বিদায়ী বছরের সাড়া জাগানো বিস্ময়, আফগানিস্তানে তালেবানের নয়া উত্থান। প্রতিরোধ বা বড় রক্তপাত ছাড়াই আগস্ট শুরুর ক’দিনেই আগ্রাসী হামলায় দেশটির সব প্রদেশ দখলে নিয়ে কাবুল কব্জা করে তালেবান। ১৫ আগষ্ট ২০ বছর পর আফগানিস্তান পুনঃদখলে আসে উগ্রবাদী তালেবানের। প্রায় দু’সপ্তাহ গোষ্ঠী দ্বন্দ্বে জড়িয়ে বিলম্বে সরকার গড়ে পশতুন গোষ্ঠীর কট্টর তালেবান।
শুরুতে তালেবানরা বৈশ্বিক সমর্থন পেতে দাবি করে, তারা পুরানো তালেবান না, নতুন তালেবান। আফগানবাসী সকল নাগরিক অধিকার ভোগ করবে। মার্কিন তাঁবেদার আমলের সরকারি কর্মকর্তারা ইনডেমনিটি ভোগ করে দায়িত্বে যোগ দিতে পারবে। শুধু দুর্নীতিসহ বড় অপরাধে জড়িতরা বিচারের আওতায় আসবে। স্কুল, কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চলবে। মেয়েরা কর্মক্ষেত্র, স্কুল কলেজে যেতে পারবে। সব অধিকারও ভোগ করবে। অবশ্য ক’ মাসেই তালেবানি হিজাব খুলে যায়। মেয়েরা কট্টর শরীয়া আইনে ঘরবন্দী হয়। হিজাব-নেকাব ছাড়া রাস্তায় নামলেই শাস্তি। মোজা পরাসহ ঘরের বাইরে নাক চোখও ঢেকে রাখতে বাধ্য তারা। স্কুল কলেজে যাওয়া একদম বন্ধ। পুরো মধ্যযুগীয় আঁধারে ডুবে যায় দেশ। সম্প্রতি জারি হয়েছে আরো কড়া বিধি নিষেধ। কোনো মেয়ে একা ৪৫ মাইল দূরের পথ গণপরিবহনে ভ্রমণ করতে পারবেনা। সাথে পুরুষ সঙ্গী থাকতে হবে। হিজাব নেকাব ছাড়া যানবাহনে চড়তে পারবেনা। পরিবহন মালিকদের এই নির্দেশ পালন বাধ্যতামূলক। সেলুনে শেভ করাও বন্ধ। শরিয়া আইনের নামে আরো বহু বন্য আইনের শিকলে জড়াচ্ছে দেশটি। সন্দেহ ভাজনদের খুন গুম চলছে বেপরোয়া। দায় নিচ্ছেনা সরকার। রেডিও, টিভিসহ সব বড় মিডিয়া বন্ধ। কারণ মেয়েদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। দেশটি ভয়াল দুর্ভিক্ষের মুখে। ৬০% মানুষের খাবার নেই, শীতবস্ত্র নেই। যুক্তরাষ্ট্রে জমা রাখা পৌণে ৮ বিলিয়ন ডলার আটকে আছে। সরকারি কর্মচারিরা বেতনও নিয়মিত পাচ্ছেনা। ব্যবসা বাণিজ্যের অবস্থা আরো করুণ। শীতে বরফ জমার সাথে সাথে সাধারণ মানুষের দুর্ভোগ চরমে। এই অবস্থায়ও যুদ্ধবাজ তালেবান থেমে নেই। তালেবান মেন্টর পাকিস্তান, টিটিপি (তেহরিকে তালেবান পাকিস্তান) জঙ্গি ঠেকাতে সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দিচ্ছে। তালেবান গোয়েন্দারা পাকিস্তান বাহিনীকে আটকে দিয়ে হাজার হাজার মিটার কাঁটাতার জব্দ করেছে। বাধা দিতে গেলে হয় উত্তপ্ত বাদানুবাদ। পরে দুদিন ধরে তুমুল সীমান্ত লড়াই চলে দু’পক্ষের। দু’পক্ষই কামান, মর্টারের মত ভারী অস্ত্র ব্যবহার করে। হতাহতের খবর না থাকলেও সীমান্ত উত্তেজনা