ঢাকার সদরঘাট থেকে বরগুনার উদ্দেশ্যে রওনা দেয়া অভিযান-১০ নামের লঞ্চটির যাত্রীরা জানিয়েছেন, লঞ্চটি বরিশাল ঘাট ধরে বরগুনা যাওয়ার পথে রাত দু’টার দিকে আগুন ধরে যায়। এ সময় আর্তনাদ, হৈ-চৈ আর চিৎকারে অবর্ণনীয় এক পরিবেশ তৈরি হয় নদীতে থাকা লঞ্চটিতে এবং আগুন থেকে প্রাণ বাঁচাতে নারী, পুরুষ ও শিশুরা নদীতে ঝাঁপ দিতে থাকেন যাদের অনেকে এখনো নিখোঁজ আছেন। এক পর্যায়ে ঝালকাঠির দিয়াকূল গ্রামে তীরে লঞ্চটি ভেড়ানো হলেও দ্রুত নামতে গিয়ে আটকে পড়া যাত্রীদের অনেকে আহত হন। কেউ কেউ শিশু সন্তান হারিয়ে এখনো খুঁজে পাননি। একজন যাত্রী বলছেন, যখন মাঝরাতে আগুন ছড়িয়ে পড়ে তখন একদিকে আগুন আর অন্যদিকে পানি – এ ছাড়া আর তো কোনো উপায় ছিলো না। খবর বিবিসি বাংলার।
যাত্রীরা কয়েকজন জানিয়েছেন, ঢাকা থেকে ছেড়ে যাওয়ার পর থেকেই ইঞ্জিনের দিক থেকে মাঝে মধ্যেই জোরে শব্দ হচ্ছিলো আর প্রচণ্ড কালো ধোঁয়া দেখা যাচ্ছিলো। আমরা অনেকেই বুঝতে পারছিলাম যে কোনো একটা ঝামেলা হচ্ছে। লঞ্চের ফ্লোরগুলোও গরম হয়ে উঠছিলো। স্টাফরা বলছিলো সমস্যা হবে না, কথাগুলো বলছিলেন লঞ্চের তিন তলার একটি কেবিনে থাকা যাত্রী জহিরুল। জহিরুল আগুন লাগার পর নদীতে লাফ দেন এবং প্রায় এক ঘণ্টা ভাসার পর তীরে আসতে সক্ষম হন। আগুনে তার দুই পা পুড়ে গেছে। হাসপাতাল থেকে ফোনে বিবিসির সাথে কথা বলেছেন তিনি।
তার দেয়া তথ্য অনুযায়ী, সদরঘাট থেকে ছেড়ে যাওয়ার পর এক ইঞ্জিনে চলছিলো লঞ্চটি। পরে চাঁদপুর ছাড়ার পর দ্বিতীয় ইঞ্জিনটি চালু করা হয়।
অন্য কয়েকজন যাত্রী বলেন, হঠাৎই প্রচণ্ড শব্দ শোনা যায় এবং রাত দু’টার পর থেকে রাত তিনটার মধ্যে সম্পূর্ণ লঞ্চটিতে আগুন ধরে যায়। এক পর্যায়ে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে গেলেও গতির কারণে লঞ্চটি রানিং ছিলো বেশ কিছুটা সময়। এ সময়ে বাতাসে আগুন আরও ছড়িয়ে পড়ে। তাছাড়া যাত্রীবাহী সব লঞ্চের মতো এটিতেও যাত্রীদের প্রচুর পরিমাণ কাপড় আর ভেতরে ফ্লোরে কার্পেটের মতো থাকায় দ্রুতই আগুন ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে।
