আমার গত লেখায় আমি লিখেছিলাম ‘গাল্ফ কো–অপারেশন কাউন্সিলের নেতাদের করতালিতে গাজার আহাজারি চাপা পড়ে গেছে’ এ লেখারও শিরোনাম দিতে ইচ্ছে হচ্ছিল ইসরাইলের ইরান আক্রমণের মাঝে বিশ্ব কূটনীতি কবরস্থ হয়েছে।
তেলআবিবের উত্তরের শহর হারজেলিয়া – এর নামকরণ করা হয়েছে ইহুদিবাদের জনক থিউডর হারজেলের নাম সেই শহরে ২০০৭ সালে প্রতিবছরের ন্যায় “ব্যালেন্স অব ইসরাইল’স সিকিউরিটি” সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সম্মেলনে ব্যতিক্রম হিসাবে প্রথমবারের মত আমেরিকান কৌশল প্রণেতা এবং নীতি নির্ধারকরা অংশগ্রহণ করে। এ সম্মেলনে ইসরাইলের ইতিপূর্বের সব হিসাব নিকাশ উল্টে দিয়ে সামনে নিয়ে আসে ইরানকে। সম্মেলনের স্বতঃসিদ্ধ সিদ্ধান্ত ফিলিস্তিনী বা আরব নয় ইরানই হবে ফিলিস্তিনীদের পক্ষে ইসরাইলের জন্য প্রধানতম হুমকি এবং বিনাশকারী শক্র। তারা আরও সিদ্ধান্তে আসেন ইসরাইলের প্রতি ইরানের পক্ষে এ হুমকি তখনই বাস্তবতা লাভ করবে যখন ইরান পারমানবিক শক্তিধর হবে। সুতরাং ইরানকে কোনো অবস্থাতেই পারমানবিক শক্তির অধিকারী হতে দেওয়া যাবে না। সেই থেকে ইরানকে লক্ষ্যবস্ত্তুতে রেখে পশ্চিমাদের যাবতীয় ষড়যন্ত্র–পরিকল্পনা। এরই ধারাবাহিকতায় ১৩ জুন ২০২৫ ভোর রাতে ইরানের উপর ইসরাইলের এক মারাত্মক আক্রমণ। এ আক্রমণ সমস্ত পৃথিবীর জন্য যে অভাবনীয় এবং সমূহ বিপদ ডেকে এনেছে তা ইতিপূর্বে কখনো ঘটেনি। ইসরাইল ইরানের মূল পারমাণবিক স্থাপনা নাথানজসহ সবগুলি পারমানবিক স্থাপনায় আঘাত হেনেছে।এসব কেন্দ্রে রয়েছে হাজার হাজার ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ সেন্ট্রিফিউজ যা ক্ষতিগ্রস্ত বা আক্রান্ত হলে এক অপ্রতিরোধ্য তেজস্ক্রিয় বিকিরণ জনমানুষের জীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলবে। ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বা নীতি নির্ধারকরা এবিষয়টি তোরাই তোয়াক্কা করে।
পারমানবিক স্থাপনাসমূহের বাইরে ইসরাইল তার নিখুঁত হামলা পরিচালনার মাধ্যমে ইরানী সামরিক বাহিনী প্রধান জেনারেল মোহাম্মদ বাঘেরী, ইরানী কেন্দ্রীয় সামরিক কমান্ডের প্রধান জেনারেল গোলাম আলী, ইরানী রেভ্যুলেশনারী গার্ডের প্রধান জেনারেল হোসেন সালামী সহ ছয় জন মুখ্য পরমানুবিজ্ঞানীকে হত্যা করে।
এ আক্রমণে ইসরাইল তার ২০০ (দুইশত) জঙ্গী বিমান ব্যবহার করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রী রুবিও ইসরাইলের ইরান হামলায় তার দেশ জড়িত নয় বলে বিবৃতি প্রধান করেছেন। তবে ইসরাইলীরা দাবী করছে আমেরিকাকে পুরাপুরি অবগতি এবং অনুমোদন সাপেক্ষে তারা এ হামলা পরিচালনা করেছে। মার্কিন প্রেসিডেন্ট অনেকটা ইরানের প্রতি তাচ্ছিল্য ভরে উচ্চারণ করেছেন, ‘ইরানকে আমি বহুবার সুযোগ দিয়েছি তারা চুক্তিতে আসেনি, এখনও ইরানের যা কিছু অবশিষ্ট আছে তা বাঁচাতে তাদের দ্রুত একটি চুক্তিতে আসা উচিত’। তিনি ইসরাইলে আক্রমণকে একসেলেন্ট বলতেও দ্ধিধা করেননি। অথচ ২০১৫ সালের ১৪ জুলাই ‘জে সি পি ও এ’ তথা ‘জয়েন্ট কম্প্রেএনসিভ প্ল্যান অব এ্যাকশান’ প্রণীত চুক্তি যা আমেরিকার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ওবামা ১৮ অক্টোবর ২০১৫ ‘জে সি পি ও এ’ এ্যাডাপশান ডে বা গ্রহণের দিন ঘোষণা করেন। পরবর্তীতে ১৬ জানুয়ারি ২০১৬ আই এ ই এ ঘোষণা করে ইরান চুক্তি সমস্ত শর্তপূরণ করেছে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ ‘জে সি পি ও এ’ কে অনুমোদন দেয়। এতদসত্ত্বেও সমস্ত কিছুকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখিয়ে তৎকালীন আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ‘জে সি পি ও এ’ থেকে তার দেশকে প্রত্যাহার করে নেয়। আর আজ ইতিহাসের নির্মম পরিহাস সেই ডোনাল্ড ট্রাম্প’ই বলছেন ‘ইরানকে আমি বহুবার সুযোগ দিয়েছি তারা চুক্তিতে আসেনি’। এ উপহাসের ব্যর্থ দোষারোপের রাজনীতি আমরাও করছি। