অঙ্গীকার ছিল ‘নগরপিতা নয়, নগরসেবক হতে চাই’। নিরাপদ ও সাম্য–সম্প্রীতির চট্টগ্রাম গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে জলাবদ্ধতামুক্ত পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্য–শিক্ষাবান্ধব ও তথ্যপ্রযুক্তি সমৃদ্ধ নান্দনিক পর্যটন নগর গড়ার লক্ষ্যে নির্বাচনী ইশতেহারে প্রতিশ্রুতি ছিল ৭৫টি। ২০২১ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) নির্বাচনের পূর্বে এসব প্রতিশ্রুতি দেন বিএনপির মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন। যিনি আজ মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে বসবেন নগরপিতার আসনে। এর মধ্য দিয়ে তার সামনে সুযোগ তৈরি হল সেই নির্বাচনী অঙ্গীকার রক্ষার। অথচ চসিকের বর্তমান পর্ষদের মেয়াদ শেষ হবে আর মাত্র ১ বছর ৩ মাস ১৬ দিন পর। অর্থাৎ প্রতিশ্রতি রক্ষায় খুব বেশি সময় পাচ্ছেন না শাহাদাত। এর ফলে কিছুটা চ্যালেঞ্জেরে মুখেও পড়তে হবে তাকে।
তাছাড়া এমন সময়ে দায়িত্ব নিচ্ছেন তিনি যখন কাউন্সিলর শূন্য চসিক। অবশ্য চসিক পরিচালনায় গত ২৬ সেপ্টেম্বর ২০ সদস্যের একটি কমিটি করে দিয়েছে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। কমিটির ১৮ জন সদস্যই সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে কর্মরত। তারা নিজ নিজ দপ্তরেই ব্যস্ত থাকেন। তাই তারা চসিকে পর্যাপ্ত সময় দিতে পারছেন না। ফলে অনেকটা একাই চসিক সামলাতে হবে শাহাদাতকে। আবার দীর্ঘদিন মেয়র না থাকায় ভেঙে পড়েছে চসিকের প্রশাসনিক ‘শৃঙ্খলা’। সেটা পুনরুদ্ধারও চ্যালেঞ্জ হবে মেয়রের জন্য।
অবশ্য কম সময়েও নানা চ্যালেঞ্জ এবং প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্য পূরণে কাজ করবেন বলে আজাদীকে জানিয়েছেন ডা. শাহাদাত। তিনি বলেন, চ্যালেঞ্জ থাকবে। সেগুলো মোকাবিলা করেই এগিয়ে যাব। দায়িত্ব নিয়ে কিছু কাজ অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করতে চান বলেও জানান তিনি। চট্টগ্রামকে ক্লিন, গ্রিন এবং হেলদি সিটিতে রূপান্তরে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দিয়ে কাজ করব। ডা. শাহাদাত হোসেন আজাদীকে বলেন, এ মুহূর্তে যে কাজগুলো করা বেশি জরুরি সেগুলো করব। বর্তমানে ডেঙ্গুর প্রকোপ বেড়েছে। শহরের রাস্তাঘাটের অবস্থা বেশি খারাপ, নষ্ট হয়ে গেছে, এতে জনদুর্ভোগ বাড়ছে। কাজেই মশক নিধন এবং ভাঙা রাস্তাঘাট সংস্কার অগ্রাধিকার পাবে। ইতোপূর্বে যেসব কাজ হয়েছে তার মান কেমন ছিল সেটাও দেখব। এছাড়া জোর থাকবে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতার বিষয়টিও। শহরের অনেকগুলো সড়কবাতি ঠিক নেই। অনেক জায়গা অন্ধকার। আমি নিজে পরিদর্শন করে দেখব। শহরের আলোকায়নের বিষয়টিও প্রাধান্য পাবে।
মেয়র বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে কিছু প্ল্যান আছে। সেকেন্ডারি কিছু স্টেশন (এসটিএস) করব। বাসা–বাড়ি থেকে ময়লা সংগ্রহ করে এনে এসব স্টেশনে রাখা হবে। যেখানে–সেখানে ময়লা–আবর্জনা রাখলে দুর্গন্ধ ছড়ায়। এসটিএস থেকে দুর্গন্ধ ছড়ায় না। ওয়েস্ট প্রোডাক্টস ম্যানেজমেন্ট প্ল্যান আছে। এক্ষত্রে উন্নত পরিচ্ছন্ন বিভাগে প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি সংযোজন, ডাস্টবিন আধুনিকায়ন করা, বাসা–বাড়ি থেকে সংগৃহীত বর্জ্য নির্দিষ্ট স্থানে ফেলার ব্যবস্থাসহ বর্জ্যকে রি–সাইক্লিং করার পরিকল্পনা আছে।
নতুন একটি বাস টার্মিনাল করার পরিকল্পনা আছে জানিয়ে শাহাদাত বলেন, কর্ণফুলী ব্রিজ গোলচত্বরে সবসময় যানজট লেগে থাকে। এ যানজট নিরসনে একটি বাস টার্মিনাল করার পরিকল্পনা আছে। এ জন্য আমি মনে মনে জায়গা খুঁজছি। কুলগাঁওয়ে সিটি কর্পোরেশনের একটি বাস–ট্রাক টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্প আছে। এটার কাজ মনে হয় একটু ধীরগতি হয়ে গেছে। সেটার কাজও যেন দ্রুত শেষ হয় সেদিকে নজর থাকবে। চসিককে স্বাবলম্বী করার পরিকল্পনা সর্ম্পকে জানতে চাইলে বলেন, আয়বর্ধক প্রকল্প হাতে নিবে। হালিশহর ফইল্যাতলীতে একটি কিচেন মার্কেটের কাজ চলছে। সেটার কাজ দ্রুত শেষ করার চেষ্টা থাকবে।
কাউন্সিলর ছাড়া কাজ করা প্রসঙ্গে বলেন, একটি কমিটি তো আছেই। তারা প্রশাসনিক কাজে সহযোগিতা করবেন। এছাড়া এলাকাভিত্তিক বিএনপিসহ অন্যান্য দল ও পেশাজীবীদের মধ্যে যারা সচেতন তাদের নিয়ে কাজ করার পরিকল্পনা আছে। এরপরও যদি সদস্যা দেখি সেটা মন্ত্রণালয়কে জানাব।
সময় মাত্র ১৩ মাস : স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯ এর ৬ নম্বর ধারায় বলা আছে– ‘কর্পোরেশনের মেয়াদ হবে কর্পোরেশন গঠিত হওয়ার পর অনুষ্ঠিত প্রথম সভার তারিখ তারিখ থেকে পাঁচ বছর’। এদিকে চসিকের ষষ্ঠ পরিষদের প্রথম সভা হয়েছে ২০২১ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি। ওই হিসেবে এ পর্ষদের মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখ ছিল ২০২৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। আজকেসহ ইতোমধ্যে ৩ বছর ৯ মাস ১৪ দিন পেরিয়েছে। বাকি আছে ১ বছর ৩ মাস ১৪ দিন।
স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন ২০০৯ এর ৩৪ নং ধারা অনুযায়ী, কর্পোরেশনের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ববর্তী ১৮০ দিনের মধ্যে নির্বাচন আয়োজন করতে হয়। অর্থাৎ বর্তমান অন্তবর্তীকালীন সরকার চসিকের ৭ম পর্ষদের নির্বাচন আয়োজন করতে চাইলে ২০২৫ সালের ২২ আগস্ট থেকে ২০২৬ সালের ২২ ফেব্রয়ারির মধ্যে আয়োজন করতে পারবে। ওই নির্বাচনে মেয়র পদে প্রার্থী হতে চাইলে পদত্যাগ করতে হবে ডা. শাহাদাত হোসেনকে। তখন ১ বছর ৩ মাস ১৬ দিনেরও কম সময় দায়িত্ব পালনের সুযোগ পাবেন তিনি।
চট্টগ্রামে আসবেন আজ : আজ সকালে মহানগর প্রভাতী ট্রেন যোগে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা করবেন এবং বেলা ১২টায় চট্টগ্রামে এসে পৌঁছানোর কথা মেয়রের। চট্টগ্রাম রেল স্টেশনে তিনি দলের নেতাকর্মী ও সুধীজনের উদ্দেশে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখবেন। এরপর হযরত আমানত শাহ (রা.) ও হযরত বদর শাহ (রা.) মাজারে গিয়ে জিয়ারত করবেন। তারপর তিনি লালদিঘি পাড় সংলগ্ন চসিকের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনের সম্মেলন কক্ষে চসিকের কর্মকর্তা কর্মচারীদের সাথে মতবিনিময় করবেন এবং সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখবেন। এরপর তিনি টাইগারপাস চসিক কার্যালয়ে ভবনে যাবেন, সেখানে দোয়া মাহফিলে অংশগ্রহণ শেষে আনুষ্ঠানিকভাবে মেয়রের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় চসিকের ষষ্ঠ পরিষদের নির্বাচন। এ নির্বাচনে ভোটার ছিলেন ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৬ জন। নির্বাচনে ভোট পড়ে মাত্র ২২ দশমিক ৫২ শতাংশ। নির্বাচনে ‘ধানের শীষ’ প্রতীকে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ডা. শাহাদাত। তিনি ৫২ হাজার ৪৮৯ ভোট পান। তবে আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী মো. রেজাউল করিম চৌধুরীকে ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৪৮ ভোট দোখিয়ে নির্বাচিত ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। একই বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি শপথ নেন এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্বগ্রহণ করেন রেজাউল করিম।
এদিকে ২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ডা. শাহাদাত ৯ জনকে বিবাদী করে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা করেন। গত ১ অক্টোবর চট্টগ্রামের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের বিচারক খাইরুল আমিন ডা. শাহাদাতকে মেয়র ঘোষণা করে এ মামলার রায় দেন। রেজাউল করিম চৌধুরীর মেয়র নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করেন। পাশাপাশি ১০ দিনের মধ্যে প্রজ্ঞাপন জারির জন্য নির্বাচন কমিশন সচিবকে নির্দেশ দেন। এরপর ৮ অক্টোবর ডা. শাহাদাত হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করে সংশোধিত প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন। সর্বশেষ ৩ নভেম্বর শপথ বাক্য পাঠ করেন তিনি। এর আগে সরকার পতনের পর ১৯ আগস্ট চট্টগ্রামসহ দেশের ১২ সিটি কর্পোরশনে প্রশাসক নিয়োগ দেয়া হয়। পরবর্তীতে প্রজ্ঞাপন সংশোধন করে ১৭ অক্টোবর চসিক থেকে প্রশাসক বাদ দেয়া হয়।