চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নে পদক্ষেপ নিতে হবে

এম.এ. মাসুদ | বৃহস্পতিবার , ৩ মার্চ, ২০২২ at ৬:১৬ পূর্বাহ্ণ

আমাদের দেশের রোগীরা চিকিৎসার জন্য ভারতমুখী হন কেন বা সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক যান কেন – এই প্রশ্নের জবাব খোঁজার সময় এসেছে। শুধু ধনী রোগীরাই যে চিকিৎসার জন্য বিদেশ যান তা কিন্তু নয়। মধ্যবিত্ত শ্রেণির রোগীরাও ধার দেনা করে এসব দেশে চিকিৎসার জন্য যান। অপেক্ষাকৃত কম খরচে এমনকি আমাদের দেশের চেয়েও কম অর্থব্যয়ে চিকিৎসা করা যায় বলে সবচেয়ে বেশী রোগী যান ভারতে। অতি ধনী রোগীদের মধ্যে সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক ছাড়াও যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রেও গিয়ে চিকিৎসা করার প্রবণতা রয়েছে।
আমাদের দেশের চিকিৎসার মান এখন অনেক উন্নত। যা আন্তর্জাতিক মানের কাছাকাছি এবং আমাদের দেশে বর্তমানে রয়েছেন অনেক অভিজ্ঞ চিকিৎসক। ২০/৩০ বৎসর আগে আমাদের দেশে চিকিৎসক, নার্স ও চিকিৎসা কর্মীর স্বল্পতায় কারণে মানুষ সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হত। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের চিকিৎসা জগতে বিপ্লব ঘটে গেছে বলা যায়। এখনো চিকিৎসক ও চিকিৎসা কর্মীর অভাব থাকলেও তা অত্যন্ত কম। আগামী ১০ বছরে এই অভাবও পূরণ হয়ে যাবে। তবে আমাদের দেশের সামগ্রিক চিকিৎসা ব্যবস্থাটি রাজধানী কেন্দ্রিক। দেশ সেরা অভিজ্ঞ চিকিৎসকবৃন্দ ঢাকায় চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন। এ সকল চিকিৎসকদের চিকিৎসা নিঃসন্দেহে আন্তর্জাতিক মানের। ঢাকায় গড়ে উঠেছে অনেক বড় বড় প্রাইভেট আধুনিক হাসপাতাল। দেশের উচ্চবিত্ত নাগরিকরা এখানে চিকিৎসা করাচ্ছেন। আমাদের দেশে এমন অনেক চিকিৎসক নার্স এবং চিকিৎসা কর্মী রয়েছেন তাদের মানবিকতা ও মহত্ব অতুলনীয়। রোগীর প্রতি মমত্ববোধ, দায়িত্ব এবং রোগীর প্রতি সেবার উদাহরণ দেশবাসী গত ২০২০-২০২১ সালে করোনার তীব্রতা কালীন সময়ে দেখেছে। এসকল চিকিৎসক, নার্স এবং স্বাস্থ্য কর্মীরা তাদের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করেছেন। করোনাক্রান্ত রোগীর চিকিৎসা করতে গিয়ে তাঁরা মানবিকতার এবং দায়িত্ববোধের যে পরিচয় দিয়েছেন এবং নিজেদের জীবন হারিয়েছেন তাঁরা আমাদের দেশের চিকিৎসা পেশারই লোক। দেশবাসী তাঁদের স্মৃতি প্রতি শ্রদ্ধা ও সালাম জানায়। এসকল জীবন উৎসর্গকারী ব্যক্তিবর্গ আমাদের চিকিৎসা জগতেরই মানুষ। তাদের মত মানুষ আছেন বলেই বাংলাদেশের চিকিৎসার মান এখন অনেক উন্নত হয়েছে।
