানে পার্কিং ফি নেওয়া হলেও কোনো নিরাপত্তা দেয় না। এখন থেকে ইজারাদারকে নিরাপত্তা দিতে হবে। একই সঙ্গে সেখানে যে ময়লাআবর্জনা পড়ে থাকে সেটা পরিষ্কারও করবে।

তদারকে থাকবে ২৪ সেবক : এখানে তিন শিফটে ২৪ জন সেবক নিয়োগ দেওয়া হবে। তারা সৈকতে কেউ কোনো অবৈধ স্থাপনা করছে কিনা সেটা দেখভাল করবে, সুন্দর রাখবে। এর বাইরে সেখানে ক্লিনিং এবং গার্ডেন করারও বিষয় আছে। এক প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, বিচের নিরাপত্তার জন্য ট্যুরিস্ট পুলিশ ও পতেঙ্গা থানার ওসিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে।

অন্য কোনো সিদ্ধান্ত আছে কিনা জানতে চাইলে মেয়র বলেন, সেখানে যে হোটেলগুলো আছে সেখানে মূল্য তালিকা টাঙিয়ে দেওয়ারও সিদ্ধান্ত হয়েছে, যাতে কেউ অতিরিক্ত দামি নিতে না পরে। আর যে বোটগুলো চলে সেখানে লাইফ জ্যাকেট থাকতে হবে। অন্যথায় তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মেয়র বলেন, সৈকতের আশপাশে দীর্ঘদিন ধরে গড়ে ওঠা অবৈধ দোকানগুলো জনসাধারণের চলাচলে বিঘ্ন ঘটাচ্ছিল। এসব দোকানে ভেজাল ও অস্বাস্থ্যকর খাবার বিক্রি হতো, যা দর্শনার্থীদের বিরূপ অভিজ্ঞতা দিচ্ছিল এবং সৈকতের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছিল। এই অবৈধ দখলের কারণে পরিবার নিয়ে বেড়াতে আসা মানুষের জন্য জায়গাটি অনুপযোগী হয়ে উঠেছিল। বেড়িবাঁধ দখল করে যারা ব্যবসা করছিল তারা সৈকতের পরিবেশের ক্ষতি করছিল। এখন সৈকত উন্মুক্ত করে দেওয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যতেও উন্মুক্তই থাকবে। কেউ বেআইনিভাবে দখল করার চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এক প্রশ্নের জবাবে মেয়র বলেন, এটা শুধু পতেঙ্গা বা চট্টগ্রামের নয়, এটা দেশের অন্যতম পর্যটন স্পট। বিদেশি যারা চট্টগ্রামে আসে তারাও এখানে আসতে চায়। কাজেই এখানে এসে দেশিবিদেশি কোনো পর্যটক কোনো ধরনের হেনস্থার শিকার হলে সেটা জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হবে।

জানা গেছে, জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ২০০৫ সাল থেকে পতেঙ্গাফৌজদারহাট পর্যন্ত বেড়িবাঁধ কাম আউটার রিং রোড নির্মাণের জন্য সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কাজ শুরু করে। ২০০৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে চুক্তি করে। দুবার সংশোধনের পর ব্যয় ধরা হয় ২ হাজার ৪২৬ কোটি ১৪ লাখ ৯৫ হাজার টাকা। এই প্রকল্পের আওতায় পতেঙ্গায় সাগরপাড়ে ৫ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে নির্মাণ করা হয়েছে পর্যটন কেন্দ্র।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকেউ ফিরেছেন খালি হাতে, কেউ পেয়েছেন অল্প মাছ
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামে অর্থঋণ আদালতের সংখ্যা বেড়ে ৩, নিয়োগ পেলেন বিচারকও