বাংলাভাষার রাজনীতি শুরু মূলত ১৯৪৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে। সেদিন পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাথে পূর্ব বাংলার মুসলিম লীগের সদস্যরা উর্দুকে সারা পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে প্রস্তাব আনেন। কিন্তু কংগ্রেস দলের সদস্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষের ভাষা হিসেবে
বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য দেন। এ থেকেই পূর্ব–বাংলার ছাত্র–জনতার ভাষার রাজনীতি প্রবল হয়েছিল। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার পক্ষে গড়ে উঠে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অসমাপ্ত আত্মজীবনীর অনেকাংশেই এবং ভাষা আন্দোলনভিত্তিক বহু রচনার মাধ্যমে
আমরা তা জানি। ধর্মের দ্বিজাতির রাজনীতির বিপরীতে সহসা শুরু হলো ভাষার রাজনীতি। অবশ্য ভারতে ভাষার রাজনীতির শুরু আটারশ ষাটের দশকে। ভারতের বানরসে শুরু হিন্দি উর্দু বিতর্ক (Hindi Urdu Controvesry 1867)। ১৮৪৭ সালে ভারতের উত্তর–পশ্চিম প্রদেশ এবং আওধে হিন্দি ও উর্দু
নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। হিন্দির পৃষ্ঠপোষকরা দেবনাগরী হরফে হিন্দুস্তানি ভাষা লেখার দাবি জানায়। উত্তর ভারতে দেবনাগরী হরফের সরকারি স্বীকৃতির জন্য আন্দোলন গড়ে উঠে। বাবু শিব প্রসাদ ও মদন মোহন মালব্য ছিলেন এই আন্দোলনের প্রথমদিককার নেতা। এর ফলশ্রুতিতে উর্দুর সরকারি মর্যাদা রক্ষার
জন্য পাল্টা পদক্ষেপ হিসেবে উর্দু আন্দোলন গড়ে উঠে। সৈয়দ আহমদ খান ছিলেন উর্দুর পক্ষের অন্যতম প্রধান ব্যক্তি। সেদিন থেকে শুরু ভারতে ভাষার রাজনীতি।
পাকিস্তান ১৯৪৮ সালে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করে। ১৯৫০ সালে ভারতে দেবনাগরি লিপিতে লিখিত হিন্দি ইংরেজির পাশাপাশি সরকারি ভাষা হিসেবে ঘোষিত হয় এবং মূল হিন্দুস্তানি ভাষা উর্দু হিসেবে প্রতিস্থাপিত হয়। বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি লাভ করে ১৯৫৬ সালে।
ভারতের ব্রিটিশ শাসনের অবসানে ১৯৪৭ সালে ১৪ ও ১৫ আগস্ট পাকিস্তান–ভারত স্বাধীন হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় পূর্ব–বাংলার অধিকাংশ মুসলিম জনগণের
সমর্থন ছিল। কিন্তু বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা না করার অনড় মনোভাব পূর্ববাংলার ছাত্র–জনতা সহসা বিভিন্ন ব্যানারে রাজনৈতিকভাবে হতে থাকে সংঘবদ্ধ। পূর্ব–বাংলার ভাষাবিতর্ক রাজনৈতিক বিষয় হবার আগে বুদ্ধিভিত্তিক ও মনস্তাত্ত্বিক বিতর্কে রূপ নেয়। উর্দুর পক্ষে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড.
জিয়াউদ্দীন ও ড. খালীকুজ্জামান এবং বাংলার পক্ষে ছিলেন ড. মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ ও ড. মো: ইনামুল হক। বাংলার পক্ষে দাবি অতি দ্রুত পূর্ব বাংলার রাজনীতির অন্যতম অংশ হয়ে উঠে। ১৯৫২ এর ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে মাতৃভাষার অধিকার আদায়ের জন্য রাজপথে মিছিল বের
হয়। সেদিন পুলিশের গুলিতে শহীদ হন সালাম, রফিক ও জব্বারসহ অনেকে। সেদিনের আত্মত্যাগ শোকাবহ একুশে ফেব্রুয়ারি মহান মাতৃভাষা ও শহিদ দিবস। বাঙালি জাতির এই মহান আত্মত্যাগকে বিগত পঞাশ বছর ধরেই মর্যাদার সাথে স্মরণ করে আসছে। এখন একুশে শুধুই বাঙালির নয়, জাতিসংঘের
সিদ্ধান্তে একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদায় আসীন। ১৯৭৪ জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বপ্রথম বাংলা ভাষায় ভাষণ দিয়ে বাংলা ভাষা, বাংলাদেশ ও শেখ মুজিবুরকে পুনরায় বিশ্বসভায় চিনিয়ে দিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য সস্তান,
