ভূঁইয়া ইকবালকে জানি অনেক কাল ধরেই। শিক্ষাজীবনে আমার এক বছরের জ্যেষ্ঠ ছিলেন। তবে জানতাম তো তাঁকে দূর থেকেই। দেশের প্রথম নিয়মিত বিজ্ঞান মাসিক বিজ্ঞান সাময়িকীর সাথে তাঁর সংযোগ ছিল ছাত্রাবস্থা থেকেই। পদার্থ বিজ্ঞানী – তখনও বিজ্ঞানের ছাত্র – মুহাম্মদ ইব্রাহীমই শুরু করেছিলেন এটি, সম্পাদক ও মূল চালিকাশক্তিও ছিলেন তিনিই। কলেবর ক্ষুদ্র হলেও তরুণদের মধ্যে এর কদর ছিল এবং তা উত্তরোত্তর বেড়েছে। বিজ্ঞান সাময়িকী এবং ইব্রাহীমভাইয়ের বিজ্ঞান জনপ্রিয়করণের কার্যক্রম বিজ্ঞান গণশিক্ষা কেন্দ্র এখনও চলমান রয়েছে। ভূঁইয়া ইকবাল এই যোগাযোগের সূত্রে নোবেলজয়ী ইউনুসভাই ও ইব্রাহীমভাইদের পরিবারের সবার সঙ্গেই ঘনিষ্ঠভাবে পরিচিত ছিলেন।
ইকবালের প্রথম যে গুণ বা বৈশিষ্ট্য নজর কাড়ে তা হল তাঁর গুণিজনের সংযোগ সাধনের ক্ষমতা – একজনের সূত্রে সেই বৃত্তের প্রায় সকলের সাথেই সম্পর্ক গড়ে তোলার সামর্থ্য ছিল বিস্ময়কর। পরবর্তীকালে তাঁর স্ত্রী, আমাদের ঘনিষ্ঠজন, টুকু অর্থাৎ লায়লা জামানও এ দক্ষতার পরিচয় দিয়েছে, বলা যায় এ দম্পতির ঢাকা-কলকাতা এবং দুই বাংলার বিভিন্ন উচ্চ বিদ্যায়তনের বুধমণ্ডলী এবং কবি-সাহিত্যিকমহলে পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা বরাবর ঈর্ষণীয়। আর দুজনেই অর্জিত এ সম্পর্ককে নিষ্ক্রিয় থাকতে দেন নি কখনও, সক্রিয় রেখেছেন আজীবন এবং নিজেদের গবেষণা ও গবেষণাধর্মী লেখার কাজেও খাটিয়েছেন।
প্রথম জীবনে ইকবাল পূর্বলেখ নামে মূলত কবিতা-নির্ভর একটি পত্রিকা প্রকাশ ও সম্পাদনা করেছেন। তখন তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার ছাত্র আর সেই গত শতকের ষাটের দশক ছিল কবিদের রাজত্বের কাল। স্বভাবতই তাঁর পত্রিকায়ও কবিতা প্রাধান্য পেয়েছে, কবিদের রাজত্বও কায়েম ছিল। তবে এই সুবাদে বাংলাদেশের কাব্যজগতের ভরা জোয়ারের কালে ইকবালের ঘনিষ্ঠতা হয় প্রতিষ্ঠিত ও উদীয়মান সব কবিদের সাথে। এরপরে ইউনুসভাই-ইব্রাহীমভাইদের অকালপ্রয়াত কনিষ্ঠ ভ্রাতা সফল সাংবাদিক ও গণমাধ্যমের সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব মুহাম্মদ জাহাঙ্গীরের সাথে মিলে বক্তব্য নামে একটি প্রবন্ধ পত্রিকা প্রকাশনায়ও যুক্ত ছিলেন। ঐ সময়ে মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ওপর একটি উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ সংকলন সম্পাদনা করেছিলেন ইকবাল। শেষের পত্রিকা ও সংকলনে আমার লেখাও নিয়েছিলেন। তখন দৈনিক সংবাদের সাহিত্য সাময়িকীতে আমার কয়েকটিমাত্র প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। বুঝলাম এই সম্পাদকের চোখ-কান খোলা এবং আমিও সম্ভবত তাঁর পছন্দের তালিকায় স্থান পেয়েছি।
