দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার(১৮৭৭–১৯৫৬)। বাংলা শিশুসাহিত্যে রূপকথার যাদুকর। ‘ঠাকুরমার ঝুলি’র স্রষ্টা দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার কেবল রূপকথার জাদুকর বা জনকই ছিলেন না, বাঙালি সমাজে তিনি পরিচিত লোক–সাহিত্যের সংগ্রাহক, ছড়াকার, চিত্রশিল্পী হিসেবেও। ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫ই এপ্রিল (১২৮৪ বঙ্গাব্দের ২রা বৈশাখ) ঢাকা জেলার সাভার–এর কাছে উলাইল গ্রামে অভিজাত মিত্র মজুমদার পরিবারে রূপকথার এই অপ্রতিদ্বন্দ্বী লেখক জন্মগ্রহণ করেন।
গ্রামের স্কুলে পড়া শেষ করে তিনি পিতার কর্মস্থল মুর্শিদাবাদে চলে আসেন। এখানে বসবাসকালেই তিনি প্রদীপ ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদ পত্রিকায় প্রবন্ধ লেখা আরম্ভ করেন। পরে বন্ধুদের সঙ্গে মিলে সুধা নামে একটি পত্রিকাও প্রকাশ করেন। মুর্শিদাবাদে পাঁচ বছর থাকার পর দক্ষিণারঞ্জণ ময়মনসিংহে চলে আসেন। এখানে ছিল তার পিসীমার বাড়ি। তার বিশাল জমিদারি তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পড়ে দক্ষিণারঞ্জনের ওপরে। জমিদারি কাজের সুযোগেই পল্লীপ্রকৃতি ও গ্রামের সাধারণ মানুষের ঘনিষ্ঠসান্নিধ্যলাভের সুযোগ ঘটে। এ সময় তিনি বাংলার লুপ্তপ্রায় লোকসাহিত্য সংগ্রহের কাজে উদ্বুদ্ধ হন। দীর্ঘ দশ বছর ধরে ঘুরে ঘুরে তিনি লোকসাহিত্য সংগ্রহ ও গবেষণার কাজে নিজেকে নিযুক্ত করেন। দীনেশচন্দ্র সেনের উপদেশে দক্ষিণারঞ্জণ এই কাহিনীগুলিকে স্থায়ী রূপদান করেন বিভিন্ন নামে। রূপকাহিনীগুলি স্থান পায় ঠাকুরমার ঝুলি গ্রন্থে। গীতিকাহিনীগুলি নিয়ে রচিত হয় ঠাকুরদার ঝুলি, রসকথা। স্থান পায় দাদামশায়ের থলে গ্রন্থে এবং প্রচলিত ব্রতকথা নিয়ে। লিখিত হয় ঠানদিদির থলে। সেই প্রথম বাংলার লোক কাহিনিগুলি পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয় এবং সর্বস্তরের মানুষের কাছে বিপুলভাবে সমাদর লাভ করে। দক্ষিণারঞ্জন ছোটদের জন্য আরও যেসব বই লিখে বাংলার শিশুসাহিত্য ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল চারু ও হারু, ফার্স্টবয়, লাস্টবয়, বাংলার সোনার ছেলে, সবুজ লেখা, আমার দেশ প্রভৃতি। দক্ষিণারঞ্জন স্মরণীয় হয়ে আছেন তার শিশু সাহিত্যের অবদানের জন্য। বিশেষ করে ঠাকুরমার ঝুলি, ঠাকুরদার থলে প্রভৃতি গ্রন্থগুলির জন্য। রূপ কাহিনীগুলিকে তিনি এমন মনোরম সুরেলা ভাষায় ব্যক্ত করেছেন যে তার আকর্ষণ অপ্রতিরোধ্য। পল্লীগ্রামে প্রচলিত এমন অনেক শব্দ ও কথা তিনি প্রয়োগ করে তার লেখনীকে আরও সমৃদ্ধ ও মনোগ্রাহী করে তুলেছেন। বাংলার রূপকথার যাদুকর ও শিশুসাহিত্যিক দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার কলকাতায় ১৯৫৬ সালের ৩০শে মার্চ মৃত্যুবরণ করেন।