দেশের আগামীর বন্দর হিসেবে বিবেচিত বহুল প্রত্যাশার বে-টার্মিনালের ‘চ্যানেল খনন’ এবং ‘ব্রেক ওয়াটার’ নির্মাণে প্রয়োজনীয় চার হাজার কোটিরও বেশি টাকা যোগান দিতে আগ্রহী বিশ্ব ব্যাংক। অর্থ বিনিয়োগের আগে বে-টার্মিনালের সার্বিক অবস্থা সরজমিনে পরিদর্শন এবং বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ করতে বিশ্বব্যাংকের উচ্চ পর্যায়ের একটি বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধিদল ‘লম্বা’ সফরে চট্টগ্রাম আসছে। আগামী ৪ সেপ্টেম্বর থেকে ১২ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত প্রতিনিধিদলটি চট্টগ্রাম অবস্থান করবে। বে-টার্মিনালের ব্যাপারে বিশ্বব্যাংকের টেকনিক্যাল মিশন নামের ১১ সদস্যবিশিষ্ট এই প্রতিনিধিদলটি চারদিন ব্যয় করবে চট্টগ্রাম বন্দরে।
বন্দর সূত্র জানায়, দেশের আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্যের আগামী দিনের চাহিদা পূরণ করতে পতেঙ্গা-হালিশহরের সমুদ্র উপকূলে নির্মাণ করা হচ্ছে বে-টার্মিনাল।
টার্মিনালটি পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ বা পিপিপি ভিত্তিতে করতে প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এতে বলা হয়েছে যে, বে-টার্মিনাল নির্মাণ প্রকল্পটি পিপিপি (সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব) এবং জি টু জি (সরকার টু সরকার) পদ্ধতিতে সম্পন্ন করতে হবে। পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের জন্য ইতোমধ্যে কেবিনেট কমিটি অন ইকোনমিক অ্যাফেয়ার (সিসিইএ) কমিটির অনুমোদন প্রক্রিয়াও সম্পন্ন হয়েছে। প্রকল্পটি অপারেট করার ব্যাপারে বিশ্বের বেশ কয়েকটি দেশ আগ্রহী হলেও শেষ পর্যন্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই বন্দরের কার্যক্রম কার ভাগ্যে জুটে তা নিয়ে নিশ্চিত নন কেউ। দ্য পোর্ট অব সিঙ্গাপুর অথরিটি (পিএসএ), সৌদি আরবের রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল (আরএসজিটি) এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই পোর্ট বে-টার্মিনালের ব্যাপারে বেশ আগ্রহী। তবে বে টার্মিনাল কাদের দ্বারা পরিচালিত হবে তা নিয়ে দর কষাকষির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে সরকারের নিয়োগ দেয়া ট্রানজেকশন অ্যাডভাইজার নানাদিক আলোচনা করে উভয়পক্ষের জন্য ‘উইন-উইন’ পরিস্থিতি তৈরি করে অপারেটর নিয়োগের চুক্তি করবে।
তবে অপারেটর নিয়োগের আগে প্রকল্পটি বাস্তবায়নই বর্তমানে মূখ্য হয়ে উঠেছে। আর এই প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য দুইটি খাতে বিনিয়োগের ব্যাপারটি আলোচনায় উঠে এসেছে।
নগরীর উপকণ্ঠে হালিশহরে জেগে উঠা একটি চরের কারণে বে টার্মিনাল নির্মাণের সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। এই চরের পাশেই প্রথমে চ্যানেল খনন করতে হবে। শুধু চ্যানেলই নয়, এই বন্দরে নিরাপদ জাহাজ বার্থিং এবং হ্যান্ডলিং করতে ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ করতে হবে। সাগরে বাঁধ না দিয়ে বে-টার্মিনাল গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। এতে করে চ্যানেল খনন এবং ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ বে-টার্মিনাল প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ। এই দুইটি কাজই অনেক বড় এবং ব্যয়বহুল। চ্যানেল খনন এবং ব্রেক ওয়াটার নির্মাণে কয়েক হাজার কোটি টাকার প্রয়োজন।
বিশাল এই বিনিয়োগ কোত্থেকে হবে বা কারা করবে সেটা নিয়ে অনেকদিন ধরে আলাপ আলোচনা চলে আসছে। পুরো বিনিয়োগটাকে অনুৎপাদনশীল হিসেবেও বলা হচ্ছিল। টার্মিনাল পরিচালনা করতে অনেকে আগ্রহী হলেও তাদের কেউই ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ এবং চ্যানেল ড্রেজিংয়ে বিনিয়োগ করতে আগ্রহ দেখায়নি। এই বিপুল অর্থ বিনিয়োগ করে তার রিটার্ন পাওয়াও বিদেশী অপারেটরের জন্য কঠিন বলেও সূত্রগুলো মন্তব্য করেছে। এ ক্ষেত্রে বিদেশী অপারেটরেরা বন্দর কর্তৃপক্ষের নিকট প্রস্তাব দিয়েছে যে, বন্দর কর্তৃপক্ষ যদি নিজস্ব তহবিল কিংবা কোন বিদেশী অর্থ লগ্নীকারী প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে ব্রেক ওয়াটার নির্মাণ ও চ্যানেল তৈরি করে দেয় সেক্ষেত্রে অপারেটরেরা ইক্যুইপমেন্ট স্থাপন করে বন্দর পরিচালনা করবে।