জানতাম ভূঁইয়া ইকবাল বরাবরই ড. আনিসুজ্জামানের ঘনিষ্ঠজন। ১৯৬৯ সালে আনিস স্যার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেওয়ার প্রায় পরপরই ইকবাল এখানে বাংলা বিভাগে প্রথমে গবেষণা সহকারী ও পরে লেকচারার পদে যোগ দেন। এখানেই বিভাগীয় ছাত্রী ও আনিস স্যারের ঘনিষ্ঠ পরিবারের কন্যা টুকুর সাথে তাঁর পরিচয় ও বিবাহ। কিছুকাল পরে এই দম্পতি পিএইচডি ডিগ্রির জন্যে কলকাতায় যান এবং ইকবালের স্বভাবগুণে এবং তাঁর সহধর্মিনী হিসেবে যথার্থ ভূমিকা নিয়ে টুকুও বন্ধুবৃত্ত বৃদ্ধির ধর্ম রক্ষা করেছিল সমান পারদর্শিতায়।
তবে এখানে একটি কথা বলা দরকার। ইকবাল অল্প বয়সে বিজ্ঞান পত্রিকার সাথে যুক্ত ছিলেন, কবিতাপ্রধান সাময়িকপত্র প্রকাশ করেছেন এবং তাঁর অন্যান্য প্রকাশনার স্রোতের টানে নিজে ভেসে যান নি। বিজ্ঞান নিয়ে লেখেন নি, কবিতা ছাপানোর চেষ্টা করেন নি (যদি লিখেও থাকেন), এমনকি অনেককাল পর্যন্ত প্রবন্ধও ছাপান নি। তিনি লেখক বা বুদ্ধিজীবী হিসেবে কাঁচা কাজ করেন নি, নিজের এক্তিয়ার সম্পর্কে সচেতন থেকেছেন এবং নিজেকে যখন প্রস্তুত ভেবেছেন তখনই লিখতে ও বই প্রকাশ করতে শুরু করেছিলেন।
ইকবালের সাথে আমার জানাশোনার ঘনিষ্ঠতা লেখার সূত্রেই। সঠিকভাবে বললে আমার কলাম বা প্রবন্ধ পড়ে তিনি প্রায়ই তাঁর মতামত জানাতেন, লোভ সম্বরণ না করে বলি, তা প্রায়ই একতরফা প্রশংসাতেই ভরা থাকত। ঘনিষ্ঠতা আরেকটু প্রত্যক্ষ হয় যখন দৈনিক সুপ্রভাত বাংলাদেশ পত্রিকার সাহিত্যপাতা সম্পাদনার দায়িত্ব তিনি গ্রহণ করেন। কথাটা তাঁকে ভেঙে বলার আগে সংশয় ছিল যার যোগাযোগ শামসুর রাহমান, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরীর মত বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রের প্রথমসারির ব্যক্তিদের সাথে, যিনি অনায়াসে কলকাতার প্রাজ্ঞ বুদ্ধিজীবীদের সাথে যোগাযোগ করতে পারেন, লেখা আনাতে পারেন তিনি কি আমাদের অখ্যাত আঞ্চলিক কাগজের জন্যে কাজ করবেন? দেখলাম তিনি আগ্রহ নিয়েই রাজি হলেন এবং যথেষ্ট সময় দিয়ে রীতিমত পরিশ্রম করে তাঁর সব যোগাযোগ কাজে লাগিয়ে সাহিত্য সাময়িকীটি প্রকাশ করেছেন। কয়েক বছর ধরে তিনি কাজটা করেছেন, সুপ্রভাত কর্তৃপক্ষ সময় মতো