হতাশার সকালের পর টাইগারদের স্বপ্নময় দিন

রাওয়ালপিন্ডি টেস্টের তৃতীয় দিন লিটন-মিরাজের বিশ্বরেকর্ড জুটি

ক্রীড়া প্রতিবেদক | সোমবার , ২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ at ৭:২৯ পূর্বাহ্ণ

রাওয়ালপিন্ডিতে বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেটের পালে যেন দারুণ হাওয়া লেগেছে। প্রথম টেস্টে জয়ের পর দ্বিতীয় টেস্টের প্রথম দিনটা বৃষ্টি কেড়ে নিলেও পরের দুদিন যেন রাজত্ব করেছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে তৃতীয় দিনটা ছিল বাংলাদেশের জন্য সাফল্য মোড়ানো। অনেক রেকর্ডে ভরা।

গতকাল সকালটা ছিল টাইগারদের জন্য হতাশার। পাকিস্তানের প্রথম ইনিংসের ২৭৪ রানের জবাব দিতে নেমে বাংলাদেশ প্রথম আধ ঘণ্টাতেই খাদের কিনারায় পড়ে যায়। বলা যায়ম্যাচ থেকে ছিটকে পড়েছিল। ২৬ রান তুলতে ৬ উইকেট হারিয়ে ফেলা দলে আর থাকে কী? কিন্তু ধ্বংসস্তূপ থেকেও ভাল কিছু সৃষ্টি হতে পারে। যেমনটি হয়েছে গতকাল রাওয়ালাপিন্ডিতে। আর এই বিস্ময়ের জন্ম দিয়েছেন বাংলাদেশের দুই ব্যাটার মেহেদী হাসান মিরাজ আর লিটন দাশ। দুঃস্বপ্নেই দারুণভাবে স্বপ্নের সৌধ গড়ে তুললেন দুজন। গড়লেন ইতিহাস, নাম তুললেন রেকর্ড বইয়ে। সকালের আঁধারকে পেছনে ফেলে আলো ঝলমলে দিন কাটাল বাংলাদেশ। রেকর্ডময় দিনে স্মরণীয় এক সেঞ্চুরি উপহার দিলেন লিটন। স্বপ্নময় সময়ে থাকা মিরাজ নিজের জাত চেনালেন আরও একবার। টপ ও মিডল অর্ডার বিধ্বস্ত হলেও রাওয়ালপিন্ডি টেস্টে দারুণ লড়াই করে বাংলাদেশ জিইয়ে রাখল জয়ের সম্ভাবনা। টেস্টের তৃতীয় দিনে ফলোঅনের শঙ্কায় থাকা বাংলাদেশ শেষ পর্যন্ত প্রথম ইনিংসে তোলে ২৬২ রান। এক সময় বড় লিডের আশায় থাকা পাকিস্তান লিড পায় কেবল ১২ রানের। ২৬ রানে ৬ উইকেট হারানো দলকে খাদের কিনারা থেকে উদ্ধার করেন লিটন ও মিরাজ। চতুর্থ টেস্ট সেঞ্চুরি তুলে নেন লিটন। ১৩টি চার আর ৪টি ছক্কায় ১৩৮ রানের অসাধারণ ইনিংস খেলেন তিনি। আগের দিন বোলিংয়ে ৫ উইকেট শিকার করা মিরাজ এবার ব্যাট হাতে খেলেন ৭৮ রানের ইনিংস। ৩০ রানের কমে ৬ উইকেট হারানোর পর আটে নেমে টেস্ট ইতিহাসের সর্বোচ্চ ইনিংস এটি। দুজনের ১৬৫ জুটিতে গড়া হয় অনন্য কীর্তি। ৫০ রানের নিচে ৬ উইকেট হারানোর পর টেস্ট ইতিহাসের প্রথম দেড়শ রানের জুটি এটিই প্রথম। আলাদা করে উল্লেখ করতে হবে হাসান মাহমুদের পারফরম্যান্সও। দশ নম্বরে নেমে চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞার ব্যাটিংয়ে লিটনকে সেঞ্চুরিতে যেতে সহায়তা করার পাশাপাশি মহামূল্য এক জুটি গড়ে তোলেন তিনি। এরপর জ্বলে ওঠেন নিজের আসল কাজেও। শেষ বিকেলে দুই ওভার বোলিং করে দুটি উইকেট আদায় করে নেন তিনি। পাকিস্তান দিন শেষ করে ২ উইকেটে ৯ রান নিয়ে। দিনের শেষটাও দুর্দান্ত করে বাংলাদেশ।

টাইগাররা দিনের প্রথম ১০ ওভারের মধ্যে হারায় ৬ উইকেট। শুরু থেকেই বাঁহাতি ব্যাটসম্যানদের নাভিশ্বাস তুলে ছাড়েন খুররাম শাহজাদ। সুইং বোলিংয়ে নাজেহাল করে ছাড়েন মির হামজা। বাংলাদেশের প্রথম ছয় ব্যাটসম্যানের পাঁচজনই আউট হন শরীরের ভারসাম্যে গড়বড় করে। সর্বশেষ সাকিব আল হাসানও যখন বিদায় নিলেন, ৬ উইকেট হারিয়ে ইনিংস তখন টালমাটাল। এই ছয় ব্যাটসম্যানের মধ্যে কেবল সাদমান ইসলাম যেতে পেরেছেন দুই অংকে। তিনি করেন ১০ রান। এরপর ধ্বংসস্তূপের উপর দাঁড়িয়ে লড়াই শুরু করেন লিটন এবং মিরাজ। লাঞ্চের আগে আর উইকেট হারায়নি বাংলাদেশ। লিটন তখন একটি বাউন্ডারিতে ৪৪ বলে ১৩ রানে অপরাজিত। অপরদিকে সাতটি বাউন্ডারিতে ৪৮ বলে ৩৩ রানে মিরাজ। লাঞ্চের পর লিটন ফিরেন চেনা রূপে। শাহজাদের এক ওভারে দুটি চারের পর আরেক ওভারে চার মারেন তিনটি। পঞ্চাশ ছাড়িয়ে জুটি দ্রুতই পেরিয়ে যায় একশ রানও। পাকিস্তানের কোনো প্রচেষ্টাই কাজে দেয়নি। শুরুতে ৭ রানে ৪ উইকেট শিকার করা শাহজাদের ওপর দিয়ে পরে ঝড় বইয়ে দেন লিটনমিরাজরা। লেগ স্পিনার আবরার আহমেদ লাইনলেংথ ধরে রেখে বোলিং করলেও বিপদ ঘটাতে পারেননি। চাবিরতির একটু আগে ভাঙে বিশ্বরেকর্ড গড়া জুটি। ড্রাইভ করা চেষ্টায় শাহজাদকে ফিরতি ক্যাচ দেন মিরাজ। ১২৪ বলে ১২টি চার এবং একটি ছক্কায় ৭৮ রান করে ফিরেন মিরাজ। ভাঙে ১৬৫ রানের জুটি। প্রথমবার টেস্টে ৫ উইকেটের স্বাদ পান এই পেসার। পরের ওভারে তাসকিনকেও দ্রুত ফিরিয়ে ষষ্ঠ শিকার ধরেন শাহজাদ। ১৯৩ রানে ৮ উইকেট হারানো বাংলাদেশের ইনিংস তখন শেষের অপেক্ষায়। লিটন অপরাজিত ৮২ রানে। কিন্তু হাসান মাহমুদ ক্রিজে গিয়ে দারুণভাবে সঙ্গ দিলেন লিটনকে। ভরসা পেয়ে লিটনও ঠান্ডা মাথায় এগিয়ে গেলেন শতরানে। আবরারের বলে চার মেরে সেঞ্চুরি করেন স্পর্শ করেন তিনি ১৭১ বলে। ১৮ ইনিংস পরে এলো তার এই টেস্ট সেঞ্চুরি। একটি রেকর্ডেও উঠে গেল তার নাম। ছয়সাতে ব্যাট করে দলীয় ৫০ রানের নিচে ক্রিজে গিয়ে তিনটি টেস্ট সেঞ্চুরি করা প্রথম ব্যাটসম্যান লিটনই। সেঞ্চুরি পর আবার ব্যাট চালিয়ে দ্রুত কিছু রান তোলেন তিনি। শেষ পর্যন্ত তার ইনিংস শেষ হয় সালমান আলি আঘার বলে ছক্কা মারতে গিয়ে। লং অনে ভালো ক্যাচ নেন সাইম আইয়ুব। হাসান মাহমুদের সঙ্গে তার দারুণ জুটি থামে ৬৯ রানে। ২২৮ বলে ১৩টি চার এবং ৪টি ছক্কার সাহায্যে ১৩৮ রান করে ফিরেন লিটন দাশ। শেষ ব্যাটসম্যান নাহিদ রানাকেও ওই ওভারে ফেরান সালমান। হাসান হার মানেননি। ৫১ বলে ১৩ রানে অপরাজিত ছিলেন তিনি। শাহজাদ নিয়েছেন ৯০ রানে ৬ উইকেট। ২টি করে উইকেট নিয়েছেন হামজা এবং সালমান। ব্যাটিংয়ের সাফল্যে উজ্জীবিত হাসান মাহমুদ বল হাতেও পান সাফল্য। নিজের প্রথম ওভারে ফেরান পাকিস্তানি ওপেনার আবদুল্লাহ শফিককে। অনেক বাইরের বলে ব্যাট চালিয়ে উইকেট বিলিয়ে দেন আব্দুল্লাহ শাফিক। পরের ওভারে দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে তিনি বোল্ড করেন নাইটওয়াচম্যান শাহজাদকে। দিন শেষে ২১ রানে এগিয়ে পাকিস্তান। হাতে উইকেট আছে ৮টি। সিরিজ ড্র করতে হলে জিততেই হবে তাদেরকে। কিন্তু ম্যাচের যা অবস্থা, তাতে হোয়াইটওয়াশ করে সিরিজ জয়ের স্বপ্নও ভালোভাবেই দেখতে পারে বাংলাদেশ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিএনপির কোনো নেতাকর্মী যেন হাসিনার মত কর্মকাণ্ডে লিপ্ত না হয়
পরবর্তী নিবন্ধকাপ্তাই হ্রদে মাছ শিকার শুরু, ফিরেছে প্রাণচাঞ্চল্য