শেখ হাসিনার শাসনামলে দেশে প্রতি বছর গড়ে ১৬ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়েছে বলে অন্তর্বর্তী সরকারের করা অর্থনীতি নিয়ে শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। গতকাল রোববার এই প্রতিবেদন জমা পড়ে বলে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে প্রকাশিত এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়।
এদিন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে এই প্রতিবেদন হস্তান্তর করেন শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। কমিটির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আজ সোমবার পরিকল্পনা কমিশনে সংবাদ সম্মেলন করে এই প্রতিবেদনের বিস্তারিত জানানো হবে। খবর বিডিনিউজের।
খসড়া প্রতিবেদনে বলা হয়, গত এক দশকে কেবল ভিসা পেতে রিক্রুটিং এজেন্সিগুলোর মাধ্যমেই হুন্ডি করে ১ লাখ ৩৪ হাজার কোটি টাকা অর্থ সরানো হয়েছে; যা দিয়ে ৪টি এমআরটি–৬ (উত্তরা–মতিঝিল) নির্মাণ করা যেত। আওয়ামী লীগ সরকার আমলে ব্যাংক খাতে অনিয়ম নিয়ে বলা হয়, রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত ঋণ প্রদানের অনুশীলন ব্যাংকিং খাতের সংকটকে গভীরতর করেছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সম্পদের পরিমাণ এতটাই বেশি যে, তা দিয়ে ১৪টি ঢাকা মেট্রো সিস্টেম বা ২৪টি পদ্মা সেতু নির্মাণ করা সম্ভব হতো। তবে রাজনৈতিক প্রভাবে দেওয়া ঋণে ক্ষতি হওয়া অর্থ ও সম্পদের পরিমাণ উল্লেখ করা হয়নি। বিপুল পরিমাণে খেলাপি ঋণ জমে যাওয়ায় এ খাতটির কার্যকারিতা ও সুশাসনের অভাব প্রকাশ পায় বলে এতে উল্লেখ করা হয়।
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নেওয়া মেগা প্রকল্প নিয়ে প্রতিবেদনের ভাষ্য হচ্ছে, এসব প্রকল্পে দুর্নীতির ফলে গড়ে ৭০ শতাংশ খরচ বেড়েছে এবং এসব প্রকল্পের মেয়াদ গড়ে পাঁচ বছরের বেশি সময় পিছিয়েছে। এতে বাড়তি যে ব্যয় হয়েছে বা নষ্ট হয়েছে তার ব্যাপারে বলা হয়, গত ১৫ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি ও উন্নয়ন প্রকল্পে ৬০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে, এর মধ্যে ১৪ থেকে ২৪ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ৬১ হাজার কোটি টাকা থেকে ২ লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকা রাজনৈতিক চাঁদাবাজি, ঘুষ এবং বাজেট বাড়িয়ে দেখানোর কারণে নষ্ট হয়েছে।
প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, শেখ হাসিনার শাসনামলের দুর্নীতি, লুণ্ঠন এবং ভয়ংকর রকমের আর্থিক কারচুপির যে চিত্র রিপোর্টে পাওয়া গেছে তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো। ‘ডিসেকশন অফ এ ডেভেলপমেন্ট ন্যারেটিভ’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি শিগগিরই জনসাধারণের জন্য প্রকাশ হবে বলে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে জানানো হয়েছে।
শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটিকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এটি চূড়ান্ত হওয়ার পর এটি জনসাধারণের জন্য প্রকাশ করা উচিত এবং স্কুল–কলেজ–বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে অন্তর্ভুক্ত করে শিক্ষার্থীদের পড়ানো উচিত। এটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। জুলাই–আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের পর অর্থনীতিকে যে ভঙ্গুর দশায় আমরা পেয়েছি তা এই রিপোর্টে উঠে এসেছে। জাতি এই নথি থেকে উপকৃত হবে।
ইউনূস বলেন, আমাদের গরিব মানুষের রক্ত পানি করা টাকা যেভাবে তারা লুণ্ঠন করেছে তা আতঙ্কিত হওয়ার মতো। দুঃখের বিষয় হলো, তারা প্রকাশ্যে এই লুটপাট চালিয়েছে। আমাদের বেশিরভাগ অংশই এর মোকাবিলা করার সাহস করতে পারেনি। শেখ হাসিনার শাসনামলকে ভয়ের রাজত্ব উল্লেখ করে তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি পর্যবেক্ষণকারী বহুপাক্ষিক সংস্থাগুলোও এই লুণ্ঠনের ঘটনায় অনেকাংশে নীরব ছিল।
সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ ছাড়াই কমিটি স্বাধীনভাবে কাজ করেছে বলে মন্তব্য করেন শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটির প্রধান দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেন, সমস্যাটি আমরা যতটা ভেবেছিলাম তার চেয়েও গভীর। এই ৩০ অধ্যায়ের ৪০০ পৃষ্ঠার দীর্ঘ শ্বেতপত্রে উঠে এসেছে কীভাবে ক্রোনি পুঁজিবাদ অলিগার্কদের জন্ম দিয়েছে, কীভাবে তারা নীতি প্রণয়ন নিয়ন্ত্রণ করেছে।
কমিটির সদস্য মুস্তাফিজুর রহমান জানান, তারা ২৯টি প্রকল্পের মধ্যে সাতটি বড় প্রকল্প পরীক্ষা করে দেখেছেন প্রতিটিতে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে। ২৯টি বড় প্রকল্পে মোট ব্যয় হয়েছে ৮৭ বিলিয়ন ডলার বা ৭ লাখ ৮০ হাজার।
পরীক্ষা করা সাতটি প্রকল্পের আনুমানিক প্রাথমিক ব্যয় ছিল ১ লাখ ১৪ হাজার কোটি টাকা। অতিরিক্ত উপাদান যোগ করে, জমির দাম বেশি দেখিয়ে এবং ক্রয়ের ক্ষেত্রে হেরফের করে প্রকল্পের ব্যয় সংশোধিত করে ১ লাখ ৯৫ হাজার কোটি টাকা করা হয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি। মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ব্যয়ের সুবিধা বিশ্লেষণ না করেই প্রকল্পের ব্যয় প্রায় ৭০ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে।
কমিটির আরেক সদস্য অধ্যাপক এ কে এনামুল হক বলেন, গত ১৫ বছরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) ৭ লাখ কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে এবং এর ৪০ শতাংশ অর্থ আমলারা লুটপাট করেছে।
সদস্য মোহাম্মদ আবু ইউসুফ বলেন, বিগত শাসনামলে কর অব্যাহতির পরিমাণ ছিল দেশের মোট জিডিপির ৬ শতাংশ। এটি অর্ধেকে নামিয়ে আনা গেলে শিক্ষা বাজেট দ্বিগুণ এবং স্বাস্থ্য বাজেট তিন গুণ করা যেতে পারত।
সদস্য ম তামিম বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনে ৩০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছে। ১০ শতাংশ যদি অবৈধ লেনদেন ধরা হয়, তাহলে পরিমাণ হবে কমপক্ষে ৩ বিলিয়ন ডলার।