প্রতিশ্রুত সম্মানী দিতে না পারলেও, আমার কাছে মাঝে মধ্যে একটু তদ্বির করা ব্যতীত তিনি কিন্তু কাজে কোনো অবহেলা করেন নি। ব্যক্তিগত প্রাপ্তির প্রতিশ্রুতি পূরণ না হলেও ইকবাল তাঁর সাময়িকীর মান কিছুতেই পড়তে দেন নি। দেশের মানুষ দেখল না, চট্টগ্রামেরও সামান্য মানুষই জানল, কী দারুণ যত্নে-পরিশ্রমে উপেক্ষিত ছোট্ট এক কাগজে প্রতি সপ্তাহে প্রকাশিত হয়েছে দেশের মুদ্রণ গণমাধ্যমের সেরা সাহিত্য সাময়িকী – এটা সত্যিই আফসোসের বিষয়।
তাঁর নিজের ছিল নানান পত্রপত্রিকা-সাময়িকীর বিপুল সম্ভার, আর লেখকদের সাথে যোগাযোগ তো ছিলই। আগেই বলেছি এই যোগাযোগ দেশের সীমা মানে নি। বাংলাভাষার সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের তাঁর সম্পাদিত পাতায় হাজির করার সাধ ও সাহস যেমন ছিল তেমনি সাধ্যও তাঁর ছিল। খ্যাতিমান এবং নতুন লেখকরা এখানে লিখেছেন। তাঁর মাধ্যমে দেশেরই অনেক নতুন বা প্রান্তিক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক-লেখকদের সম্পর্কে জেনেছি, তাঁদের লেখা সুপ্রভাতের পাতাতেই পড়েছি।
আকৈশোর যিনি পত্রিকা প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তিনি যেমন প্রকাশনার বিবর্তনের সাক্ষী হয়েছেন ভিতর থেকেই তেমনি এর পূর্ণ সদ্ব্যবহারের বুদ্ধিও তাঁর সমান তালে বেড়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে দৈনিক পাকিস্তানে (১৬ ডিসেম্বর ’৭১ এ বিজয়ের পরদিন থেকে দৈনিক বাংলা) সংবাদদাতার কাজ করলেও নিজের ব্যক্তিগত আগ্রহেই কবি-সাহিত্যিকদের সাথে পরিচয়ের পরিধি কেবল বাড়িয়ে নিয়েছেন। দৈনিক পাকিস্তান আইয়ুব সরকারের কাগজ হলেও এতে যুক্ত হয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের সাহিত্যজগতের প্রবীণ ও তরুণ অনেক কবি-লেখক। সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দীন এবং সাহিত্য সম্পাদক আহসান হাবীব ছিলেন বিভাগপূর্ব কালের লেখক। সহকারী সম্পাদক শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আহমদ হুমায়ুন, মহিলা পাতার দায়িত্বে মাফরুহা চৌধুরী, ফিচার বিভাগের প্রধান ফজল শাহাবুদ্দিন, ছোটদের পাতার সম্পাদক আফলাতুন, এমনকি বার্তা বিভাগেও হেদায়েত হোসেন মোর্শেদসহ অনেকেই ছিলেন নতুন কোনো বিষয়ে চমৎকার গদ্য লেখার দক্ষতার অধিকারী। পত্রিকাটি ঘিরে লেখক-শিল্পী-বুদ্ধিজীবীদের আনাগোনাও হত বিস্তর। ভূঁইয়া ইকবাল তরুণ বয়সেই বিশ্ববিদ্যালয় এবং দৈনিক বাংলা এই দুই ক্ষেত্র পেলেন লেখক-বুদ্ধিজীবীদের সাথে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য। তিনি এর সদ্ব্যবহার করেছেন এবং সাধারণত এসব সম্পর্ক আজীবন রক্ষাও করেছেন এবং প্রয়োজনে, বৃহত্তর প্রয়োজনে, কাজে লাগাতেও সক্ষম হয়েছেন। এটা তাঁর ব্যক্তিত্বের প্রসাদ গুণ এবং ব্যক্তিগত দক্ষতা বলা যায়।
