একজন শিক্ষার্থীর চোখে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভতির্র বাস্তবতা : বাংলাদেশে একটি সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যেন এক কঠিন যুদ্ধ। এই যুদ্ধে জয়ী হওয়ার অর্থ শুধু একটি আসন পাওয়া নয় –এটি আত্মবিশ্বাস, পরিবার, অধ্যবসায় এবং অগাধ পরিশ্রমের এক অনন্য জয়গাথা। আমার নিজের অভিজ্ঞতাও ঠিক এমনই। শুরু হয়েছিল কিছুটা ব্যর্থতা দিয়ে, আর শেষ হয়েছে এক অপার কৃতজ্ঞতায়। এই যাত্রা আমাকে শিখিয়েছে চেষ্টা কখনো বৃথা যায় না।
শুরুটা ছিল কঠিন : আমি মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ালেখা করলেও নম্বর খুব ভালো ছিল না। জিপিএ ৫ পেলেও নিজের কাঙ্খিত জায়গায় পৌঁছাতে পারিনি। ফলে উচ্চমাধ্যমিকে চলে আসি ব্যবসায় শিক্ষায়। শুরুতে বিষয়গুলোর বেসিক বোঝা কঠিন ছিল, কিন্তু বাবার ধৈর্য ও সহায়তায় ধীরে ধীরে তাল মিলিয়ে চলতে পারি। এইচএসসিতে আবারও জিপিএ ৫ পেয়ে আত্মবিশ্বাস ফিরে পাই।
প্রথম ধাক্কা : এরপর শুরু হয় ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি। একটি নামকরা কোচিং সেন্টারে ভর্তি হয়ে প্রস্তুতি নিতে থাকি। প্রথমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইবিএ–তে পরীক্ষা দিই। প্রস্তুতি ভাল ছিলনা বলে পরীক্ষা ভালো হয়নি। অতঃপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বি’ ইউনিটে পরীক্ষা দিই। লিখিত অংশে উত্তরে ক্রমিক নম্বর ভুল করার কারণে প্রাপ্ত নম্বর ৭২.৫ হলেও লিখিত অংশের বাংলায় উত্তীর্ণ হতে পারিনি। ভীষণ ভেঙে পড়েছিলাম। আবার শুনি ‘সি’ ইউনিটের প্রশ্নপত্রে ত্রুটি হয়েছে এবং সম্ভাব্য পুনঃপরীক্ষার গুঞ্জন চলছে। ঢাবির স্বপ্ন তখন প্রায় ধূলিসাৎ। ক্রমশঃ হতাশা যেন আমাকে ঘিরে ধরছিল।
আত্মবিশ্বাসের নতুন আলো : এই সময় বাবা–মা বার বার বলছিল “একটা পরীক্ষায় না হলে জীবন থেমে যায় না।” বাবা–মার সাহসী কথা আমাকে ভেঙে পড়তে দেয়নি। আমি আবার উঠে দাঁড়াই। নতুন লক্ষ্য স্থির করি: চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। প্রস্তুতি নেই, অন্য আরেকটি কোচিং এর অনলাইন প্ল্যাটফর্মে যুক্ত হই, রোজার মাসে রোজা রেখে রাতভর পড়াশোনা করতাম। তাহাজ্জুদের নামাজে চোখের পানি ফেলে আল্লাহর কাছে চাইতাম “হে আল্লাহ, একটা সুযোগ দাও।”
আশা ফিরে পাওয়া : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘বি’ ইউনিটে আমার র্যাংক আসে ৭৪৯। আত্মবিশ্বাস ফিরে পাই। এরপর ‘সি’ ইউনিটে ৪৫০তম র্যাংক পাই –অপেক্ষামান তালিকায় ছিলাম, তবুও আশাবাদী ছিলাম। সবচেয়ে অবাক করা ঘটনা ঘটে ‘ডি’ ইউনিটে –যার জন্য কোনো প্রস্তুতিই ছিল না, শুধু ক্লান্ত শরীরে অংশ নিই। র্যাংক আসে ১৮৮। তখন উপলব্ধি করি ভর্তি পরীক্ষায় মানসিক চাপই সবচেয়ে বড় বাধা। চাপ যত কম, পারফরম্যান্স তত ভালো।
ভর্তি ব্যবস্থার বাস্তব চিত্র: আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বাইরে আরও একটি বড় বাস্তবতা আছে। বাংলাদেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া মানে হাজার জনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে সোনার হরিণ খোঁজা। আসন সীমিত, অথচ আবেদনকারী হাজার হাজার। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা আলাদাভাবে হয়, ফলে শিক্ষার্থীদের একাধিকবার প্রস্তুতি নিতে হয়, মানসিক ও আর্থিক চাপ বহন করতে হয়।
এই ভোগান্তির সমাধান হিসেবে বহু শিক্ষাবিদ বহুদিন ধরে সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষার দাবি জানিয়ে আসছেন। ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল স্যারের মতো শিক্ষাবিদ এ বিষয়ে বহুবার প্রকাশ্যে লিখেছেন। তিনি এবং অনেকে মনে করেন ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগরসহ সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একক ভর্তি পরীক্ষা চালু করা উচিত। এতে সময়, অর্থ ও শ্রম বাঁচবে, মানসিক চাপ কমবে এবং প্রকৃত মেধার মূল্যায়ন সম্ভব হবে।
শেষ কথা : আজ আমি গর্বের সঙ্গে বলতে পারি আমি এখন চট্ট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ডি’ ইউনিটের অর্থনীতি বিভাগে ভর্তি হয়েছি। সব জল্পনা–কল্পনার অবসান ঘটিয়ে এই জায়গায় পৌঁছাতে পেরে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই আমার পরিবারকে, আমার শিক্ষকদের এবং সবচেয়ে বেশি আমার মহান স্রষ্টাকে।
আমার এই ভর্তিযাত্রা আমাকে শিখিয়েছে, জীবনে চলার পথে ব্যর্থতা আসতেই পারে, কিন্তু সেই ব্যর্থতার দেয়াল ভেঙে সামনে এগিয়ে চলাটাই প্রকৃত সাফল্য। একই সঙ্গে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার ভর্তিপর্বে প্রয়োজন একটি যুগোপযোগী, ন্যায্য এবং শিক্ষার্থীবান্ধব পরিবর্তন।
লেখক : শিক্ষার্থী, ১ম বর্ষ সম্মান শ্রেণি, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়