আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে/ তব অবগুণ্ঠিত কুণ্ঠিত জীবনে। রবীন্দ্রনাথের গানের বাণীতেই প্রকাশ পেয়েছে, উচ্ছ্বাস আর অনিন্দ্যরূপের অন্যতম প্রকাশ বসন্ত। বসন্তের আগমনে জীব–জগতের সব জীর্ণতা, রুক্ষতা দূর হয়ে প্রকৃতি হয়ে ওঠে সতেজ ও প্রাণবন্ত। শীতের আড়মোড়া ভেঙে প্রকৃতি সাজে অপরূপ
লাবণ্যময়তায়। কৃষ্ণচূড়া, পলাশ, গাঁদার শোভায় শোভিত হয় সবুজ শ্যামল প্রকৃতি। বাঙলা সাহিত্যে এমন কোনো কবি নেই যে ঋতুরাজ বসন্ত নিয়ে লেখেন নি। কবি নির্মলেন্দু গুণ বসন্তকে আগ্রাসী ঋতু হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
তিনি কবিতায় বলেছেন, বসন্তকে এড়ানোর সাধ্য নেই কারো। ‘বসন্ত বন্দনা’ কবিতায় কবি বলেছেন, এমন আগ্রাসী ঋতু থেকে যতই ফেরাই চোখ /যতই এড়াতে চাই তাকে, দেখি সে অনতিক্রম্য। বসন্তকে কেউ এড়িয়ে যেতে পারে না। কী উৎসবে, কী বেদনায়, কী জাগরণে, কী বিচ্ছেদে কোনো না কোনোভাবে
সবার প্রাণে বসন্ত নাড়া দিয়ে যায়। বসন্তের আবেদন নিয়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেছেন, ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্ত।
নজরুল বলেছেন, ফুল–ফাগুনের এলো মরশুম বনে বনে লাগলো দোল/কুসুম–সৌখিন দখিন হাওয়ার চিত্ত গীত–উতরোল। জীবনানন্দ দাশ তাঁর ‘পাখিরা’ কবিতায় লিখেছেন, ‘আজ এই বসন্তের রাতে/ঘুমে চোখ চায় না জড়াতে;/ওই দিকে শোনা যায় সমুদ্রের স্বর। শুধু গান কবিতায় নয় ফাগুনকে উপজীব্য করে
কথা সাহিত্যিক জহির রায়হান “আরেক ফাল্গুন” নামে একটা উপন্যাসও রচনা করেছেন। বসন্তের মাঝেও তিনি তাঁর উপন্যাসে সংগ্রাম ও আত্মজাগরণের কথা বলেছেন।
মনে বসন্তে চারদিকে মিলনের ধ্বনি শোনা গেলেও এ ঋতু কারো কারো জীবনকে করে তোলে বিষণ্ন। বেজে ওঠে করুণ বেহাগের সুর। কোকিলের মিষ্টি ডাকে, আবির রাঙা বিকেলের মৃদু হাওয়ায় ভেসে ওঠে প্রিয়জনের মুখ। হারানো প্রিয়জনের কথা ভাবতে ভাবতে ভেঙে যায় মনের দেয়াল। তাই এ শ্যামল প্রকৃতি
বসন্তের শোভায় সজ্জিত হলেও কবি সুফিয়া কামালের হৃদয় বসন্তের আবেদনে সাড়া জাগাতে পারেনি। ‘তাহারেই পড়ে মনে’ কবিতায় কবি বসন্তের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হতে পারেনি কারণ এ সময়ে কবি তাঁর প্রিয় স্বামীকে হারিয়েছেন। তাই জটিলেশ্বর মুখোপাধ্যায় বলেছেন, কেউ বলে ফাল্গুন, কেউ বলে পলাশের মাস, আমি বলি আমার সর্বনাশ।
প্রকৃতির নিয়মে অবারিত সৌন্দর্যের ঋতু বসন্তের ছোঁয়ায় কারো জীবন পল্লবিত হলেও কারো জীবন বিষণ্নতায় ভরে ওঠে। বসন্তকে কেউ এড়াতে পারে না। এভাবে কোনো না কোনোভাবে বসন্ত ছুঁয়ে যায় সবার প্রাণে।