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ হাসিনা বহু বছর ধরেই জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে বাংলায় ভাষণ দিয়ে আসছেন। মাতৃভাষার মর্যাদা ও অধিকার আদায়ের সংগ্রামের শিক্ষা বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় শেষ হয়নি। অচিরেই বাঙালি সংগ্রামী ও লড়াকু জাতিতে
পরিণত হয়। অধিকন্তু পাকিস্তানি শাসন–শোষণের যাতাকল থেকে মাত্র ২৪ বছরের সংগ্রামে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে পৃথিবীর বুকে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করে। অতএব, স্বাধীন বাংলাদেশ যদি মহীরূহ বৃক্ষ হয় তাহলে তার অঙ্কুর ২১শে ফেব্রুয়ারি ও পূর্বাপর ঘটনাবলী।
বাংলা মাগধী প্রাকৃত এবং পালির মতো ইন্দো–আর্য ভাষা থেকে এসেছে। চর্যাপদ এর আদি নিদর্শন। বাংলা ভাষার সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে। মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ কবি ভারতচন্দ্র, চণ্ডীদাস, মহাকবি আলাওল ও শাহ মুহাম্মদ সগির প্রমুখ সাহিত্য সৃষ্টিতে ভাস্মর হয়ে আছেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সুরক্ষিত ৬৫টি পুঁথর মধ্যে অন্তত ৩০টি সমৃদ্ধ পুঁথি বাংলায় রচিত। আর্যরা যেমন বাংলার প্রতি বৈষম্য প্রদর্শন করে, তেমনি মধ্যযুগে মুসলমান শাসকদের ভাষাও বাংলা ছিলো না। মুসলমানদের দাপ্তরিক ভাষা ছিল ফার্সি। কেউ কেউ বাংলাকে অভিজাতদের ভাষা ভাবতো না। মুসলমানদের বাংলা বিজয়ের পর থেকে বহিরাগত মুসলমানও
দেশীয় ধর্মান্তরিতদের সমন্বয়ে গঠিত সমাজ ‘আশরাফ’ ও ‘আতরাফ’ হিসেবে পরিচিত। শাসকশ্রেণি নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখার জন্য নিম্নশ্রেণির উপর নিজেদের ভাষা ও সংস্কৃতি চাপানোর অপচেষ্টা চালায়। ষোড়শ শতকের কবি সৈয়দ সুলতান বাংলার মুসলমানেরা যেন মাতৃভাষায় ইসলাম ধর্ম তথা কোরান–
হাদিস সহজভাবে বুঝতে পারে, সে লক্ষ্যে কাব্যচর্চায় মনোনিবেশ করেন। তাঁর ‘নবীবংশ’ কাব্য থেকে এ তথ্য জানা যায়। তাঁর সময়ে ও তাঁর পূর্বকালে বাংলার মুসলমান সমাজে বাংলা ভাষা ‘হিন্দুয়ানী’ ভাষারূপে পরিচিত ছিল। সৈয়দ সুলতান এ ভাষায় কাব্যচর্চায় মনোনেবিশী হলে রক্ষণশীল মুসলমানেরা সুনজরে দেখেনি। অথচ এই বাংলা ভাষা তাদের মাতৃভাষা। এরা কবির কঠোর নিন্দা ও সমালোচনায় লিপ্ত হয়। ফলে, সৈয়দ সুলতান তাদের ‘মুনাফিক’ বলে গালি দিয়ে লেখেন :
“যে সবে আপনা বোল না পারে বুঝিতে
পাঁচালী রচিলাম করি আছএ দূষিত।
মুনাফিকে বলে আহ্মি কিতাবেতু কাড়ি
কিতাবের কথা দিঁলু হিন্দুয়ানী করি।”
অন্যদিকে সপ্তদশ শতকের কবি আবদুল হাকিম ও অষ্টাদশ শতকের কবি আলী রজাও মাতৃভাষা বাংলায় সাহিত্য রচনা করতে থাকলে রক্ষণশীল মুসলমান কর্তৃক ঠাট্টা–বিদ্রুপ, নিন্দা–সমালোচনা ও ঘৃণার সম্মুখীন হন। আবদুল হাকিম তাই ক্ষুব্ধ হয়ে সমালোচনাকারীদের ‘জারজ’ আখ্যা দিয়ে লেখেন:
“যেসব বঙ্গেত জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী।
সেসব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।
মাতা পিতামহক্রমে বঙ্গেত বসতি।
দেশী ভাষা উপদেশ মনে হিত অতি।”
আর কবি আলী রজা রক্ষণশীলদের অন্যায় মনোভাবের জবাব দেন নিম্নোক্ত ভাষায় :
“নানা দেশের নানা ভাষা আল্লাহর সৃজন।
সর্বভাষা শুদ্ধ বুজে এক নিরঞ্জন।”