নানা বিষয়ে ইকবালের নিজস্ব মতামত অবশ্যই থাকত, তা অনেক সময় যথেষ্ট জোরালোও হত, কিন্তু তা সত্ত্বেও ব্যক্তিগত সম্পর্ককে তিনি যত্নে লালনও করতেন। তাঁর মধ্যে একটা স্বভাব-বিনয় ছিল, এটা এতটাই যে তিনি নিজের লেখালেখি শুরু করেছেন দেরিতে এবং মৌলিক চিন্তা, তত্ত্বীয় বিষয় ও বিতর্ক কিংবা সৃজনশীল রচনার ঝুঁকি তিনি বিশেষ নেন নি। ক্ষেত্র হিসেবে বেছে নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ এবং অন্যান্যদের আড়ালে থাকা কাজ এবং স্বল্পালোকিত লেখক ও লেখা কিংবা যা প্রায় অচল পুরাতন চিন্তার প্রকাশ ভেবে গবেষণা বা সাহিত্যের মূলধারায় জায়গা পায় নি সেসব বিষয় ও ক্ষেত্র। মননচর্চার পুরাতন ভাণ্ডার ও নিদর্শন খুঁজে তিনি বিদগ্ধমহলে তা উপহার দিয়েছেন। ইকবাল যত্ন নিয়ে সেগুলো খোঁজ করেছেন, এ ধরনের কাজে পরিশ্রমের তুলনায় গবেষকদের জন্যে প্রতিদান মেলে কম- আমি বলছি মনন বা বুদ্ধিবৃত্তিক খোরাকের বিবেচনায়। কিন্তু ইকবাল এ কাজে লেগে থাকলেন এবং সাহিত্যের গবেষণায় একটা নতুন ক্ষেত্র তৈরি করেছেন, নিজেরও একটা পরিচয় ও অবস্থান তৈরি করতে পেরেছেন।
বড় বড় মানুষদের সাহচর্য পেয়ে, তাঁদের স্নেহের পাত্র হয়ে এবং নিজের কাজ করার তীব্র অভিপ্রায় সত্ত্বেও ইকবাল নিজের সাহিত্যসাধনার একটা গণ্ডি টেনে নিয়েছিলেন। এই গণ্ডির ভিতরে থেকেই নিজের কাজ করেছেন, অযথা উচ্চাভিলাষে ভোগেন নি। হয়ত সে কারণে তাঁকে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবীদের ক্রনিক আফশোস-ব্যাধিতে ভুগতে দেখি নি। নিজের কাজে ক্ষান্তি দেন নি, আর অন্যের ভালো লেখার প্রশংসা করতে কার্পণ্য করেন নি। তাঁর মত ধীমান সহৃদয় পাঠকের প্রয়াণ যে কোনো কালের সাহিত্য এবং সমাজের জন্যে এক বিরাট ক্ষতি। একালে সবাই যেন আপনাকে নিয়েই ব্যস্ত। কিন্তু অন্যের দিকে ঠিক মনোযোগ রেখেও যে নিজের কাজ করা যায়, অন্যের ভালো কাজের অকুণ্ঠ প্রশংসা করেও যে নিজের ভালো কাজ করা যায় তার দৃষ্টান্ত ড. ভূঁইয়া ইকবাল। নিশ্চিতভাবেই তাঁর অভাব একটা মহলে অনুভূত হবেই, তাঁকে হারানোর ক্ষত এঁদের সহজে শুকাবে না এবং ক্ষতি সহজে পূরণ হবে না।