কাপ্তাই হ্রদের পানি ছাড়া হচ্ছে আজ সকালে

এখন প্রতি সেকেন্ডে ৩২ হাজার কিউসেক পানি নিষ্কাশন হচ্ছে, তখন ৯ হাজার কিউসেক বাড়বে । প্রায় প্রতি বছর পানি ছাড়া হয়, আতঙ্কের কিছু নেই : কতৃপক্ষ । রাঙ্গুনিয়াসহ ভাটি অঞ্চলের ঝুঁকি সম্পর্কে যা জানালেন গবেষকরা

রাঙামাটি প্রতিনিধি | রবিবার , ২৫ আগস্ট, ২০২৪ at ৭:৫৫ পূর্বাহ্ণ

দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার অন্যতম বৃহৎ কৃত্রিম জলাধার কাপ্তাই হ্রদের পানি বিপদসীমার কাছাকাছি হওয়ায় কাপ্তাই বাঁধ দিয়ে পানি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্র। গতকাল শনিবার রাত ১০টার দিকে কাপ্তাই বাঁধের ১৬টি স্পিলওয়ে বা জলকপাট খুলে দেওয়ার কথা দুপুরে জানানো হলেও পরে রাতে জানানো হয়, আজ রোববার সকাল ৮টার দিকে পানি ছাড়া হবে। বিদ্যুৎকেন্দ্রের কন্ট্রোল রুম সূত্র জানিয়েছে, গতকাল রাত ১০টায় কাপ্তাই হ্রদের পানির উচ্চতা ছিল বরাবর ১০৮ এমএসএল।

বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যবস্থাপক এটিএম আব্দুজ্জাহের বলেন, এখনো পানি ছাড়া হয়নি। আমরা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। রোববার (আজ) সকাল ৮টার দিকে পানি ছাড়া হবে। রাতে পানি ছাড়লে মানুষ আতঙ্কিত হতে পারেন। আমরা যে পরিমাণ পানি ছাড়ার কথা বলেছি প্রতি সেকেন্ডে ৯ হাজার কিউসেক; সেখানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলেই প্রতি সেকেন্ডে ৩২ হাজার কিউসেক পানি নিষ্কাশন হচ্ছে; যা ৯ হাজার কিউসেকের তিন গুণেরও বেশি।

তিনি বলেন, প্রায় প্রতি বছর পানি ছাড়া হচ্ছে। গত বছরও দুইবার পানি ছাড়া হয়েছে। এর আগের বছরগুলোতেও পানি ছাড়া হয়েছে। তবে সাম্প্রতিক কয়েক বছরে হ্রদে পানি কম থাকার কারণে পানি ছাড়ার মতো পরিবেশ তৈরি হয়নি। পানি ছাড়া নিয়ে স্থানীয় জনগণকে আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

এদিকে গত রাতে রাঙামাটির জেলা প্রশাসক এবং কাপ্তাই হ্রদ ব্যবস্থাপনা ও পরিচালনা কমিটির সভাপতি মোশারফ হোসেন খান বলেন, রাতে ছাড়ার কথা জানানো হলেও পানি ছাড়া হয়নি। রোববার (আজ) সকালে পানি ছাড়া হবে। জোয়ারের মধ্যে পানি ছাড়লে চট্টগ্রামের কিছু এলাকায় পানি বেড়ে মানুষ আতঙ্কিত হতে পারেন। সেজন্য রাতে পানি ছাড়া হয়নি। এর আগে গতকাল বেলা ৩টায় এক জরুরি বার্তায় জানানো হয়, রাত ১০টা থেকে স্পিলওয়ের ১৬টি গেট ৬ ইঞ্চি করে উঠিয়ে দিয়ে পানি নিষ্কাশন করা হবে। এতে প্রতি সেকেন্ডে ৯ হাজার কিউসেক পানি নিষ্কাশন হবে কর্ণফুলী নদীতে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, চলতি বছর ২৪ আগস্ট প্রথম দফায় কাপ্তাই হ্রদের পানি নিষ্কাশন ছাড়াও বিগত বছরগুলোতে পানি ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ২০১৭ ও ২০২৩ সালে দুই দফায় পানি ছেড়ে দেওয়া হয় কর্ণফুলী নদীতে। এছাড়া ২০১৯ সালে ছাড়া হয় একবার। ২০১৭ সালের ১৮ জুলাই প্রথম ধাপে কর্ণফুলী নদীতে কাপ্তাই বাঁধের ১৬টি স্পিলওয়ে অর্থাৎ স্বয়ংস্ক্রিয় জলকপাট দিয়ে পানি নিঃসরণের পর দ্বিতীয় দফায় ১৮ আগস্ট পানি ছাড়া হয়েছিল। এরপর ২০১৯ সালের ১৬ জুলাই ছাড়া হয় কাপ্তাই হ্রদের পানি। গত বছরের ১৫ সেপ্টেম্বর ও ১৯ সেপ্টেম্বর দুই দফায় হ্রদের পানি ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল।

প্রসঙ্গত, বর্তমানে কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাঁচটি ইউনিটে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ফলে ৩২ হাজার কিউসেক পানি প্রতি সেকেন্ডে কর্ণফুলী নদীতে নিষ্কাশন হচ্ছে। কাপ্তাই হ্রদে বাঁধ দেওয়া অংশে ১২ দশমিক ২ মিটার দৈর্ঘ্য ও ১১ দশমিক ৩ মিটার প্রস্থের ১৬টি জলকপাট বা স্লুইস গেট রয়েছে। এগুলো দিয়ে একসঙ্গে প্রতি সেকেন্ডে ৫ লাখ ২৫ হাজার কিউসেক পানি নির্গমন করতে পারে। হ্র্রদে ১০৯ এমএসএলের অধিক পানি পূর্ণ হলে জলকপাট দিয়ে পানি নির্গমন করা হয়।

রাঙ্গুনিয়াসহ ভাটি অঞ্চলে ঝুঁকি কেমন : রাঙ্গুনিয়া প্রতিনিধি জানান, কাপ্তাই লেকের পানি বেড়ে যাওয়ায় কর্ণফুলী পানি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ১৬টি স্পিলওয়ের গেট আজ রোববার সকাল ৮টায় খুলে দেওয়া হবে। এজন্য ভাটি অঞ্চলকে সতর্কবার্তা দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) ম্যানেজার এটিএম আব্দুজ্জাহের জানান, কাপ্তাই লেকে ১০৮ ফুট এমএসএল পর্যন্ত পানি উঠলে বিপৎসীমার অবস্থা সৃষ্টি হয়। ১৬টি গেটের ৬ ইঞ্চি করে ছেড়ে দেওয়া হবে।

পানি ছাড়ার খবরে ভাটি অঞ্চল রাঙ্গুনিয়াসহ আশেপাশের উপজেলার বাসিন্দাদের মাঝে আতংক বিরাজ করছে। গেল কয়েকদিন ধরে এই নিয়ে বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনার প্রেক্ষিতে এই আতংকের জন্ম নেয়। তবে পানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের গেট খুলে দিলেও তাতে আতংকের কিছু নেই বলে জানিয়েছেন কর্ণফুলী নদী গবেষকেরা। গবেষকরা বলেন, কাপ্তাই বাঁধ থেকে যে পরিমাণ অতিরিক্ত পানি নিষ্কাশিত হবে, এতে হালদা নদীসহ কর্ণফুলীতে জোয়ারের স্তর বৃদ্ধি পাবে। কর্ণফুলী নদীর পার্শ্ববর্তী উপজেলার কৃষি জমিতে জোয়ারের পানি ঢুকতে পারে। কাপ্তাই বাঁধ রক্ষার্থে এমনটি করা হচ্ছে। লেকের পানি বিপৎসীমার নিচে চলে আসলে কর্তৃপক্ষ আবার গেট বন্ধ করে দেবে।

পানি ছাড়ার ক্ষতি প্রসঙ্গে নদীপাড়ের বাসিন্দা শিক্ষক নুরুল হুদা বলেন, ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি কাপ্তাই লেকে পানির স্তর বৃদ্ধি পেলে তারা পানি ছেড়ে দেয়। যে পরিমাণ পানি ছাড়ার কথা বলছেন তারা তা খুবই স্বাভাবিক। এই পরিমাণ পানি ছাড়লে কর্ণফুলী নদীর পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পায়। নদীতে তীব্র স্রোত সৃষ্টি হয়। চন্দ্রঘোনা ফেরি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। কাপ্তাই লেকের নিম্নাঞ্চল রাঙ্গুনিয়া, রাউজান, বোয়ালখালী অঞ্চলে নদী ভাঙন সৃষ্টি হতে পারে, পাশাপাশি নদী তীরবর্তী ফসলি জমি, রাস্তাঘাট প্লাবিত হতে পারে। তবে কাপ্তাই লেকের ছেড়ে দেওয়া পানিতে বন্যার সৃষ্টি করে না। গ্রাম, বাড়িঘর ডুবে যায় না। প্রায় বছরই লেকের পানি ছাড়া হয়। কখনোই এই পানিতে বড় কোনো বন্যার সৃষ্টি করেনি। সুতরাং আতঙ্কের কারণ নেই।

রাঙ্গুনিয়া প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ ইলিয়াস তালুকদার বলেন, আমরা কাপ্তাই বাঁধের পাশে কর্ণফুলী নদীপাড়ের মানুষ। জন্মলগ্ন থেকে দেখছি কাপ্তাই বাঁধের উপরে পানি বাড়লে পানি ছেড়ে দিতে হয়। এতে এলাকার মানুষের মধ্যে কোনো সময় আতঙ্ক বিরাজ করেনি। এবার কেন জানি একটি মহল এটা নিয়ে বেশি আতঙ্ক ছড়াচ্ছে। এটা কাপ্তাই, রাঙ্গুনিয়া, রাউজান ও বোয়ালখালীর মানুষের জন্য স্বাভাবিক ঘটনা।

এদিকে কাপ্তাই হ্রদের পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় বিদ্যুৎ উৎপাদনও বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে কেন্দ্রে দৈনিক পাঁচটি ইউনিটে সর্বোচ্চ ২১৯ মেগাওয়াট পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদিত হচ্ছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবন্যা মোকাবিলা এ মুহূর্তে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার : প্রধান উপদেষ্টা
পরবর্তী নিবন্ধআনসারদের কিছু দাবি ‘যৌক্তিক’, সুপারিশ করতে কমিটি স্বরাষ্ট্রের