কমেনি। এরপর পাকিস্তানে ইসলামি শাসনের বদলে পশ্চিমা ধাঁচের শাসন চলছে বলে অভিযোগ তালেবান মুখপাত্রের। তিনি কাবুল পাকিস্তানি খবরদারি মানবেনা বরং ইসলামাবাদকে তাদের পথে আসতে হবে বলেও স্পষ্ট জানিয়ে দেন। তালেবানদের সবচে ঘনিষ্ঠ মিত্র পাকিস্তান! তাদের মাধ্যমে চীনাসহ মানবিক সাহায্য আসছে কাবুলে। তালেবান স্বার্থ সুরক্ষায় সম্প্রতি ওআইসি’র বিশেষ সাধারণ সভাও ডাকে পাকিস্তান। দুর্যোগ মোকাবেলায় বড় তহবিল গড়া এবং স্বীকৃতি আদায়ের বাধা অপসারণে ডাকা সভাটি সৌদি বিরোধীতার মুখে ব্যার্থ হয়ে গেছে। সৌদি আরব পষ্ট জানিয়ে দেয়, আই এস জঙ্গি নির্মূল এবং তালেবান সরকার আধুনিক সভ্যতায় না ফিরে উগ্র জঙ্গিবাদ চর্চা করলে এ’অঞ্চলে আবারও সন্ত্রাসবাদ ডানা মেলবে। এতে পুরো মধ্যপ্রাচ্য, আরব জাহানসহ বিশ্বে নতুন করে সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ঘটাবে। আদতে ইমরানের পাকিস্তান খেলেছিল, তালেবানদের প্রতি ওআইসি’র সহানুভূতি আদায়ের নামে মধ্যপ্রাচ্যে নিজের অবস্থান শীর্ষে তুলে আনার খেলা। এতে ভারতের বিরুদ্ধেও জোরালো ফ্রন্ট তৈরি হতো। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বহুদেশ ভারতের ঘনিষ্ট বন্ধু। কিন্তু চালটি কেঁচে গেছে। তালেবানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হলেও সীমান্ত সংঘর্ষ ও টিটিপি অনুপ্রবেশে উদ্বিগ্ন পাকিস্তান। পুরো আফগানিস্তান জুড়ে ইসলামি জঙ্গিগোষ্ঠী আইএস হামলাও জোরদার হচ্ছে। হতাহতও প্রচুর। এর ঢেউ ভারতের কাশ্মীরের বদলে পাকিস্তানে বড় আঘাত হানবে বলে পাকিস্তানের আশঙ্কা। স্বাভাবিক কারণে উল্টো গাইছে, তালেবানের বীজতলা এবং মেন্টর পাকিস্তান। দেশটির তথ্যমন্ত্রী ফুয়াদ চৌধুরী ইসলামাবাদে ২৬ ডিসেম্বর এক অনুষ্ঠানে তালেবানদের বিরুদ্ধে প্রথম ক্ষোভ ঝেড়েছেন। বলেছেন, কাবুলের তালেবান সরকার ইসলামি শরীয়ার নামে দেশটিকে আঁধারে ঠেলে দিচ্ছে। মেয়েদের পায়ে বেড়ি পরাতে একের পর এক কঠিন অধ্যাদেশ জারি করছে। ২৫ ডিসেম্বর জারি করা অধ্যাদেশে মেয়েদের হিজাব নিকাবে আটকে ঘরবন্দী করার নিষ্ঠুরতম পদক্ষেপ। প্রতিবেশী দেশে এমন হলে পাকিস্তানেও প্রভাব পড়বে। আফগান মেয়েরা স্কুল, কলেজে যাওয়া, চাকরি বাকরি, ঘর থেকে বের হওয়া কিছুই করতে পারছে না। অস্থিতিশীল অবস্থা থেকে কাবুলকে ফেরানো অসম্ভব।