এই বিপুল পরিমাণ অর্থ যোগান দেয়ার জন্য বেশ কয়েকটি বিদেশী সংস্থা আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে বিশ্ব ব্যাংক এবং কোরিয়ার এসবিএফসি ইতোমধ্যে বে-টার্মিনালের এই দুইটি খাতে পুরো অর্থ বিনিয়াগের প্রস্তাবনা দিয়েছে। এর বাইরেও কয়েকটি সংস্থা আগ্রহী বলে জানা গেছে। এদের মধ্যে কেউ কেউ অত্যন্ত স্বল্প সুদে দীর্ঘমেয়াদী কিস্তিতে এই ঋণ প্রদান করতে চাচ্ছে। তবে এ ক্ষেত্রে কোন সংস্থা থেকে ঋণ নিলে বন্দর কর্তৃপক্ষ লাভবান হবে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে ইতোমধ্যে মন্ত্রণালয়ে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকও হয়েছে।
বন্দরের শীর্ষ একজন কর্মকর্তা জানান, বে-টার্মিনাল প্রকল্প অনেক বড় একটি কাজ। পিপিপির মাধ্যমে এই টার্মিনাল পরিচালিত হবে। এতে বেশ কিছু বিষয় সামনে চলে এসেছে। ব্রেক ওয়াটার এবং চ্যানেল ড্রেজিংয়ের টাকা বন্দর কর্তৃপক্ষকে নিজস্ব তহবিল থেকে কিংবা বিদেশী কোনো সংস্থা থেকে ঋণ হিসেবে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে কাদের কাছ থেকে ঋণ নিলে পরিশোধে সুবিধা পাওয়া যাবে, সুদ কম হবে, কিস্তি দীর্ঘ হবে ইত্যাদি বিষয় আগে যাছাই-বাছাই করা হবে।
বিশ্বব্যাংক এ ক্ষেত্রে বেশ আগ্রহী বলে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, তারা ওই দুইটি খাতের প্রয়োজনীয় সব অর্থ প্রদানের প্রস্তাব দিয়েছে। তারা অত্যন্ত সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদী এই ঋণ প্রদান করতে চায়। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে তাদের প্রস্তাবনা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হচ্ছে।
বিশ্ব ব্যাংকের উক্ত প্রস্তাবনার মাঝে আগামী ৪ সেপ্টেম্বর উচ্চ পর্যায়ের একটি বিশেষজ্ঞ প্রতিনিধিদল চট্টগ্রাম বন্দরে আসছে। টেকনিক্যাল মিশনের অংশ হিসেবে প্রতিনিধিদলটি বে-টার্মিনাল এলাকা পরিদর্শন, সাগরের গতি প্রকৃতি, স্রোতের তীব্রতা, জোয়ার-ভাটাসহ নানা বিষয়ে সরজমিনে পরিদর্শন করবে। বিশ্ব ব্যাংকের সিনিয়র ট্রান্সপোর্ট স্পেশালিস্ট মি. হুয়া তানের নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিদলে সিনিয়র ইনফ্রাস্ট্রাকশার প্রোগ্রাম লিডার রাজেশ রোয়াতগি, প্রোগ্রাম কো-অর্ডিনেটর দিলশাদ দোসানি, সিনিয়র এনভায়রণমেন্টাল লিসবেট কুগলার, সিনিয়র স্যোশাল ডেভলপমেন্ট স্পেশালিস্ট মোরিসিও মোনটেরিও ভিয়িরা, স্যোশাল ডেভলপমেন্ট স্পেশালিস্ট সাব্বির আহসান, সিনিয়র প্রকিউরমেন্ট স্পেশালিস্ট শ্রীনিবাস ডেভারাকোন্ডা, সিনিয়র ফিন্যান্সিয়াল ম্যানেজমেন্ট স্পেশালিস্ট মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন চৌধুরী, ট্রান্সপোর্ট কনসালটেন্ট তিয়ান মার্টিন, সিনিয়র পোর্ট ইঞ্জিনিয়ার কোমেলিস জোহানিজ ক্লাভার, সিনিয়র ড্রেজিং ইঞ্জিনিয়ার ড্রিক রোকিমা রয়েছেন। ১১ সদস্যের প্রতিনিধিদলটি বে-টার্মিনালের টেকনিক্যাল বিভিন্ন বিষয় নিয়ে বন্দরের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করার কথা রয়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার এডমিরাল এম শাহজাহানের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, বে-টার্মিনালের ব্রেক ওয়াটার এবং চ্যানেল খননের ব্যাপারে বিশ্ব ব্যাংক অনেক আগ থেকে আগ্রহী। বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধিদলের এই সফরের মাধ্যমে বে টার্মিনাল প্রকল্প বাস্তবায়নের পথে বড় অগ্রগতি হবে বলেও বন্দর চেয়ারম্যান আশাবাদ ব্যক্ত করেন।