(শেষ পর্ব)
রাইডের আজ শেষ দিন। গন্তব্য শ্যামনগরের দূরত্ব এখান থেকে খুব বেশি নয়। অন্যান্য দিনের তুলনায় খানিকটা দেরিতেই শুরু করলাম। ঝুম বৃষ্টি মাথায় নিয়ে মুন্সীগঞ্জ বাজার থেকে যাত্রা। পরিকল্পনা ছিল নদী লাগোয়া রাস্তা ধরার। কাঁচা রাস্তায় এই বৃষ্টিতে সাইকেল চালানোর সাহস কারোই হলো না। লাগোয়া পিচ রাস্তা ধরে প্যাডেল ঘুরানোটাই শ্রেয়। প্রথমদিকে বৃষ্টিতে ভেজা নিয়ে সবাই খানিকটা অস্বস্তিতে থাকলেও তা কেটে যেতে বেশি সময় লাগল না। অল্প বৃষ্টি থেকে মানুষ গা বাঁচানোর চেষ্টা করে। এমন গামলা ঢালা বৃষ্টি থেকে বাঁচার সুযোগ নেই। যদিও গিয়ার মাফিয়া তানভীর ভাই নানান অত্যাধুনিক সরঞ্জাম দিয়ে বৃষ্টি ঠেকানোর চেষ্টা করে যাচ্ছেন। কিন্তু প্রকৃতির সাথে মানব সন্তান কতক্ষণই-বা বুঝতে পারে? রণক্লান্ত হয়ে খানিক বাদে বাদে বৃষ্টির ফোঁটায় ঝাপসা হয়ে যাওয়া চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে বৃষ্টিকে শাপ-শাপান্তই করতে করতে এগোলেন।
কিছুদূর এগিয়েই হরিনগর বাজারে। সেতু পেরিয়ে শেষপ্রান্তের এক দোকানে লুচি, ডাল আর ছানা অর্ডার করা হলো নাশতার জন্য। ছানাটা মুখে পুরেই বুঝলাম একেবারে ফার্স্ট ক্লাস জিনিস। ছানার মোলায়েম কণাগুলোকে উপরের আর নিচের পাটির দাঁত আবেশে ডাকছে। মিষ্টান্ন জগতের অনেক রাজ-রাজড়া ছড়িয়ে আছে খুলনা অঞ্চলের পথে-ঘাটে। নাম-ডাক হয়তো অতটা নেই। কিন্তু স্বাদ আর মানটা আছে। বৃষ্টির তোড় বাড়ায় তখনই যাত্রা শুরু না করে কাঁচা বাজারে গেলাম। বাজারের পেছনের নদীর স্থানীয় নাম আইবুড়ো! চুনা নদীরই শাখা এটি। অবশ্য এ-পাড়ার মেধো ও-পাড়ার মধুসূদন হতেই পারে! অতিরিক্ত পলির কারণেই নদীর পানি ঘোলা। মন্থর গতিতে বয়ে চলছে। বাজারের সামনের প্যান্ডেলে পূজার মন্ডপে গান চলছে। স্থানীয় এক লোক তানভীর ভাইকে পাকড়াও করলেন। ঢাকার কোথায় বাসা জিজ্ঞেস করতেই তানভীর ভাই উত্তর দিলেন, শ্যামলী স্কয়ারের সামনে। ওই লোক রীতিমতো খেপে গিয়ে বললেন, ‘থানার নামে এলাকার নাম বলেন। ঢাকায় ৪৯টা থানা। কী সব স্কয়ারের-টস্কয়ারের নাম বলেন!’ আইবুড়ো নদীলাগোয়া রাস্তার নাম অতি অবশ্যই এই রাইডের বৈশিষ্ট্য অনুসারে ‘কাঠিমারা সরণি’ না হয়ে যায়-ই না!
