পৃথিবী যেন শরণার্থীদের জন্য এক ধুধু প্রান্তর হয়ে দেখা দেয়। বাংলাদেশে মন্দাকিনী খালের স্রোতের আশপাশে বেড়ে ওঠা একজন জযনাল যেন সেসব শরণার্থীর প্রতিনিধি। খুব যে খারাপ অবস্থায় ছিল সে ঠিক তা নয়। তবে কেন তাঁর অবৈধ পন্থা অবলম্বন করে এই ইতালিযাত্রায় নেমে যাওয়া?
বাংলাদেশ থেকে কলকাতা, দিল্লি, কিরগিজস্তান, কাজাখস্তান, রাশিয়া ও ইউক্রেন হয়ে স্লোভাকিয়ার বিস্তৃত ক্যানভাসে রচিত হয়েছে “জয়নালের ইতালিযাত্রা”।
উপন্যাসের শুরুটা হয়েছে ইউক্রেনের এক ডিটেনশন ক্যাম্পে। জয়নালের নিজের সাথে নিজের ক্রমাগত কথা বলে যাওয়া, ফেলে আসা জীবনের স্মৃতিচারণ, শরণার্থীর জীবনযাপনে ক্রমাগত ভোতা হয়ে আসা অনুভূতির মাঝেও কখনো স্বগোতক্তি আবার কখনো সঙ্গি সুলতান, সেলিম ও ইয়ানের সাথে খুনসুটি এবং যন্ত্রণা ভাগাভাগির মধ্য দিয়ে, আবার কখনো জাপানি প্রেমিকা মোমোকার কথা ভাবতে ভাবতে এগিয়েছে তাঁর অদ্ভুত ইতালিযাত্রা। জাহেদ মোতালেব পাঠকের মস্তিষ্কে এই দৃশ্যসমূহ সৃষ্টি করার ক্ষেত্রে তাঁর দারুণ কল্পনাশক্তি প্রদর্শন করতে পেরেছেন।
খালাতো ভাই পাবলোর জীবনের মতো কিছু যাপন করার আকাঙ্ক্ষা জয়নালকে তাড়িয়ে বেড়িয়েছে পৃথিবীর নিষ্ঠুর এবং বৃহৎ প্রান্তর জুড়ে। নিজ ডিজায়ারের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে উঠতে না পেরে জয়নাল পরিচালিত হয়েছে সেই ডিজায়ার দ্বারাই।
অবশ্য উপন্যাসটি শুধুমাত্র জয়নালকে নিয়ে নয়। সুলতান, সেলিম, ইয়ানসহ অনেকের জীবনাখ্যান আলগোছে ঢুকে পড়েছে মূল গল্পে। ভূ–রাজনৈতিক নানামুখি নাড়াচাড়াও স্পষ্টভাবে চলে এসেছে। সীমানাহীন পৃথিবীতে থাকার ইউটোপিয়ান চিন্তা–ভাবনা এখানে উঁকি দিয়ে গেছে।
মনস্তাত্ত্বিক বাস্তবতা ধারার “জয়নালের ইতালিযাত্রা’–এ পাঠক হাটাজারি, কাটিরহাট, মন্দাকিনী গ্রাম, চট্টগ্রাম শহরের পরিমিতভাবে দৃশ্যকল্পের বর্ণনা পাবেন, আরও পাবেন তৎসংশ্লিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস এই ফিকশনের মাঝে। বাংলাদেশের খ্যাতিমানদের অনেকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে জায়গা করে নিয়েছেন জয়নালের উপাখ্যানে।
উপন্যাসটি পাঠে বোঝা যায় লেখক ব্যাপক শ্রম, নিষ্ঠা দিয়ে যত্নের সাথে তা রচনা করেছেন। ইউক্রেনে বন্দি দশায় থাকা জয়নাল এবং অন্যান্যদের মানবেতর অবস্থা, বন্দি নন এরকম কারো পক্ষে বুঝে উঠা কঠিন। লেখক জয়নালের জুতোয় যেন পাঠকের দু’পা গলাতে বাধ্য করেছেন ছোট ছোট বাক্যে, প্রাঞ্জল ভাষায়, পরিমিত ডিটেইলিং এবং মানবমনের চিরায়ত স্ব–বিরোধিতার সুচারু উপস্থাপনার মাধ্যমে। কেন পৃথিবীজুড়ে শরণার্থীদের এরূপ প্রবল ঝুঁকি নিয়ে ছুটে চলা!
জয়নালের সঙ্গীত এবং ফুটবলপ্রীতির সাথে পাঠক হয়তো এই সারসত্যের সম্পর্ক খুঁজে পেতে পারেন। মিউজিক এবং ফুটবল যেন একাকার হয়ে গেছে জয়নালের ভিতরটায়। আবার সেই জয়নাল এবং তাঁর সঙ্গীরা যেন এলোমেলো কিক খাওয়া ফুটবলের মতোই ঘুরে বেড়াচ্ছেন এদিক–সেদিক। সৃষ্টি করে চলেছেন তারা এক বিষণ্নতার মিউজিক, এক বিপন্নতার আবহ।
স্বপ্নের ইতালিযাত্রা যখন শরণার্থী জীবনের বেদনাদায়ক দুঃস্বপ্নে পরিণত হয় তখন কী করার থাকে একজন জয়নালের অথবা একজন ইয়ানের?
সেই দুঃস্বপ্নের যাত্রায় নিজের বর্তমানের সাথে অতীতের, উইশফুল থিঙ্কিং এর, ভবিষ্যতের এবং না ঘটে যাওয়া ঘটনার দৃশ্যকল্প মিলেমিশে সুন্দরভাবে একীভূত হয়ে গেছে “জয়নালের ইতালিযাত্রা” উপন্যাসে। একজন সচেতন পাঠকের মনে চাপ সৃষ্টি করতে পারেন জাহেদ মোতালেব, যা তাঁর লেখালিখির অন্যতম শক্তির জায়গাগুলির মধ্যে একটি।
লেখক বোধ হয় এক ধরনের ঘোরের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলেন লেখালিখির সময়।
এখন পাঠকের সময় এসেছে ঘোরের জগতে প্রবেশ করার।