ভারতে ব্রিটিশ শাসনের গোড়াপত্তন হলে, তাদের ভাষা, সংস্কৃতির বিস্তার সক্রিয় হয়। তারা তাদের শাসন স্থায়ী ও নির্বিঘ্ন রাখার প্রক্রিয়ায় উপজাত মধ্যবিত্তশ্রেণি ইংরেজি বিদ্যা সম্বল করে জীবন–জীবিকার, ধ্যান–জ্ঞানের নুতন জমিনে এসে দাঁড়ালেন। এ প্রবণতা রোড না করে বরং চিন্তাশীল ব্যক্তিগণ অবধারিত পরিস্থিতির সুযোগ নিয়েছিলেন। ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর তাই সংস্কৃত কলেজে ইংরেজি পড়া আবশ্যক, ডেভিড হেয়ার ও ফোর্ট উইলিয়াম ইংরেজি শিক্ষার জন্য স্কুল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তাই সাম্রাজ্যিক–বাণিজ্যিক প্রশাসনের নতুন কেন্দ্র কলকাতার বিচক্ষণ মানুষেরা জীবিকার সন্ধানে ভিড় করে। তাদের পুঁজি ইংরেজি বিদ্যা। খ্রিস্টান মিশনারি ডেভিড হেয়ারের পালকির পেছনে ‘Me poor Boy Leave Pity on Me Take in Your School’ বলতে বলতে বালক দলের ছুটে চলার বিবরণ সেসময়ের বাঙালি মানসিকতার একটি ভিত পাওয়া যায়।
পৃথিবীর কোথাও ভাষার নামে কোনো দেশ নেই। বাংলাদেশ গঠিত হয়েছে ভাষার নামে। পৃথিবীর ইতিহাসে বাঙালি একমাত্র জাতি যারা ভাষা ও স্বাধীনতা যুদ্ধ করে রক্ত দিয়েছে। বাংলা ভাষাভাষী রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেছেন। লালন–হাছন–নজরুল বা দ্বিজেন্দ্রলাল–বঙ্কিম–জীবনানন্দ প্রমুখ কবি–সাহিত্যিকরা বাংলাকে মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করেছে।
বাংলা একাডেমি বা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউট বাংলা ও অন্যান্য ভাষার উৎকর্র্ষে কাজ করছে। বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উন্নত দেশে রূপান্তর হচ্ছে। অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি আসলে মাতৃভাষার কদর বাড়বে। উচ্চশিক্ষায়, চিকিৎসাশাস্ত্র আইন ও বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় বাংলা ভাষার সহায়ক গ্রন্থের সংখ্যা অপ্রতুল বা নেই বললেও চলে। আদালতের ভাষাও ইংরেজিমুখী। বাংলাদেশে শিক্ষাব্যবস্থা বহুমুখী। সাধারণ শিক্ষা, মাদ্রাসা শিক্ষা, কারিগরি শিক্ষা, ন্যাশনাল কারিকুলাম ইন ইংলিশ ভার্সন। মাদ্রাসা শিক্ষা সরকারি কারিকুলাম ও কওমি শিক্ষা। আবার কেমব্রিজ, এডেক্সেল ও আমেরিকানা। আধুনিক শিক্ষার মানদণ্ড ইংরেজি। যাতে স্কুল আছে, কলেজ আছে, বিশ্ববিদ্যালয় আছে। বিজ্ঞান আছে, প্রাশ্চাত্য দর্শন আছে, ইতিহাস, ভূগোল, ম্যাট্রিকুলেশন আছে। বি. এ. আছে, এম. এ. আছে। এটা এখন সারা দুনিয়ার পদ্ধতি। এসব ডিগ্রি এখন আন্তর্জাতিক মান নির্ণয়ের পরিমাপক। বাংলার শিক্ষা–ব্যবস্থাকেও আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাতে হবে। যার জন্য প্রয়োজন ব্যাপক পরিকল্পনা ও সকলের সদিচ্ছা। আমাদের দরকার বিজ্ঞান, দরকার জীবন ও কলা। প্রচলিত ধর্মীয় জ্ঞান, বিজ্ঞান, সংস্কৃতি ও দর্শনের মধ্যে সামঞ্জস্য সমন্বয় করে সর্বগুণসম্পন্ন ব্যক্তিই হতে হবে আদর্শ। স্বাধীনতা ও মুক্তি মাতৃভাষা দেশি ভাষার বিস্তারে বড় নিয়ামক হয়। অর্থনীতির মানদণ্ডে দুনিয়া ঐ দেশ–ভাষা ও জাতিকে চেনে। বাংলাভাষা ও সংস্কৃতি অসাম্প্রদায়িকতা বাঙালি জাতিসত্তার বুনিয়াদ। বাংলাদেশ সকল সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে অতি দ্রুত উন্নত দেশের কাতারে দাঁড়াবে। ভাষার দেশ, মুক্তিযুদ্ধের দেশ, শহিদদের দেশ লক্ষ লক্ষ মা–বোনের সম্ভ্রম হারানোর দেশ ও বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ–জ্ঞানে–শিক্ষায় একদিন মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হবে।
লেখক : প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ; সাবেক ডিন, কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
প্রাবন্ধিক ও গবেষক