বৃষ্টি আরেকটু ধরে ইলশেগুঁড়ির রুপ নিতেই আবার সাইকেলের প্যাডলে। এই টাইপ বৃষ্টিকে সিলেটের ভাষায় বলে ‘ফিনিফিনি মেঘ’! একটানা চালিয়ে এবার সুন্দরবন বাজার। দিনকয়েক আগেই একই নামের বাজার পেয়েছি মোংলার দিকে। রাস্তার দু’ধারেই অনেক শ্রিম্প হ্যাচারি। সাদা সোনা তথা চিংড়ির কৃত্রিম আবাস এসব জায়গায়। রাস্তার পাশে কালো বক্সে চাষকৃত কালো সোনা তথা কাঁকড়ার দেখাও মিলছে মাঝে মাঝে। আমাদের আপাত গন্তব্য মূলত ফাইভ রিভারস পয়েন্ট। পাঁচটা নদী এসে মিশেছে এখানে। রাইডের পরিকল্পনা করার সময়ই এই জায়গাটা গুগল ম্যাপে দেখে মহা উত্তেজিত ছিলাম। পথিমধ্যে কালিঞ্চীর রাস্তা জিজ্ঞেস করায় এক লোক জানাল ওদিকে যাওয়া যাবে না। রাস্তা ক’দিন আগের বন্যায় ভেঙে গেছে। অগত্যা খানিকটা ঘুরপথে এগোতে হবে।
কৈখালি কোস্ট গার্ডের ভবনের পাশ দিয়ে ইটের সলিন রাস্তা এগিয়েছে ফাইভ রিভারস পয়েন্ট অবধি।
কোস্ট গার্ড ভবনের সামনেই এক স্থানীয় কিশোরকে জিজ্ঞেস করায় জানাল, ‘এইখান থেকে তো ম্যালা রাস্তা। ২ কিলোমিটার তো হবেই!’ পরবর্তীতে ২ কিলোমিটারের অনুমান সঠিক না হলেও ম্যালা রাস্তার বিষয়টা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি। চালাতে গিয়ে মনে হয়েছে রাস্তা প্রায় ৫-৬ কি.মি.। তবে সবচেয়ে বাজে ব্যাপার হলো, রাস্তাটা ভয়ানক ভাঙা। ইটের সলিনের রাস্তা আর বৃষ্টি মিলে সবার নাজেহাল অবস্থা। স্থানীয় পাঠাও সার্ভিসের বাইকই লোকালদের ভরসা। এমনকী টমটম চলারও জো নেই। অপর পাশ থেকে মোটরসাইকেল আসলে সাইড দিতে গিয়ে বারদুয়েক স্লিপ করলাম। অল্পের জন্য রাস্তার পাশের নিচু জমিতে পড়ে যাওয়া থেকে বাঁচলাম একবার। অশান্তির আলাপ বাদ দিয়ে একটু শান্তির ব্যাপার বলি। চোখের শান্তি হিসেবে হাতের ডান পাশেই হাত ছোঁয়া দূরত্বে আছে নদী।
রাবাত ভাই আমাদের তিনজনের পেছনে সাইকেলের স্পিডে মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন। লোকে আমাদের তিন সাইকেল আরোহীকে হাঁ হয়ে দেখছে। এক জায়গায় এসে সলিন রাস্তা শেষ। মাটির কাঁচা রাস্তার ভয়াবহ কাদা শুরু। ফাইভ রিভারস পয়েন্ট ওখান থেকে কাছেই। স্থানীয়রা অবশ্য ‘ফাইভ রিভারস পয়েন্ট’ শব্দাবলীর সাথে একেবারেই পরিচিত নয়। ‘পাঁচ গাঙের মুখ’ এই নামটাই প্রচলিত। সাইকেল একপাশে রেখে চায়ের দোকানে ঢুকতেই স্থানীয় লোকের কৌতূহলের মুখে পড়ে গেলাম। স্থানীয়রা চায়ের দোকানের বারান্দায় রাখা ক্যারমবোর্ডে খেলছিল। এবার শুরু হলো প্রশ্নবাণ।
মোহনা দেখতে এসেছি দেখে স্থানীয়রাই জানাল, একটা নৌকা নিয়ে অল্প একটু এগোলে দেখা যাবে গাঙের মুখ। আকিনুর আর বিল্লাহ নামে দুই কিশোর নিজের আগ্রহেই রাজি হলো নৌকা চালিয়ে নিতে। কাদা ডিঙিয়ে নৌকায় চড়ে বসলাম। স্থানীয় নারীদের কৌতূহলী চাহনি উপেক্ষা করে নৌকায় মিনিট তিন-চারেক যেতেই মোহনা। পাঁচটা নদীকেই ভালোমতো দেখার উদ্দেশ্যে আরেকটু এগোলাম আমরা। এখানে এসেই মিশেছে কালিন্দী, মামুনদি, মাদার, মীরগাঙ এবং একটি শাখা নদী। অল্প দূরে উঁকি দিচ্ছে সুন্দরবনের নিবিড় সবুজের বুনন। হাতের ডানদিকে ভারতের শমশেরনগরের বেশকিছু পর্যটকবাহী নৌকার দেখা মিলল। জায়গাটার নিসর্গ শোভা দারুণ। কালিন্দী দেখেই সানি তার অন্যতম প্রিয় লেখক শাহাদুজ্জামানের লেখা ‘কয়েকটি বিহবল গল্প’ বই থেকে আওড়াতে শুরু করল, ‘যে চোখে কাজল দিলে কালিন্দী হয়ে যেত, মানুষ তাকে ঢেকে রাখে চৌকস কালো চশমায়।’
