ঠেকানো যেতে পারে হঠাৎ মৃত্যু

প্রফেসর ডা. প্রবীর কুমার দাশ | বৃহস্পতিবার , ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২২ at ৫:৫৯ পূর্বাহ্ণ

সনাতন হিন্দুধর্মের অন্যতম গ্রন্থ পুরাণে ‘সাবিত্রী সত্যবান’ উপখ্যানে সাবিত্রী কর্তৃক হঠাৎ হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণকারী স্বামী সত্যবানের প্রাণ ফিরিয়ে আনার কথা বর্ণিত আছে। সাবিত্রী একথা জেনেই সত্যবানকে বিবাহ করে যে বিবাহের এক বছরের মধ্যে সত্যবানের মৃত্যু ঘটবে। সত্যবানের রাশিফল গননায় (যে সে সময়ের পরীক্ষা নীরিক্ষা বা ইনভেষ্টিগেশন) তা নিশ্চিত হয়। তাই সাবিত্রী বিবাহ পরবর্তী সময়ে সত্যবানের সাথে সার্বক্ষণিক অবস্থান করে। বিশেষত সত্যবান যখন ক্লান্তবোধ করে কিংবা কাজ করতে গিয়ে অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে তখন। একদিন সত্যবান বনে কাট কাটতে গিয়ে মাটিতে বসে পড়ে এবং মুচ্ছা যায়। তার শ্বাস প্রশ্বাস মন্থর হয়ে পড়ে, চোখ বন্ধ হয়। নাড়ী থেমে যায়। মৃত্যুর দেবতা যমদূতের আগমন ঘটে। যমদেব নাক দিয়ে সত্যবানের আত্মা নিয়ে ফেলে এবং তার রাজ্যের দিকে রওনা হয়। সত্যবানের মৃত্যু ঘটে। তার মৃতদেহ মাটিতে পড়ে থাকে। এটা হৃৎক্রিয়া বন্ধ হয়ে হঠাৎ মৃত্যুর এক আদর্শ বর্ননা। সাবিত্রী যমরাজের উপর জয়ী হয়। সে তার স্বামীকে বাঁচিয়ে তোলে। সত্যবান জীবন ফিরে পায়। এই উপখ্যানে বর্ণিত সাবিত্রীর যমদেবের সাথে যুদ্ধ এবং সেই যুদ্ধে জয়ী হয়ে স্বামী সত্যবানের জীবন ফিরিয়ে আনা তার মৃতদেহের উপর করা একধরনের সিপিআর। এভাবে সিপিআর এক মৃত্যুঞ্জয়ী ব্যবস্থা। খৃষ্টপূর্ব আনুমানিক ৫০০০ সালে সাবিত্রী সত্যবান’ উপখ্যানে বর্ণিত এই মৃত্যুঞ্জয়ী ঘটনাই ইতিহাসের প্রথম সিপিআর। এতে প্রতীয়মান হয় যে, হঠাৎ মৃত্যুবরণকারীর প্রাণ ফিরিয়ে আনার উপায় (নির্থাৎ সিপিআর) বৈদিক যুগেও জানা ছিল। এই উপখ্যান থেকে এটা বোধগম্য যে নিষ্টা ও একাগ্রতা থাকলে এই ধরনের পরিস্থিতিতে জীবন ফিরিয়ে আনা সম্ভব। এটাই সিপিআর এর মূলমন্ত্র।
হঠাৎ মৃত্যু কিভাবে?
