অর্ধশতকে যারা এই ভূমে জন্ম নিয়েছেন, তাদের কীভাবে বুঝাবো একাত্তরের রঙ্গালয়ে পরাশক্তির দাম্ভিক পদচারণা। একাত্তরের সেই উত্তপ্ত দিনগুলিতে ঢাকাস্থ মার্কিন কনসাল জেনারেল পুরোপুরি ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসের ঘটনা প্রবাহের উপর তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেছিলেন। তাঁর চোখের সামনে পাকিস্তান ভেঙে দু’টুকরো হয়ে যাচ্ছিল। তিনি প্রতিদিন গভীর রাতে পররাষ্ট্র দফতরে টেলিগ্রাম পাঠিয়ে ইঙ্গিত দিতে শুরু করেন যে, বিশ্বের মানচিত্রে বাংলাদেশ নামের একটি নতুন দেশ আবির্ভূত হতে যাচ্ছে। বিখ্যাত ঐ কুটনৈতিক সত্য ভাষণের জন্য তিনি বহুকাল বাংলাদেশের জনগণের নিকট শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে থাকবেন। চাকরির মায়া ত্যাগ করে এই আর্চার কেন্ট ব্লাড মার্কিন প্রশাসনকে বার বার সতর্ক করেছেন। গণহত্যা চলছে এবং গণহত্যা বন্ধে পাকিস্তানে মার্কিন সামরিক, বেসামরিক ও কুটনৈতিক সাহায্য বন্ধ করা উচিত। ব্লাড টেলিগ্রাম নামে বিখ্যাত এই বই ভবিষ্যতেও বহু কুটনীতিককে সত্য ভাষণে প্রভাবিত করবে। আমেরিকা সেদিন পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধ করলে আমাদের শহীদের সংখ্যা এতো বৃদ্ধি পেতো না।
আমরা যারা এখনো বেঁচে আছি, তারা প্রকৃতই ভাগ্যবান। গোটা বাঙালি জাতি পাক–মার্কিন অশুভ জোটকে থোড়াই কেয়ার করেছে। চীন আমাদের বিন্দুমাত্র সাহায্য না করলেও ভয় পেয়েছিল। পাক–মার্কিন নেতৃত্বের প্রত্যাশা ছিল বাংলাদেশ রণাঙ্গনে চীন সামরিক হস্তক্ষেপ করবেই। বাংলাদেশ যুদ্ধে ভারত জিততে পারবে না। মুক্তিযোদ্ধারা জিততে পারবে না। বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের উদ্ভব হবে না। পূর্ব–বাংলার উদ্বাস্তু হিন্দু ও মুসলমানরা হবে আরেকটি ঘরহারা ফিলিস্তিন জনগোষ্ঠী। ৩০ শে নভেম্বর ১৯৭১ চীনা বার্তাসংস্থা কমরেড মাও সেতুংকে রিপোর্ট করল, চল্লিশ ডিভিশন সোভিয়েত লাল ফৌজ চীন সীমান্তে যুদ্ধসাজে দাঁড়িয়ে গেছে। চীনের বোধোদয় হল। তিব্বত সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশ রণাঙ্গনে আসার স্বপ্ন তীব্র শীতের নীচে চাপা পড়ে যায়।
পুরো দস্তুর সম্মুখ সমর শুরু হলো। সোভিয়েত বার্তা সংস্থা ‘তাস’ বিবৃতি দিয়ে বিশ্ববাসীকে এই বলে সতর্ক করে দিল যে, ‘বাংলাদেশ রণাঙ্গন সোভিয়েত সীমান্তবর্তী, এই যুদ্ধের সাথে রুশ নিরাপত্তা স্বার্থ গভীরভাবে জড়িত এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন যুদ্ধের গতিপ্রকৃতির উপর তীক্ষ্ম দৃষ্টি রেখে চলেছে’। এর অর্থ হলো আমেরিকাসহ কেউ যেন যুদ্ধে জড়ানোর সাহস না দেখায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমন মারাত্মক হুমকি কেউ কাউকে দিয়েছে বলে জানা যায় না। আজ যারা সাম্প্রতিক হুমকি পাল্টা হুমকি নিয়ে ভীমড়ী খাচ্ছেন, তাদের বলি একাত্তরের ইতিহাস স্মরণ করুন। পরে যারা জন্ম নিয়েছেন, তাদের বলি ইতিহাস পড়ুন। কারো দয়ায় যেমন এদেশ স্বাধীন হয়নি তেমনি পৃথিবীর তথাকথিত শ্রেষ্ঠ পাক সেনাবাহিনীকে পরাস্ত করেই আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম। কিছু কথা খোলাখুলি বলাই ভালো, সেদিন ভারতের ৮ ডিভিশন সৈন্য সরাসরি যুদ্ধে না জড়ালে আমাদের আরো বহুকাল অপেক্ষা করতে হতো। সেদিন অজিত দোভালের সাথে দিল্লীতে মার্কিন নিরাপত্তা উপদেষ্টার দ্বি–পাক্ষিক বৈঠকের শুরুতেই তীব্র আপত্তি জানিয়ে বলা হলো, বাংলাদেশ ভারতের নিকটতম প্রতিবেশী। বাংলাদেশের বাস্তবতার সাথে ভারতের নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত। আমার ধারণা ভারতের এই বক্তব্য অনেকটা একাত্তরের রঙ্গমঞ্চকে সামনে নিয়ে এসেছে। আমেরিকা কেন পৃথিবীর যে কোনো দেশ বাংলাদেশ নিয়ে কোনো পদক্ষেপ নিতে গেলে দ্বিতীয়বার ভাবতে বাধ্য। বাংলাদেশে কোনো রক্ষণশীল পরিবর্তন হলে লক্ষ লক্ষ হিন্দুকে ২০০১ সালের মতো ভারতে উদ্বাস্তু হতে হবে। হিন্দু শরণার্থীর দায় আমেরিকা একাত্তরে নেয়নি। ২০০১ সালেও নেয়নি। ভবিষ্যতেও নেবে না।