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মোহাম্মদ ইউনুস ‘আর্থানা’ সম্মেলনে যোগ দিতে ২০ এপ্রিল ২০২৫ কাতারের রাজধানী দোহা পৌঁছেন।
২৩ এপ্রিল দোহায় রোহিঙ্গা বিষয়ক এক আলোচনায় প্রফেসর ইউনুস বক্তব্য রাখেন। তার বক্তব্যের এক জায়গায় তিনি উল্লেখ করেন রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে দীর্ঘদিন অবস্থানের কারণে তারা নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে।
প্রধান উপদেষ্টার এ বক্তব্যকে আমি অন্যভাবে অন্যদৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। যেমন রোহিঙ্গারা কি স্বেচ্ছায় বাংলাদেশে এসেছে? উত্তর একটাই, না। তাহলে তাদের এই দীর্ঘ অবস্থানও তাদের অনিচ্ছায়। এই প্রেক্ষাপটে আমি নির্ধিদ্বায় নিঃশ্চিতভাবে বলতে পারি এই দীর্ঘদিন রোহিঙ্গাদের তার জন্মভিটায় তথা তার দেশে ফিরতে না পারা প্রমাণ করে অপরাধ রোহিঙ্গারা করেনি করেছে তারা–
যারা রোহিঙ্গাদের স্বদেশ থেকে বিতাড়িত করেছে। অপরাধ করেছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়, রোহিঙ্গাদের স্বদেশে ফেরত পাঠাতে ব্যর্থতায়।
সম্মিলিতভাবে এ ক্ষেত্রে অপরাধী আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং মায়ানমারের শাসকগোষ্ঠী রোহিঙ্গাদের: ভবিষ্যৎ অন্ধকারে ঠেলে দেওয়ার জন্য, তাদের শিক্ষা চিকিৎসা বঞ্চিত করার জন্য, তাদের ক্যাম্পে অকারণ দীর্ঘ বন্দী জীবন যাপনে বাধ্য করার জন্য, অপরাধ করেছে আর্ন্তজাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গাদের প্রতি ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থতার দায়ে।
এমন এক পটভূমিতে প্রফেসর ইউনুস যদি বলতেন রোহিঙ্গাদের প্রতি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দীর্ঘ অমনযোগ আর অবহেলার দায়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নিজেদের ক্রমাগত অপরাধী করে যাচ্ছেন। আমার মনে হয় তবে তাই হত এক বিজ্ঞজনের উক্তি। এখন তা না হয়ে ভুক্তভোগী রোহিঙ্গারা হয়ে হয়ে গেলেন অপরাধী, ইতিহাসের নির্মম পরিহাস।
বিশ্বের সচেতন বিবেকবান মানুষদের আজ স্পষ্ট করে একথা বলার সময় এসেছে গাজার লক্ষ মানুষ হত্যার জন্য বেঁচে থাকাদের দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি দাঁড় করানোর জন্য, আলো পানি চিকিৎসা বন্ধ করার জন্য, ফিলিস্তিনে মানবতার চরম লঙ্ঘনের জন্য, নারী অবোধ শিশুসহ সকল মানুষকে অমানবিক এক দুঃসহ অবস্থায় ঠেলে দেওয়ার জন্য পৃথিবীর সভ্যতাদর্পী সবদেশ সব মানুষ সমানভাবে অপরাধী। আজ না হলেও আগামী বিশ্বের ইতিহাসে তাই লিখিত হবে।