দু’ভাবে মানুষ মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে। অধিকাংশ মানুষ দীর্ঘ রোগভোগের এক পর্যায়ে ধীরে ধীরে মৃত্যুবরণ করে। হৃৎস্পন্দন ও শ্বাস প্রশ্বাস এক পর্যায়ে থেমে যায়। বিলুপ্ত হয় জীবনের সব লক্ষণ। আবার কারো কারো মৃত্যু ঘটে হঠাৎ, আচমকা । তাদের অধিকাংশের ক্ষেত্রে হৃৎক্রিয়া হঠাৎ বন্ধ হয়ে পড়ে। এটাই কার্ডিয়াক অ্যারেষ্ট জনিত হঠাৎ মৃত্যু। আমেরিকায় প্রতি ৪৫ মিনিটে একজন এভাবে হঠাৎ মৃত্যুবরণ করে। আমাদের দেশে এধরনের কোন পরিসংখ্যান নেই। তবে তা সচরাচর ঘটে যাওয়া মৃত্যুর এক ধরন। তা হাসপাতালের বাইরেই বেশি ঘটে। এদের অধিকাংশই হার্ট এট্যাক জনিত। এছাড়া জেনেটিক কারণে হৃৎপেশী কিছু অসুখ (কার্ডিওমায়োপ্যাথি ও আয়ন জনিত ব্যত্যয়) হঠাৎ মৃত্যুর কারণ হিসাবে কাজ করে। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় তা ক্লিনিক্যাল ডেথ। এটাও এক ধরনের মৃত্যু। কিন্তু সিপিআর ও উন্নত জীবন রক্ষাকারী ব্যবস্থার মাধ্যম এই ধরনের মৃত্যু থেকে আক্রান্ত ব্যক্তিকে বাচিঁয়ে তোলা সম্ভব হয়। এই কার্ডিয়াক অ্যারেষ্টের মূলে রয়েছে ডেট্রিকুলার ফিব্রিকেশন আর ভাট্রিকুলার অ্যাসিষ্টোল নাম হৃৎপিণ্ডের মারাত্মক ছন্দহীনতা বা অ্যারিমিয়া। অবিরাম রক্ত পাম্প করে যাওয়া হৃৎপিণ্ড হঠাৎ থেমে গেলে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে জ্ঞান লোভ পায়। এটাই ‘ক্লিনিক্যাল ডেথ’। তা কয়েক মিনিটের বেশী স্থায়ী হলে মস্তিকের রক্ত প্রবাহ বন্ধ হয়ে দীর্ঘ মেয়াদী ক্ষতি হয় এবং আক্রান্ত ব্যক্তির ‘ব্রেইন ডেথ্‌’ ঘটে। এই ব্রেইন ডেথ্‌ই নিশ্চিত মৃত্যু। এই অবস্থা থেকে আক্রান্ত ব্যক্তিকে আর ফেরানো যায় না। তখন চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষনা করেন।
মানুষ কেন হঠাৎ ধুম করে মারা যায় ? তা কি কোন ভৌতিক কারণে ? রোগতত্ত্বীয়ভাবে তা মানুষের জীবনে ঘটেছে আদিকাল থেকে। এটা অনেক কাল সাধারণ মানুষকে বিভ্রাট করেছে, চিকিৎসা বিজ্ঞানীদের বিভ্রান্ত করেছে। চতুর্থ শতাব্দীতে চিকিৎসা শাস্ত্রের জনক হিপ্পোক্রেটস প্রথম বলেন যে যারা ঘন ঘন মুর্চ্ছা যায় তাদের হঠাৎ মৃত্যুর আশংকা থাকে। চতুর্দ্দশ শতাব্দীর শেষের দিকে লিওনার্দো দ্যা ভি্‌ঞ্িচ মৃতদেহ ব্যবচ্ছেদের মাধ্যমে দেখেন যে হঠাৎ মৃত্যুবরণকারীদের হৃৎপিণ্ডের রক্তনালী সংকুচিত ও অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। এটাই চিকিৎসা বিজ্ঞানের ইতিহাসে হার্ট অ্যাটক জনিত মৃত্যুর প্রথম সরাসরি পর্যবেক্ষণ। প্রাচীন মিশরীয় প্যাপিরাসে উল্লেখ রয়েছে, ‘যখন হৃৎপিণ্ডের রক্তনালী সংকুচিত ও অবরুদ্ধ হয় তখন তা অসুস্থ ও দুর্বল হয়ে পড়ে। হৃৎপিণ্ডের কাঁপন ধরে এবং তা বন্ধ হয়ে মৃত্যু ঘটে।’ এটাই পূর্ব বর্ণিত ভাট্রিকুলার ফিব্রিলাশন, কার্ডিয়াক অ্যারেষ্ট ও হঠাৎ মৃত্যুর জন্য দায়ী। বৈদিক যুগের সাবিত্রীর মতো মানুষের এই ধরনের মৃত্যুকে জয় করার চেষ্টা অনেকদিনের। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইউরোপে অজ্ঞান হয়ে পড়া ব্যক্তিদের দ্রুত গতিতে ধাবমান ঘোড়ার পিঠে কিংবা ব্যারেলের উপর ছুঁড়ে দেয়া হতো। উদ্দেশ্য তাদের বুকের ভিতর বায়ু চলাচল করানো। ১৯৫৪ সালে ইলাম ও তার সহকর্মীরা মুখ থেকে মুখে বা মুখ থেকে নাকে শ্বাস প্রশ্বাসের পদ্ধতি আবিস্কার করেন, যা পানিতে ডুবে যাওয়াদের ক্ষেত্রে কার্যকর প্রমাণিত হয়। পরবর্তীতে শ্বাসপ্রশ্বাসের সাথে রক্ত চলাচলের প্রয়োজনীয়তাও স্বীকৃত হয় এবং ১৯৬০ সালে আক্রান্ত ব্যক্তিকে উদ্ধমুখী শোয়ানো অবস্থায় যুগপৎ হৃৎপিণ্ডের উপর চাপ প্রয়োগ (ম্যাসাজ) করে রক্ত চলাচল করানো এবং মুখে মুখে শ্বাস প্রশ্বাস করানোর পদ্ধতি আবিস্কৃত হয়। এটাই কার্ডিওপালমোনারী রিসাসিটেশন (Cardiopulmonary resmcitation) বা সিপিআর। এই পদ্ধতিতে বুকের উপর চাপ প্রয়োগে বুকের চ্যাপ্টা হাড় ষ্টার্নামকে ২ ইঞ্চি দাবিয়ে দিয়ে হৃৎপিণ্ডকে ষ্টার্নাম আর পিটের মেরুদন্ডের মাঝখানে সংকুচিত করা হয়। এতে মস্তিস্ক ও শরীরের অন্যান্য স্থানে রক্ত প্রবাহ পুনঃ স্থাপিত হয়। এই প্রক্রিয়ায় থেমে যাওয়া হৃৎপিণ্ড আবার কাজ শুরু করে। এতে মৃত কিংবা মৃতপ্রায় ব্যক্তি প্রাণ ফিরে পায়। তাই তা এক মৃত্যুঞ্জয়ী ব্যবস্থা। এই ব্যবস্থা দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং আমেরিকান হার্ট অ্যাসোসিয়েশন চিকিৎসকদের জন্য সিপিআর প্রশিক্ষণ শুরু করে। বর্তমানে সুপারিশকৃত সিপিআর-এ মিনিটে ১০০ বার ম্যাসাজ দিতে হবে। দুইজন সেবাদানকারীর ক্ষেত্রে ম্যাসাজ ও শ্বাস প্রয়োগের অনুপাত ৩০:২ হারে। তবে আক্রান্ত ব্যক্তি অপরিচিত হলে কিংবা পারিপাশ্বিক পরিস্থিতি অনুকুল না হলে সেক্ষেত্রে কেবল ম্যাসাজ দিয়ে যাওয়াকে সুপারিশ করা হয়েছে। কোন পূর্ব প্রশিক্ষণ ছাড়াও যেকোন ব্যক্তি এই জীবন রক্ষাকারী ব্যবস্থা প্রয়োগ করতে পারে। এ প্রক্রিয়া চালিয়ে যেতে হবে যতক্ষণ পর্যন্ত আক্রান্ত ব্যক্তির হৃৎস্পন্দন ও শ্বাস ফিরে না আসে কিংবা অ্যাম্বুলেন্সে আক্রান্ত ব্যক্তিকে সিসিইউতে পৌঁছানো যায়। এ ক্ষেত্রে রোগীর অবস্থা উন্নতি না হলেও তা ২ ঘন্টা পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়া বাঞ্ছনীয়। যেকোন পরিস্থিতিতে, যেকোন ব্যক্তির এই সিপিআর প্রয়োগের প্রয়োজনীয় ধারনা ও সক্ষমতা থাকা আবশ্যক। তাই তা মৌলিক জীবনরক্ষাকারী ব্যবস্থা হিসাবে স্বীকৃত। মৌলিক জীবনরক্ষাকারী ব্যবস্থা সিপিআর মৃত্যু ঠেকিয়ে দেয়। কিন্তু হৃদপিণ্ডের ছন্দহীনতা ডেন্ট্রিকুলার ফিব্রিলেশনকে নির্মূল করতে প্রয়োজন হয় ডিসি শক্‌ প্রয়োগ তা ডিফিব্রিলোশন।। হৃদপিণ্ডের প্রাণঘাতি এই ছন্দহীনতা দূর করে হৃৎযন্ত্রের কাজকে নিবিঘ্ন করতে এই ধরনের ইলেকট্রিক্যাল ব্যবস্থা সহ আরো জীবন রক্ষাকারী ব্যবস্থা রয়েছে। এগুলো উন্নত জীবন রক্ষাকারী ব্যবস্থা। ১৯৭০ সাল থেকে তা চালু হয়। হৃদরোগের আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির অন্যতম ব্যবস্থা করোনারী কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) তারই অংশ। তবে সিসিইউতে কেবল সেখানে ভর্তি হওয়া রোগীদের ডিসিশক ও অন্যান্য জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসা প্রদান সম্ভব। শতকরা ৬০ ভাগ কার্ডিয়াক অ্যারেষ্ট ঘটে হাসপাতালের বাইরে। এই বাস্তবতায় বর্তমানে সিসিইউর বাইরে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পাবলিক স্থানে যেমন, খেলার মাঠ, বিনোদনকেন্দ্র, এয়ারপোর্ট, বাস ও রেল ষ্টেশন, এপার্টমেন্টে স্বয়ংক্রিয় ডিফিব্রিলেটর (automatic external defibrillator বা AED ) স্থাপন করা হয়। তা আক্রান্ত ব্যক্তিকে সিপিআর দেওয়ার সম্ভাব্য স্বল্প সময়ের মধ্যে ডিসি শক প্রয়োগ করতে সক্ষম। হৃদরোগ চিকিৎসার উৎকর্ষ তার বর্তমান পর্যায়ে হঠাৎ মৃত্যুবরণের ঝুকি পরিহার করতে শরীরে প্রতিস্থাপনযোগ ডিফিব্রিলেটর (implantable defibrillator) বা আইসিডি এর মাধ্যমে হঠাৎ মৃত্যু প্রতিরোধ সম্ভব।
পরিশেষে, সিপিআর বিষয়ক জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ যেকোন পরিস্থিতিতে জীবন রক্ষার প্রচেষ্টা হিসাবে প্রয়োগ করা আবশ্যক। সমাজের সকলের সিপিআর জানা প্রয়োজন। বিশেষত ঝুঁকিপূর্ণ হৃদরোগীর পরিবারের সকল সদস্যের তা জানা জরুরী। সিপিআর এর জ্ঞান চিকিৎসকদের নৈতিক সমর্থন যোগাতেও প্রয়োজন। অন্যথায় হাসপাতালের সিসিইউতে সিপিআর দেওয়ার সময় রোগীর স্বজন মনে করতে পারে যে ভূলক্রমে চিকিৎসক চাপ দিয়ে রোগীর মৃত্যু ত্বরান্বিত করছে।
তাই সবাই সিপিআর সম্পর্কে জানুন, হঠাৎ হৃৎক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যাওয়ার মুহুর্তে শোকাতুর হয়ে নিজের বুক না চাপড়িয়ে আক্রান্ত প্রিয়জনের বুকে চাপড়ান- সিপিআর দিন। এভাবে আপনি আপনার প্রিয়জনের হৃৎপিণ্ডকে জাগিয়ে তুলতে পারে না, তার জীবন ফিরে আসতে পারে। এক্ষেত্রে আপনার জ্ঞান, নিষ্টা ও একাগ্রতা আপনার প্রিয়জনকে বাচাতে পারে। যেমন সাবিত্রী বাচিঁয়েছিল তার স্বামী সত্যবানকে।
পুনশঃ এই ধরনের হঠাৎ হৃদক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে হরহামেশ। তা প্রতিরোধে হৃদরোগ প্রতিরোধ করা অপরিহার্য্য। অনাকাঙ্খিত এই পরিস্থিতি দেখা দিলে কাল বিলম্ব না করে সিপিআর শুরু করুন ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসা গ্রহণ করন। এত ঠেকানো যেতে পারে হঠাৎ মৃত্যু। বাচানো যেতে পারে আপনার প্রিয়জনকে।
লেখক : হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ও প্রাক্তন বিভাগীয় প্রধান, হৃদরোগ বিভাগ,
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল ও মহাসচিব, চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধশিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও চিকিৎসা সেবা
পরবর্তী নিবন্ধড. মঈনুল ইসলামের কলাম