আমাদের দেশের সরকারী হাসপাতাল সমূহে এবং ডাক্তারের প্রাইভেট চেম্বারে যারা চিকিৎসা করান তারা সাধারণতঃ মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত, দরিদ্র শ্রেণির নাগরিক। দেশের কিছু নামী প্রাইভেট হাসপাতাল রয়েছে সে সব হাসপাতাল সমূহে উচ্চবিত্ত রোগী ব্যতীত সাধারণ মধ্যবিত্ত বা নিম্নবিত্তদের চিকিৎসা নেওয়ার সাধ্য বা সামর্থ নেই। এসব হাসপাতালের চিকিৎসা ব্যয় এত বেশী যে, তাদের পক্ষে এসব হাসপাতালে চিকিৎসা বিল পরিশোধ করা অসম্ভব। কিছু কিছু প্রাইভেট হাসপাতালে এমন অনেক ঘটনা ঘটেছে যা অস্বাভাবিক। একটি প্রাইভেট হাসপাতালে একজন মহিলা ডাক্তারের প্রসবকৃত সন্তানকে মৃত বলে ঘোষণা দিয়ে তাকে প্যাক করে ঐ মহিলা ডাক্তারের হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সেই মহিলা ডাক্তার তাঁর সন্তান যে মৃত নয় এ ব্যাপারে উক্ত হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিবাদ জানিয়ে তাঁর সেই সন্তানকে অন্য একটি প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যান। সেই হাসপাতালের ডাক্তারগণ মৃত ঘোষিত শিশুটিকে জীবন্ত অবস্থায় পান এবং তার চিকিৎসা করেন। অপর একটি প্রাইভেট হাসপাতালে একজন রোগীর চিকিৎসার বিপুল অংকের বিল পরিশোধে তার অভিভাবকরা অক্ষম হওয়ায় সেই মৃত রোগীর মৃতদেহ দীর্ঘদিন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ মর্গে আটকে রেখেছিল। পরে একজন রাজনৈতিক নেতার হস্তক্ষেপে লাশ অভিভাবকদের নিকট হস্তান্তর করা হয়।
যে সকল ডাক্তার প্রাইভেট চেম্বারে রোগী দেখেন তাঁদের মধ্যে অধিকাংশ ডাক্তারের ফিস অস্বাভাবিক বেশী। এই ফিস জোগাড় করে চিকিৎসা করানো একজন সাধারণ রোগীর পক্ষে ভীষণ কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে। এমন কিছু ডাক্তার আছেন, যারা রোগী ডাক্তারের চেম্বারে প্রবেশের আগেই অর্থাৎ ডাক্তার কর্তৃক রোগীর চেহারা দেখার আগে এবং রোগীকে পরীক্ষা করার আগেই তাঁর সহকারীর মাধ্যমে রোগীর কাছ থেকে ফিস আদায় করে নেন। যা অত্যন্ত দৃষ্টিকটু এবং অনৈতিক। কিছু কিছু ডাক্তার রোগীর সাথে ভালভাবে কথা বলেন না এবং রোগীর সাথে তার রোগ সম্পর্কে খোলাখুলি আলাপ করেন না। দ্রুত প্রেসক্রিপশন লিখে রোগীকে বিদায় করেন। কোন কোন ডাক্তারের অহংবোধ এতই বেশী যে, তারা রোগীদের প্রতি ব্যবহারে ন্যূনতম সৌজন্যতা বা আন্তরিকতা দেখান না। একজন মানুষ রোগাক্রান্ত হয়ে অত্যন্ত অসহায় অবস্থায় ডাক্তারের কাছে যান। কিন্তু এ জাতীয় মনোভাবাপন্ন ডাক্তারের আচরণে রোগীরা নিজেকে অপামানিত ও অসম্মানিত বোধ করেন। সরকারী হাসপাতালে, বিশেষ করে মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙ এবং অন্যান্য সরকারী হাসপাতালের বয়-বেয়ারা, আয়া এসব কর্মচারীরা রোগীদের সাথে যে চরম অবমাননাকর আচরণ এবং দুর্ব্যবহার করেন তা অত্যন্ত অসম্মানজনক এবং মানবিকতার চরম অপমান। রোগীদের অসহায়ত্বের সুযোগ তারা রোগী বা রোগীর অভিভাবকদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করেন। রোগীরা সরকারী হাসপাতালে যথাযথ সম্মান ও সহমর্মিতা না পেয়ে অপমানিত এবং অসম্মানিত হয়ে প্রাইভেট ক্লিনিক বা হাসপাতালে যেতে বাধ্য হন। কিছু কিছু প্রাইভেট হাসপাতালে রোগীদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে চিকিৎসা শেষে রোগীর হাতে বিরাট অংকের আজগুবি বিল ধরিয়ে দেন। গত বছর করোনার তীব্রতা কালীন সময়ে শাহেদ নামের একজন ভন্ড রাজনীতিককে তার মালিকানাধীন রিজেন্ট হাসপাতাল নামক একটি ভূয়া হাসপাতালে করোনার ভূয়া পরীক্ষার