উল্লেখ্য, কাবুলে সোভিয়েত দখলদারিত্বের সময়ে পাকিস্তান মাদ্রাসা, মক্তব খানকা থেকে শুরু করে বিশেষায়িত সেনা আশ্রয়ে তালেবান বা ছাত্রদের মগজ সাফাই করে ইসলামি উগ্রতার বারুদ গুঁজে দেয়। সামরিক সরঞ্জামসহ আর্থিক, লজিস্টিক সহযোগিতা যোগায় যুক্তরাষ্ট্র। পাকিস্তানী সেনা গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই পুরো দায়িত্ব আন্জাম দেয়। সুঁই রূপান্তরিত হয় কুড়োলে। সোভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া হয়, প্রশিক্ষিত তালেবান যোদ্ধাদের। পেছেেন সর্বাত্মক সহযোগিতা যোগায় আইএসআই আর সিআইএ। চোরাগোপ্তা হামলা, পাল্টা হামলা চলার সময় পতন হয় সোভিয়েত ইউনিয়নের। এরপর রাশিয়া হাত গুটিয়ে নিলে তালেবান রাজ কায়েম হয় ১৯৯৬ সালে। সাথে লেজুড় হয়ে জুটে যায় বিন লাদেনের আল কায়েদাসহ বহু জাতিগত ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠী।
সাবেক তালেবান জমানায় ইসলামি খেলাফতের খোলসে মধ্যযুগের অন্ধকারে ফিরে যায় দেশটি। পাকিস্তান, সৌদি আরবসহ তিন দেশ তাদের স্বীকৃতি দেয়। এবার সৌদি আরব একদম বিপরীত মেরুতে। পাকিস্তান চীনা সহযোগিতাসহ স্বীকৃতি আদায়ের চেষ্টায় থাকলেও নিজে স্বীকৃতি দেয়নি। এরমাঝে বাজছে তাদের উল্টোসূর। বাস্তবে তালেবানদের উল্টো দৌড়ে নতুন বছরে বিশ্বজুড়ে কালোমেঘ জমছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নয়। বড় ধরনের মানবিক সহায়তা কর্মসূচি শুরু না হলে আফগানিস্তান দ্রুত মৃত্যুপুরিতে পরিণত হবে, আশঙ্কা বিশ্ব খাদ্য সংস্থাসহ জাতিসংঘের। পাশাপাশি দেশটির যুদ্ধবাজ কট্টর ধর্মান্ধ উগ্র গোষ্ঠীগুলো নানা দেশে নানা আবরণে মাইগ্রেট করতে পারে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ ধর্মীয় ও উগ্রবাদী জঙ্গি দমনে বৈশ্বিক রোল মডেল হিসেবে বিরল স্বীকৃতি পেয়েছে। স্বীকৃতি ধরে রাখতে আমাদের সর্বোচ্চ প্রস্তুত থাকতে হবেই।
লেখক : সাংবাদিক, সাহিত্যিক
তালেবান স্বার্থ সুরক্ষায় সম্প্রতি ওআইসি’র বিশেষ সাধারণ সভাও ডাকে পাকিস্তান। দুর্যোগ মোকাবেলায় বড় তহবিল গড়া এবং স্বীকৃতি আদায়ের বাধা অপসারণে ডাকা সভাটি সৌদি বিরোধীতার মুখে ব্যর্থ হয়ে গেছে। সৌদি আরব স্পষ্ট জানিয়ে দেয়, আই এস জঙ্গি নির্মূল এবং তালেবান সরকার আধুনিক সভ্যতায় না ফিরে উগ্র জঙ্গিবাদ চর্চা করলে এ’অঞ্চলে আবারও সন্ত্রাসবাদ ডানা মেলবে। এতে পুরো মধ্যপ্রাচ্য, আরব জাহানসহ বিশ্বে নতুন করে সন্ত্রাসবাদের বিস্তার ঘটাবে। আদতে ইমরানের পাকিস্তান খেলেছিল, তালেবানদের প্রতি ওআইসি’র সহানুভূতি আদায়ের নামে মধ্যপ্রাচ্যে নিজের অবস্থান শীর্ষে তুলে আনার খেলা। এতে ভারতের বিরুদ্ধেও জোরালো ফ্রন্ট তৈরি হতো। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বহুদেশ ভারতের ঘনিষ্ট বন্ধু। কিন্তু চালটি কেঁচে গেছে। তালেবানের ঘনিষ্ঠ মিত্র হলেও সীমান্ত সংঘর্ষ ও টিটিপি অনুপ্রবেশে উদ্বিগ্ন পাকিস্তান।