তিন তলা লঞ্চটির নীচতলা পেছনের অংশে ছিলো ইঞ্জিন রুম। এরপর থেকে সামনের অংশ পর্যন্ত কিছু মালামাল আর অনেক যাত্রী ছিলো, যারা মূলত কার্পেটের ওপর কাপড় বিছিয়ে নিজেদের ঘুমানোর জায়গা করে নিয়েছিলেন। নিজেদের কাপড়ের ব্যাগ থেকে শুরু করে লাগেজ বা বস্তা ছিলো অনেক যাত্রীর সাথে। কিন্তু ঠিক কতো যাত্রী ছিলো তার কোন তথ্য কারও কাছে নেই। লঞ্চটিতে আগাম টিকেট কাটার ব্যবস্থা ছিল না। দোতলার সামনের অংশে কেবিন আর বাকী অংশের পুরোটাই খোলা জায়গা যা ডেক হিসেবে পরিচিত। সেখানে অনেক পরিবারে নারী ও শিশু থাকায় কাপড় দিয়ে নিজেদের থাকার জায়গা ঘিরে দিয়েছিল। আবার নীচতলা ও দোতলার ডেকের অংশে লঞ্চটির দু’পাশে পর্দা হিসেবে ত্রিপল দেয়া ছিলো। স্টিলের মূল কাঠামো ছাড়া আর সব পুড়ে গেছে। আমেনা আক্তার নামে এক শিক্ষার্থী তার বাবা মায়ের সঙ্গে দোতলায় ছিলেন। ‘মনে হয় আজানের আগে হঠাৎ বাবা ঘুম থেকে ডেকে তুললো। বাবা-মাসহ তিন তলার ছাদে উঠে গেলাম। দেখি আগুন নেভে না। একপর্যায়ে একেবারে কাছে চলে আসলো আগুন। তখন আমি লাফ দিলাম। পরে বাবাকে পেলেও মাকে এখনো পাইনি,’ বিবিসি বাংলাকে বলেন তিনি। মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ নামে আরেকজন যাত্রী বলেন, মধ্যরাতে ২/৩ টা শব্দ শুনতে পান তারা।
এরপর নীচে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে দেখেন আগুন, আবার উপরে রওনা দিয়ে দেখেন সেখানেও আগুন দেখা যাচ্ছে। চারদিকে কাপড় লাগানো। ‘এক পর্যায়ে কাপড় বেয়ে নীচে নেমে লঞ্চের সামনের দিকে চলে যাই। দেখি যাত্রীতে ভরপুর। তার উল্টো দিকে দেখি তীর দেখা যায়। সব খুলে প্যান্ট পড়ে ঝাঁপ দেই পানিতে। দু’মিনিট পরে নদীর পাড় পেয়ে যাই।’ নদীতে অনেক নারী পুরুষকে সাঁতরানোর চেষ্টা করতে দেখেছেন তিনি। তীরে পৌঁছার পর নিজের জামা দিয়ে আরেকটা মেয়েকে সহায়তা করেছেন এই যাত্রী।
আমেনা আক্তার বলছেন, ঘুম ভেঙ্গেই তিনি সবদিক থেকে চিৎকার আর আর্তনাদ শুনতে পাচ্ছিলেন।
এরপর তিন তলার ছাদ থেকে যখন লাফ দেন তখন বাবা মায়ের দিকে তাকাবার মতো হুঁশ তার ছিলো না। ‘কখন যে সবাইকে ছেড়ে লাফ দিলাম বুঝতেই পারিনি।’ তবে নীচতলা ও দোতলার ডেকের যাত্রীরা আগুন আগে টের পেলেও কেবিনের যাত্রীরা টের পেয়েছেন পরে।
মূলত হৈ-চৈ শুনে তাদের অনেকের ঘুম ভাঙে। অনেকে ধোঁয়ায় দমবন্ধ অবস্থায় পড়েন কেবিনের মধ্যে। তিনতলার একটি কেবিনে ছিলেন জহিরুল এবং শব্দ শুনে দরজা খুলে আগুন দেখে হতভম্ব হয়ে যান তিনি। চারদিক থেকে চিৎকারের শব্দ আসছিলো। পরে নদীতে লাফ দেন এবং এক ঘণ্টা পর তীরে আসতে সক্ষম হন। এসব যাত্রীরা বর্তমানে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছেন।