দুর্গাপূজাকে আমরা বলি শারদীয় উৎসব। উৎসবই বটে। প্রকৃতিতে যেমন তেমনি মনে, পোশাকে, ঘরে–সমাজে সর্বত্র আনন্দ আর আগমনী খুশি ছড়িয়ে পড়তো একসময়। দিন যায় সময় যায়। উৎসবের আমেজ বা রং ও বদলায়। ষাট সত্তর বা আশির দশকের পূজা আর আজকের পূজা এক নয়। বিগত কয়েকবছরে বেশ ক‘বার দেশে থাকার সুবাদে আমার অভিজ্ঞতা হয়েছে পূজা দেখার। এখন আর আগের সাত্ত্বিক নিয়ম বা নির্মল উদযাপন নাই। চাকচিক্য মাইকিং ঢাক ঢোলের আওয়াজে চাপা পড়ে থাকা মূল বিষয় উঠিয়ে আনাই এখন দুঃসাধ্য। তবে এটা ঠিক গেল ক‘বছরে যে জৌলুশ আর চাকচিক্য দেখেছি তা আগের যে কোন সময়কে হার মানায়।
কথা তা নিয়ে নয়। কথা হচ্ছে এখন যখনই দুর্গা পূজার সময় এগিয়ে আসে আমরা টের পাই ভিন্ন ভাবে। আসার কিছুদিন এমন কি মাসাধিক কাল আগেই প্রতিমা বানাতে হয়। মাটির প্রতিমায় প্রাণ সঞ্চার করা সহজ কিছু না। মূলত মৃৎশিল্পী নামে পরিচিতজনেরা এই কাজটি শুরু করেন আগে থেকে। এখন আমরা মিডিয়া বা সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাঙা মূর্তি মুখ থুবড়ে পড়া শরীর থেকে হাত পা বা মাথা বিচ্ছিন্ন মূর্তি দেখে জানি যে পূজা আসছে। এই অনিয়ম বা অসঙ্গতি কিন্তু আওয়ামী আমলেও চলমান ছিল। বেশিই ছিল। এ বিষয়ে নালিশ জানালে তিনি বলতেন, আপনারা তো দু নৌকায় পা দিয়ে চলেন। দেশের হিন্দু সমাজের প্রতি এমন বিদ্বেষপ্রসূত মন্তব্য করা তিনি আজ কোথায়? তিনি নিজেও আরেক নৌকায় বসে আছেন। মূল কথা হচ্ছে তখন এসব বিষয়কে তুচ্ছ বা কিছু হয় নি বলাটাই ছিল রেওয়াজ। একটা কথা বুঝতে হবে নিজে ভালো থাকার জন্য বা নিজেদের নিরাপদ ভাবার জন্য সংখ্যালঘুর একাংশকে ব্যবহার করা এক বিষয় আর সার্বিক মঙ্গল কামনা ভিন্ন বিষয়। আমাদের সমাজে রাষ্ট্রে বেশীর ভাগ মানুষ ধার্মিক কিন্তু তারা সামপ্রদায়িক নন। সামপ্রদায়িক হলে কলকাতার চাইতে ধুমধামে পূজা করা সম্ভব হতো না। এমন কোন গ্রাম উপগ্রাম নাই যেখানে দুর্গাপূজা হয় না। আমাদের জীবনের সাথে মিশে যাওয়া এই পূজা এবার যেন নির্বিঘ্নে হয় সে বিষয়ে অন্তবর্তী সরকারের সুস্পষ্ট মনোভাব ভালো লেগেছে। তাঁরা তাঁদের যথাসাধ্য করার কথা বলেছেন। সমস্যা অন্যত্র।
উসকানি বিষয়টি বাংলাদেশীদের এখন মজ্জাগত। সাথে জুটেছে সোশ্যাল মিডিয়া। এই সামাজিক মিডিয়া যে আসলে মিডিয়া না এটা কেউ বোঝে না। যেখানে ন্যায় অন্যায় উচিৎ অনুচিত বিবেচনার আগেই কিছু লিখে দেয়া যায় বা বলে মানুষকে উত্তেজিত করা যায় তা কি আসলে কোন মিডিয়া হতে পারে? সত্যিকারের মিডিয়া হচ্ছে সত্য ভাষণ আর সঠিক প্রশ্ন তোলার কারিগর। সে জায়গাটা সামাজিক মিডিয়ায় নাই। যে কারণে উৎসব নামের এক যুবককে আমরা প্রায় মরতে মরতে বাঁচতে দেখলাম। সে এখন কোথায় আছে কেমন আছে জানি না। শুধু এটুকু বিশ্বাস করি সে ভালো আছে। নিরাপদ আছে।