ফিরে আসি ইরানের পারমানবিক সংকট বিষয়ে, এবং এ থেকে ভয় তাড়িত আমেরিকা ইসরাইল প্রসঙ্গে। আমেরিকা যখন আফগানিস্তানে তালেবানদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিমান আক্রমণ পরিচালনা করে যাচ্ছিল তখন ইরান আমেরিকানদের তাদের আকাম সীমা ব্যবহারে বাধা দেয়নি, হয়ত এরই ফলশ্রুতি তালিবানরা আগস্ট ১৯৯৮ মাজারে–শরীফ’এ আক্রমণ চালিয়ে হাজারা সম্প্রদায়ের কয়েক হাজার শিয়া সদস্যকে হত্যা করে একই সাথে এখানকার ইরানী কনস্যুলেট দখল করে ৯ ইরানী কূটনীতিককেও হত্যা করে। এমন প্রেক্ষাপটে ডিসেম্বর ২০০১ সালে জার্মানীর বনে তালেবানদের সাথে আমেরিকানদের বৈঠকে ইরান গুরুত্বপূর্ণ এবং গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে। ইরান তাদের এই ভূমিকার প্রতিদান হিসাবে আমেরিকা ইরানের সাথে একটি কার্যকর সম্পর্ক গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করবে বলে প্রত্যাশা করেছিল। ইরানীদের হতবাক করে সে বছরেই আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জর্জ ডাব্লিউ বুশ তার ইউনিয়ন ভাষণে ইরানকে, ইরাক এবং উত্তর কোরিয়ার সাথে ‘এক্সিস অব এভিল’ভুক্ত করে। এ থেকে প্রমাণ হয় যে সহযোগিতার হাত ইরান বাড়িয়েছিল তা আমেরিকা গ্রহণে অপ্রস্ত্তুত ছিল। কারণ ইসরাইল লবি তথা নিউকন বা নিউকনজার্ভেটিবরা যারা জায়ানবাদীদের কট্টর প্রতিনিধি এবং ক্যাপিটাল হিলে অত্যন্ত প্রভাবশালী তারা ইরানের সাথে আমেরিকার একটি কার্যকর সর্ম্পক গড়ে উঠুক তা চায়নি। এই নিউকনরাই গঠন করে ‘ন্যাশনাল কাউন্সিল অব রেসিস্ট্যান্স অব ইরান’ বা এন সি আর আই। এন সি আর আই’ কে আগস্ট ২০০২ সালে ইসরাইলী গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদ তথ্য প্রদান করে – ইরান ‘নাথানজ’ এবং ‘আরক’ এ দুটি আনবিক শক্তি কেন্দ্র নির্মাণ করে এখানে আনবিক বোমা তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছে।
এন সি আর আই’ এর মাধ্যমে এ খবর দ্রুত ইসরাইল আমেরিকায় ছড়িয়ে পড়ে এবং অভিযোগ করা হয় ইরান এন পি টি বা ‘পারমাণবিক অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তি’ ভঙ্গ করেছে।
এমন পরিস্থিতিতে ইরান ‘নাথানজ’ এবং ‘আরক’ এ আণবিক শক্তি কেন্দ্র নির্মাণ করার কথা স্বীকার করে। একই সাথে ইরানের যুক্তি তারা চুক্তি ভঙ্গ করেনি, কারণ চুক্তি অনুযায়ী পারমানবিক কেন্দ্র অপারেশনে গেলে কেবল তখনি আই এ ই এ ‘ইন্টান্যাশনাল এ্যাটমিক এর্নাজি অথরিটি’ কে জানানোর কথা। কিন্ত্তু তারা ত তখনও অপারেশেনে যায়নি। পাশ্চাত্য ইরানের এ কথায় কর্ণপাত না করে ইরানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পথে হাঁটতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে ইরান য়ুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, এবং জার্মানী’র সাথে আলোচনান্তে ২০০৩ এর অক্টোবরে একটি অতিরিক্ত প্রটোকলে স্বাক্ষর করতে সম্মত হয়। এই প্রটোকল বলে আই এ ই এ যে কোন সময় স্বল্প সময়ের নোটিশে ইরানের পারমাণবিক শক্তি কেন্দ্রগুলি পরিদর্শন করতে পারবে। একই সাথে পারমাণবিক জ্বালানী সমৃদ্ধকরণ বিষয়ে একটি চুড়ান্ত সিদ্ধান্তে না পৌঁছা পর্যন্ত ইরান ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ বন্ধ রাখতেও সম্মতি জ্ঞাপন করে। এতদসত্ত্বেও ইসরাইলী লবী নির্বিকার থাকেনি তারা আমেরিকার মাধ্যমে প্রিএ্যামটিব তথা শুরুতেই ধ্বংসনীতি অবলম্বন করতে ইরানে আক্রমণ পরিচালনা করতে নানান ফন্দি ফিকিরে থাকে। এ ধ্বংসনীতি কার্যকারণে ২০০৪ সালে ইসরাইল ৫০০ বাংকার বোমাও ক্রয় করে।
১৩ জুন ২০২৫ সে বোমা ব্যবহার করেই ইরান আক্রমণ। এরই মধ্যে ইরান ইসরাইলকে লক্ষ্য করে প্রতি আক্রমণ পরিচালনা করেছে। এখন আমাদের অপেক্ষায় থাকতে হবে ধ্বংসলীলা দেখার জন্য। (চলবে)
লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।