পৃথিবীর তিনভাগ জলের সমান কারো কান্নাভেজা চোখ?’- অসংখ্য জলরাশির মাঝে দোদুল্যমান নৌকায় বসে কবি আবুল হাসানের কবিতার এই লাইনটা মনে পড়ছিল। আমাদের দুই কিশোর মাঝির কাছে সুন্দরবনকে একটু ছুঁয়ে দেখার বাসনা ব্যক্ত করতেই ওরা আবার বৈঠা হাতে সক্রিয় হলো। একদম বনের কাছে নিয়ে গেল এইবারে। সানির অনুরোধে ছোট্ট একটা খালে নৌকা ঢোকাল দুই কিশোর। সুন্দরী গাছ চেনালো ছোট্ট মাঝি। সাথে খেজুর গাছের মতো দেখতে একটা গাছ থেকে কী একটা ফল পেড়ে এনে হাতে ধরিয়ে দিল ওরা। নানান কসরত করে পানসে সেই ফলটা খেলাম। এখান থেকে ভারতের অংশের সুন্দরবন একেবারেই হাতছোঁয়া দুরত্বে। ফিরতি পথে বাংলাদেশের দিকে বনঘেঁষা দ্বীপের মতো দেখতে লোকালয় দেখাল ওরা। ওইখানে নাকি বাঘ হানা দিয়েছিল বছর কয়েক আগে। দুই কিশোর মাঝির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরতি পথে চালিয়ে ভেটখালি বাজারের আগে থামলাম।
টানা বৃষ্টিতে বেশ ঠান্ডাই লাগছিল। একটা টং দোকান থেকে গরম পানি চেয়ে নিয়ে সাথে থাকা কফি পান করার এন্তেজাম হলো। মাছ নিয়ে বরাবর উৎসাহী রাবাত ভাই মালকিনকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনাদের এইদিকে তো ভালো মাছ হয়। আপনারা তো নিশ্চয়ই ভালো ভালো মাছ খান? মালকিন উত্তর দিলেন, ‘টাকা থাকলে সব খাওয়া যায়!’ উত্তর শুনে আমরা একেবারে থ। এরচেয়ে সহজ-সরল সত্য আর হয় না। কফিটা স্থান পেয়েছিল আমাদের উদরে। আর ওই নারীর কথাটা স্থান পেয়েছে আমাদের মনে।
টানা চালিয়ে ভেটখালী বাজার, বংশীপুর মোড়, সোনার মোড় হয়ে শ্যামনগরে প্রবেশ করতেই বাড়ল বৃষ্টি। এইবারে বিশাল সব ফোঁটা। বৃষ্টিকে আমলে না নিয়েই উপজেলা পরিষদের পুকুরে গোসল সেরে চলে গেলাম কাশেম হোটেলে। আমরা অর্ডার করলাম টাইন মাছ। আর তানভীর ভাইয়ের পছন্দ খাসি। মাছের রাজ্যে এসেও খাসির মাংস খেতে চাওয়ায় আমরা নানাভাবে তাকে ত্যক্ত করলেও সে সিদ্ধান্তে অনড়। তানভীর ভাইয়ের কাছ থেকে বেহায়ার মতো একটু খাসি চেয়ে মুখে ফেলতেই চোখ ছানাবড়া। টাইন মাছের চেয়ে খাসির মাংসটা খেতে অসম্ভব ভালো। এইজন্যই বলে ‘আপ রুচি খানা, পর রুচি পরনা’। আরেক দফা খাসি অর্ডার করা হলো। একটু বাদেই আবিষ্কার করলাম খাসির মাংসের চেয়ে খাসির মাংসের ঝোলটা দারুণ। ঝোল দিয়ে এক প্লেট ভাত খেয়ে সানিকে বললাম, ‘এই খাসির ঝোল দিয়ে দুই প্লেট ভাত আরামসে খাওয়া যায়।’ সে জবাব দিল, ‘ভাই, আমি এটা নিয়ে দুই প্লেট খেলাম ঝোল দিয়ে!’ এবার ফেরার পালা। দেশের ওইপ্রান্তের শহর সিলেটে ফিরতে হবে বাসযোগে। সেখানে অপেক্ষায় আছে আমার নীরব-নিথর, বোবা ছোট্ট ফ্ল্যাটটা!