উৎসব একটি প্রতীক এখন। উৎসব করতে হলে উৎসবকে ভালো থাকতে হবে । আমরা যুগপৎ আনন্দিত ও গর্বিত হতেই পারি যে দুর্গাপূজার সূচনা ঘটেছিলো আজকের স্বাধীন বাংলাদেশের ভৌগোলিক অঞ্চলে। দুর্গাপূজা আজ সারা বিশ্বের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে প্রাণময় এবং একই সাথে ভক্তিভরে উদযাপিত পূজা হয়ে ওঠেছে। বাংলাদেশে সূচীত দুর্গা পূজাই ইউনেস্কোর শিল্প ও ঐতিহ্যবাহী উৎসবের তালিকাভুক্ত হয়েছে। যদিও কোলকাতার দুর্গা পূজাকে ইউনেস্কো ঐতিহ্যবাহী উৎসবের তালিকাভুক্ত করেছে তবে এ’কথা মনে রাখা উচিৎ শারদীয় দুর্গাপূজার প্রচলন হয়েছিলো এই সুবর্ণ ভূমিতেই। কলকাতার দুর্গাপূজা বিশ্বজনীন হলে সারা পৃথিবীর দুর্গাপূজাই বিশ্বজনীন হয়ে পড়ে। মা দুর্গা সারা বিশ্বের সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে সমান ভক্তিসহকারে পূজিত হন। উৎসব, আনন্দ, পূজার প্রক্রিয়া সারা বিশ্বে একই রকম।
শারদীয় দুর্গাপূজার দুটি বিশেষ দিক রয়েছে একটি হলো পূত পবিত্র মন নিয়ে শাস্ত্রীয় বিধি অনুসরণ করে পূজা উদযাপন এবং আর একটি দিক হলো সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম। দুর্গাপূজার সামজিকও সাংস্কৃতিক অনুসঙ্গগুলো কী? দুর্গাপূজা সাধারণত সমাজের সকল স্তরের মানুষের সম্মিলনে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। পূজা অনুষ্ঠানের জন্য ঢাকী, প্রতিমা শিল্পী, সঙ্গীত শিল্পী, লেখক, চিত্রশিল্পীসহ সমাজের সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষের এক অসাধারণ সামাজিক সংহতি তৈরি হয়। এই সামাজিক সংহতি ই উৎসবকে প্রানবন্ত করে তোলে। হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খৃষ্টান এমন কি অবিশ্বাসীর ও সমান অধিকার আছে উৎসবে অংশ নেয়ার। এটাই সংহতি।
এখন মনে যে প্রশ্নটি আলোড়ন তোলে আমাদের সমাজে কি পূজা আসবে না সাথে উৎসব ও? আজকের বাংলাদেশ ক্রান্তিকােেলর এক বাংলাদেশ। অভূতপূর্ব জাগরণ আর উল্লাসে যে অনাচার ভেসে গেছে তাকে আর ফেরত চায় না সাধারণ মানুষ। আত্মম্ভরী একনায়ক একদর্শী চিন্তা আর এক ই বিষয় থেকে মুক্তির জন্য আকুলতাই স্বাধীনতা। সে কাজটি এবার হয়েছে বলেই শুনছি। সে সমাজে তাহলে কেন হানাহানি আর আক্রমণ দানা বাঁধবে? মানুষ যা চায় তাই তো হয়েছে। তাহলে এখন বেছে বেছে শিকার করা বন্ধ হোক। সুসময়ের জন্য আকুল উৎসব পালনে ব্যাকুল মানুষের মনে শান্তি ফিরিয়ে দিন।
বহুকাল আগে কনফুসিয়াস একটি দামী কথা বলেছিলেন, সুশাসন বিষয়ে তাঁর কথা ছিল, এই সুশাসন মূলত মন্দ মন্দ প্রবাহিত বাতাসের মতো। যখন সে বয়ে যায় মানুষের মন শান্ত হয়। চিত্ত আমোদিত হয়। প্রকৃতিতে ঢেউ খেলে যায়, সে বাতাসএ দুর্বিনীত ঘাস গাছপালাও মাথা নুইয়ে তাকে স্বাগত জানায়। কী চমৎকার সে উদাহরণ।
উৎসব প্রিয় বাঙালির জীবনে দুর্গাপূজার আরেক নাম শারদীয় উৎসব। জেনে অবাক হবেন এই পূজার সূচনা ছিল চট্টগ্রামের পাহাড়ে এক আশ্রমে। পুরাণে লিখিত হয়েছে যে, পুরাকালে রাজ্যহারা রাজা সুরথ এবং স্বজনপ্রতারিত সমাধি বৈশ্য একদিন মেধস মুনির আশ্রমে যান। সেখানে মুনির পরামর্শে তাঁরা দেবী দুর্গার পূজা করেন।
আমরা ঐতিহ্য আর গৌরবের অংশীদার বাংলাদেশী। আমাদের দেশে রাজনৈতিক ঘাত প্রতিঘাত আছে থাকবে। কিন্তু সবার ওপরে সমাজ আর মানুষ। দুর্গাপূজা যেন উৎসবের নিরাপত্তা দিয়ে উৎসব হয়েই আসে। তা না হলে প্রশ্ন থাকবে, পূজা এলে কি উৎসব ও আসে সাথে। উৎসবে পূর্ণ হোক বাঙালির জীবন।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট।