বেঁধে দেওয়া সময়ের মধ্যে মালয়েশিয়ায় যাওয়ার জন্য দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে হাজির হয়েছিলেন কয়েকশ মানুষ, যাদের বেশিরভাই ফ্লাইট ধরতে পারছেন না। কাজের জন্য মালয়েশিয়ার সুযোগ পাওয়া এসব মানুষের কেউ হয়েছেন এজেন্সির প্রতারণার শিকার, কেউ আবার শেষ মুহূর্তে টিকেট পেয়েও যেতে পারেননি। তাদের চোখে মুখে স্বপ্নভঙ্গের হতাশা।
মালয়েশিয়া সরকারের ঘোষণা অনুযায়ী, অনুমোদন পাওয়া বাংলাদেশি কর্মীদের সেদেশে প্রবেশের শেষ দিন ছিল গতকাল শুক্রবার। এ ধাপে কর্মী ভিসায় শুক্রবারের পর আর কেউ সেখানে ঢুকতে পারবেন না।
গতকাল শেষ দিনে যাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে মাত্র ১ হাজার ৫০০ জন কর্মীর। তারা কে কোনো ফ্লাইটে, কোন বিমানে যাবেন, তা আগে থেকে ঠিক করা আছে। এর বাইরে আরো ৩১ হাজার ৭০১ জন বাংলাদেশি কর্মী চাকরি নিয়ে মালয়েশিয়ার যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন, কিন্তু টিকেট জটিলতায় তারা বিপাকে পড়েছেন।
তাদের মধ্যে অনেকে গতকাল সকাল থেকে বিমানবন্দরে আসতে থাকেন। যেসব এজেন্সির সঙ্গে চুক্তি, তারাই ডেকে এনেছেন তাদের। সন্ধ্যা পর্যন্ত বিমানবন্দরে উৎকণ্ঠিত মানুষের ভিড় দেখা যায়। বিমানবন্দরে ব্যাগ–ট্রলি, লাগেজ নিয়ে বসে থাকা এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা হয়। তারা বাড়ি থেকে বিদায় নিয়ে এসেছেন, বলে এসেছেন, মালয়েশিয়া যাচ্ছেন।
খুলনার তেরোখাদা থেকে এসেছেন আল মামুন নামের একজন। সব ঠিক থাকলে সন্ধ্যায় ফ্লাইটে ওঠার কথা ছিল তার। কিন্তু টিকেট আর তার হাতে আসেনি। চোখে–মুখে একরাশ হতাশা নিয়ে বসে থাকা মামুন বলেন, বাবা–মায়ের স্বপ্ন পূরণের জন্য মালয়েশিয়া যেতে চাইছিলাম। কিন্তু এখন পর্যন্ত টিকিট পাইনি। এজেন্সি থেকে এখানে আসতে বলেছিল। বলেছে অপেক্ষা করতে। একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এখন দেখছি অনেক মানুষ এখানে। টিকিট নেই।
একই উপজেলার আরেকজন সাকিবুর রহমান। স্কাই ট্যুরস অ্যান্ড ট্রাভেলস লিমিটেডের মাধ্যমে তার মালয়েশিয়া যাওয়ার কথা। সাকিবুর বলেন, আমার ফ্লাইট ছিল গতকাল (বৃহস্পতিবার) সন্ধ্যা সোয়া ৭টায়। কিন্তু আমাদের টিকিটও বুঝিয়ে দেওয়া হয় ৭টায়। তখন আর যেতে পারিনি। আজকে আবার আসতে বলেছে। তাই এলাম। মনে হয় যেতে পারব না।
ময়মনসিংহ মুক্তাগাছা থেকে এসেছেন আলমগীর হোসেন। আগে গাড়ির চালক হিসেবে কাজ করতেন। আত্মীয়–স্বজনের কাছ থেকে টাকা ধার করে বিদেশ গিয়ে ভাগ্য বদলাতে চেয়েছিলেন। স্বপ্নভঙ্গের শঙ্কা নিয়ে তিনিও অপেক্ষা করছিলেন বিমানবন্দরে। তিনি বলেন, আমি আগে ড্রাইভিং করতাম। একটু ভালো থাকার আশায় মালয়েশিয়া যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু টিকিট পেলাম না দালালের খপ্পরে পড়ে। আত্মীয়–স্বজন থেকে টাকা ঋণ করেছি। আমার একটা ছোট মেয়ে আছে। কী করব কিছুই বুঝতে পারছি না।
নওগাঁর আত্রাই থেকে এসেছেন মো. শেরেকুল। তিনি বলেন, মালয়েশিয়া যাওয়ার ইচ্ছায় এসেছিলাম। আমাদেরকে এজেন্সি থেকে বলেছিল টিকিট পাব। সকাল থেকে এখানে এসে বসে আছি। খাওয়া হয়নি। এজেন্সি থেকেও জানিয়েছে টিকিট পাওয়া যায়নি। আমরা প্রতারণার শিকার।
বাংলাদেশ থেকে কর্মী ভিসায় মালয়েশিয়া যাওয়ার শেষ সময় শুক্রবার রাত পর্যন্ত। এক মাস আগে থেকে এ তারিখ নির্ধারণ করা ছিল। বেঁধে দেওয়া শেষ তারিখের সুযোগ নিয়ে একটি চক্র টিকেটের দাম বাড়িয়ে দেওয়ার পাশাপাশি বিভিন্ন কায়দায় বেশি টাকা আদায়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। বিষয়টি নিয়ে গণমাধ্যমে খবরও প্রকাশিত হয়েছে।
বিমানবন্দরে অনেকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এজেন্সিগুলো মালয়েশিয়া রুটে বিমান ভাড়া কয়েক গুণ বেশি নিয়েছ। ৩০ হাজার টাকার টিকেটের দাম ১ লাখ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। তারপরও টিকেট মেলেনি।
বাংলাদেশ জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য বলছে, গত ২১ মে পর্যন্ত প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ৫ লাখ ২৩ হাজার ৮৩৪ জন কর্মীকে মালয়েশিয়া যাওয়ার অনুমোদন দেয়। ২১ মের পর আর অনুমোদন দেওয়ার কথা না থাকলেও মন্ত্রণালয় আরও ১ হাজার ১১২ জনকে তা দিয়েছে।
অর্থাৎ বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ৫ লাখ ২৪ হাজার ৯৪৬ জন বাংলাদেশি মালয়েশিয়া যাওয়ার সুযোগ পেয়েছেন। এর মধ্যে বৃহস্পতিবার পর্যন্ত মালয়েশিয়া চলে গেছেন ৪ লাখ ৯১ হাজার ৭৪৫ জন।
বিএমইটির তথ্য অনুযায়ী, শুক্রবার বাংলাদেশ থেকে মাত্র ১ হাজার ৫০০ জন মালয়েশিয়ায় যেতে পারবেন। তাই যদি হয়, তাহলে অনুমোদন পেয়েও ৩১ হাজার ৭০১ জনের মালায়েশিয়া যাওয়া হচ্ছে না। এই সংকট লাঘবে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস গতকাল সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে কুয়ালালামপুরে একটি অতিরিক্ত ফ্লাইট পরিচালনা করে। কিন্তু তাতে সর্বোচ্চ ২৭১ জন যাত্রীর মালয়েশিয়ায় যাওয়ার সুযোগ মেলে। অতিরিক্ত এই ফ্লাইটের ভাড়া ধরা হয় জনপ্রতি ৭৩ হাজার ৬১৬ টাকা।