কক্সবাজারের চকরিয়ার উপকূলীয় ৭টি ইউনিয়নের প্রায় ১০ হাজার একর জমিতে ধান চাষসহ রকমারি সবজি উৎপাদনের জন্য একমাত্র মিঠা পানির উৎস হচ্ছে ছয় কিলোমিটার দীর্ঘ ‘ঢেমুশিয়া বদ্ধ জলমহাল’। এই জলমহালটি (বুড়া মাতামুহুরী নামেও পরিচিত) ভাটির দিকে সমুদ্র উপকূলের বিভিন্ন শাখা–প্রশাখা খালের সঙ্গেও সংযুক্ত। আর উজানের দিকে এই জলমহাল পার্বত্য অববাহিকার মাতামুহুরী নদীর একটি শাখা খাল। এজন্য এই জলমহালের লবণ ও মিঠা পানির সংমিশ্রণ নিয়ন্ত্রণ করা হয় উপকূলের স্লুইচ গেট দ্বারা।
এক যুগ আগেও এই জলমহালটি সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত ছিল। বিগত সরকারের আমলে রাজস্ব আহরণের নামে মিঠা পানির এই জলমহালটি তিন বছরের জন্য লিজ দেওয়ার নিয়ম চালু করা হয়। এতে সরকার কোটি টাকা রাজস্ব পেলেও সার্বিকভাবে ক্ষতি হয় শত কোটি টাকার। অভিযোগ রয়েছে, মিঠা পানির মৎস্য চাষের শর্তে এই জলমহাল লিজ দেওয়া হলেও সুযোগ বুঝে ইজারাদার স্লুইচ গেটের জলকপাট খুলে দিয়ে লবণ পানি প্রবেশ করায়। এতে পুরো জলমহালটি লবণাক্ত পানিতে টইটম্বুর হয়ে পড়ে। এই কারণে উপকূলীয় ৭ ইউনিয়ন সাহারবিল, পশ্চিম বড় ভেওলা, ঢেমুশিয়া, বদরখালী, কোনাখালী, পূর্ব বড় ভেওলা ও ভেওলা মানিক চর ইউনিয়নের ১০ হাজার একর জমিতে ধান চাষ ও রকমারি সবজি উৎপাদনে মিঠা পানির উৎস বন্ধ হয়ে যায়। এতে অর্ধ লক্ষাধিক কৃষক পরিবারের নেমে আসে চরম অনিশ্চয়তা।
সরেজমিন দেখা গেছে, উপকূলীয় অর্ধ লক্ষাধিক প্রান্তিক কৃষকের রুটি–রুজির একমাত্র অবলম্বন ঢেমুশিয়া বদ্ধ জলমহালে চিংড়ি উৎপাদনের স্বার্থে রাতের আঁধারে লবণাক্ত পানি ঢুকানো হচ্ছে বদরখালী ও কোনাখালী অংশের কয়েকটি স্লুইচ গেটের জলকপাট খুলে দিয়ে। এতে জলমহালের ওপর ভাসমান থাকা কচুরিপানাও লবণ পানিতে পুড়ে বিবর্ণ হয়ে পড়েছে। এই অবস্থায় চলতি শুষ্ক মৌসুমে ৭টি ইউনিয়নের প্রায় ১০ হাজার একর জমিতে চাষাবাদে জলমহালটির পানি আর ব্যবহার করা যাচ্ছে না।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সচেতন একাধিক ভুক্তভোগী কৃষক বলেন, মিঠা পানির মৎস্য চাষের শর্তে এই জলমহাল লিজ দেওয়া হয়ে থাকে। কিন্তু দেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এই জলমহালটির দখল–নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয় প্রভাবশালী হয়ে ওঠা একটি মহল। তারাই স্লুইচ গেটের কপাট খুলে দিয়ে রাতের আঁধারে এই জলমহালে দেদারছে সামুদ্রিক লবণাক্ত পানি প্রবেশ করাচ্ছে।
উপজেলা ভূমি অফিসের নিয়ন্ত্রণাধীন চিরিঙ্গা ইউনিয়ন উপ–সহকারী ভূমি কর্মকর্তা (তহসিলদার) আবুল মনছুরের ভাষ্য– পানি উন্নয়ন বোর্ডের কোনাখালী অংশের স্লুইচ গেটের বেশির ভাগ জলকপাটের (দরজা) এখন ভঙ্গুর দশা। এই কারণেই সামুদ্রিক জোয়ারের সময় লবণাক্ত পানি প্রবেশ করে ঢেমুশিয়া জলমহালে। এই বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ডকে জানানো হয়েছে।
পশ্চিম বড় ভেওলা ইউনিয়নের কৃষক আহমদ হোসেন, ঢেমুশিয়ার কৃষক সোহরাব লিমন, পূর্ব বড় ভেওলার রমিজ উদ্দিনসহ ভুক্তভোগী বেশ কয়েকজন কৃষক তাদের স্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে আগামীতে মিঠা পানির একমাত্র উৎস ঢেমুশিয়া বদ্ধ জলমহাল লিজ প্রদান প্রথা বন্ধ করার আহ্বান জানান। পাশাপাশি স্লুইচ গেটগুলোর টেকসই মেরামত এবং কঠোরভাবে নজরদারির আওতায় আনারও দাবি জানান।
চকরিয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এস এম নাসিম হোসেন দৈনিক আজাদীকে বলেন, উপকূলের ৭ ইউনিয়নের প্রধান সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে ঢেমুশিয়া বদ্ধ জলমহালে লবণ পানির প্রবেশ করানো। যা কোনোভাবেই মেনে নেওয়ার মতো নয়। কারণ এই জলমহালের মিঠা পানি দিয়ে প্রায় ১০ হাজার একর জমির চাষাবাদ নিশ্চিত করা হয়। এই পরিস্থিতিতে লবণ পানির কারণে চাষাবাদ করা না গেলে কৃষকেরই ব্যাপক ক্ষতি হবে। এজন্য ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
চকরিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মদ আতিকুর রহমান বলেন, সমুদ্র উপকূলের যত স্লুইচ গেট রয়েছে তা সরেজমিন পরিদর্শন করা হয়েছে। যেসব স্লুইচ গেটের জলকপাট ভঙ্গুর অবস্থায় রয়েছে তা অতি দ্রুত মেরামত করার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাকে বলা হয়েছে।