মাঝে মাঝে মনে হয় আমাদের রক্তদান বৃথা যায়নি। কয়দিন আগে চীনের পররাষ্ট্র দফতরের মুখপাত্র বলেছে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যকে পৃথিবীর বহু দেশ সমর্থন করছে। অর্থ দাঁড়ায়, চীনও প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের কট্টর সমর্থক হয়ে উঠেছে। ভাবখানা এমন যে, সবার বুঝা উচিত, সামন্ত জমিদারদের মতো মোড়লগিরির দিন এখন আর নেই। আমি মনে করি সামনের নির্বাচন নিয়ে যে উত্তপ্ত কূটনৈতিক হাওয়ার সৃষ্টি হয়েছে তা বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কূটনীতিকে প্রভাবিত করবেই। সবার সাথে বন্ধুত্বের যে নীতি নিয়ে এতোদিন বাংলাদেশ অগ্রসর হচ্ছিল তা পুনর্মূল্যায়নের সময় এসেছে।
আমার মতো বহু অভাগা মনে করে, এতো দ্রুত ওআইসি’তে যোগ দেয়া, ওআইসি শীর্ষ সম্মেলনে বঙ্গবন্ধুর যোগ দেয়া ঠিক হয়নি। ভারতে আমাদের চেয়েও বেশি মুসলিম অথচ ভারত আজো ওআইসিতে যোগ দেয়নি। ইসলামী রাষ্ট্রগুলো আমাদের এক সের চাউল দিয়ে একাত্তরে সাহায্য করেনি। চুয়াত্তরের দুর্ভিক্ষেও কোনো ইসলামী রাজা মহারাজা সহানুভূতি জানিয়ে এক লাখ দিরহাম পাঠায়নি। আমরা আজও মনে করি এতো তাড়াতাড়ি ভুট্টোকে স্বাগত জানানো ঠিক হয়নি। মানুষ মাত্রই ভুল করে। বঙ্গবন্ধুও ভুল শুদ্ধে মিশ্রিত এক মহামানব। আমরা খুব অবাক বিষ্ময়ে দেখছি, বঙ্গবন্ধু বেঁচে থাকলে হয়তো এমন কিছু ভুল করতেন যা তাঁর কন্যা করছেন না। আচ্ছা খোলা মনে ভেবে দেখুন তো, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য মালামাল আসছে। কোন জাহাজে পাঠাবে বা পাঠাবে না সেটাতো রাশিয়ার বিষয়। অথচ জাহাজটি ফিরিয়ে দেয়ায় ক্ষতি হলো আমাদের। অথচ আমেরিকা–রুশ দ্বন্দ্বে আমরা কোনো পক্ষ নই বা অংশীদার নই।
বুর্জোয়া নির্বাচন পদ্ধতিতে শতভাগ প্রভাবমুক্ত নির্বাচন কখনোই সম্ভব নয়। আমেরিকার নির্বাচনে ট্রাম্প সাহেব যা দেখালেন তা কয়দিন আগের ঘটনা। ইউরোপীয় দেশগুলো পশ্চিমা গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি চর্চা করে। ভুলে গেলে চলবে না যে, টাকার যথেষ্ট যোগান দিতে পারে না বলে বৃটেনের লেবার পার্টির তুলনায় টোরী পার্টি সব সময় এগিয়ে থাকে। ভারতের কথাই ধরি। এখনো বিধানসভা, লোকসভা ও রাজ্যসভায় যার টাকা পয়সা আছে সেই নমিনেশন পায়। টাকার খেলায় ভারতেও জয় পরাজয় নির্ধারিত হয়। অর্থনৈতিক ও নৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে ভারতেও শতভাগ স্বচ্ছ নির্বাচন অসম্ভব। একজন স্কুল শিক্ষক কি লোকসভায় নির্বাচিত হবার স্বপ্ন দেখতে পারেন?
আমাদের আসন্ন নির্বাচন নিয়ে আমরা যে স্বচ্ছতার কথা বলছি তার মাপকাঠি কী? শুধু শান্তিপূর্ণভাবে বুথে গিয়ে ভোট দিতে পারাই কি অবাধ ও স্বচ্ছ নির্বাচন বুঝাবে? এই কঠিন প্রশ্নের উত্তর আমরা কেউ দিতে রাজী নই। গ্রামে গঞ্জে ভোটের কয়দিন পূর্ব থেকে টাকার খেলা শুরু হয়। আমাদের বিরোধী বন্ধুদের স্বচ্ছ নির্বাচনের দাবী অনেক সময় হাস্যকর ঠেকে। মনে রাখা দরকার সময় অনেক গড়িয়ে গেছে। আমরা দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধের শেষলগ্নে আছি। কেউ যদি মনে করেন ওহী সরকার বা নিরপেক্ষ সরকার এসে আমাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেবেন– তবে তাঁরা বোকার স্বর্গে বাস করছেন।
লেখক: কলামিস্ট, প্রাবন্ধিক, আইনজীবী।