মাধ্যমে জনপ্রতি পরীক্ষায় তিন হাজার টাকা করে নিয়ে অসহায় মানুষের জীবন নিয়ে খেলতে দেশবাসী দেখেছে। তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে এবং সে এখন জেল হাজতে। ফৌজদারী কার্যবিধির ৩০২ ধারায় তার বিচার করে উক্ত ধারায় নির্দেশিত দণ্ডে তাকে দণ্ডিত করাই হবে তার উপযুক্ত শাস্তি। দেশের সরকারী হাসপাতাল সমূহে চিকিৎসার জন্য যারা ভর্তি হন তাদের বিনামূল্যে চিকিৎসা এবং ঔষুধ পাওয়া কথা। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীরা বিনা ফি-তে ডাক্তারের পরামর্শ পেয়ে থাকেন সত্য এবং সামান্য কিছু কম দামী ঔষধও পান। কিন্তু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রোগীদের বা তাদের অভিভাবকদের বাইরে থেকে ঔষধ কেনার জন্য এবং বিভিন্ন পরীক্ষার জন্য হরদম স্লিপ দেওয়া হয়। সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা প্রার্থী রোগী এবং রোগীর অভিভাবকদের হাসপাতালের কর্মচারী কর্তৃক গায়ে হাত তোলার মত ঘটনাও আছে যা রোগী এবং তার অভিভাবকদের জন্য চরমা অবমাননাকর।
এ সকল কারণে অধিকাংশ মানুষ চিকিৎসার জন্য ভারতমুখী হয়ে পড়েন। তাদের মনে এটা বদ্ধমূল ধারণা হয়েছে যে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ব্যয়বহুল। তাদের বিশ্বাস ভারতে গেলে তারা কম খরচে সুচিকিৎসা পাবেন, ডাক্তাররা তাদের সাথে খোলাখুলিভাবে আলাপ করে তাদের রোগের ইতিহাস জানবেন এবং সে অনুযায়ী চিকিৎসা দেবেন। ডাক্তারা তাদের প্রতি ভাল আচরণ করবেন এবং তাদেরকে অপমানিত বা অসম্মানিত হতে হবে না।
প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক বাংলাদেশী ভারতে চিকিৎসার জন্য যান। এতে দেশের বিপুল পরিমাণ বিদেশী মুদ্রা ভারতে চলে যাচ্ছে। চিকিৎসার জন্য মানুষের ভারত প্রীতি রোধ করতে হলে দেশের সকল সরকারী হাসপাতালে কর্মরত সকল চিকিৎসা কর্মীকে রোগীদের প্রতি তাদের আচরণে পরিবর্তন আনতে হবে এবং সরকারী হাসপাতালের চিকিৎসা কর্মীদের রোগী বা রোগীর অভিভাবকদের কাছ থেকে অর্থ আদায় বন্ধ করতে হবে। প্রাইভেট হাসপাতালগুলো কর্তৃক রোগীদের কাছ থেকে অস্বাভাবিক অংকের বিল দিয়ে মোটা অংকের অর্থ আদায় বন্ধ করতে হবে। একজন মানুষ রোগাক্রান্ত হলে তিনি সুচিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ হওয়ার জন্য নিজেকে ডাক্তারের কাছে সপে দেন। এই অবস্থায় রোগীর প্রতি সংবেদনশীল হওয়া ডাক্তারদের নৈতিক ও মানবিক দায়িত্ব। এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হলে এবং প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকের অতিরিক্ত অর্থ-আদায় বন্ধ না করা গেলে এবং রোগীদের প্রতি ভাল আচরণ না করলে চিকিৎসার জন্য বিদেশগামী মানুষের স্রোত বন্ধ করা যাবে না। দেশের দুর্নীতিগ্রস্ত চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়নে এখনই দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। লেখক : প্রাবন্ধিক, সমাজকর্মী

পূর্ববর্তী নিবন্ধলেখকের মনোভাব ও পাঠক প্রতিক্রিয়া
পরবর্তী নিবন্ধস্মরণে শ্রদ্ধায় ফয়েজ আহমদ চৌধুরী