বাংলাদেশ সবেমাত্র উন্নয়নশীল দেশে পদার্পণ করতে যাচ্ছে। অথচ বিশ্বে এমন অনেক দেশ আছে যে দেশগুলো বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধ্বে উন্নত দেশে উন্নীত হয়েছে। আজ প্রায় একশত বৎসর পর ঐ দেশগুলো আরো সুপার উন্নত দেশে পরিণত হয়েছে। এসব দেশের জনগণের জীবনযাত্রা, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ, শিক্ষা, চিকিৎসা, গবেষণা অবশ্যই উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশগুলোর তুলনায় বহু অংশে অগ্রগামী। উন্নত দেশের জনগণের জীবনযাত্রা অনেকাংশে যন্ত্র নির্ভর। আর অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের জীবনযাত্রা অনেকাংশে জনশক্তি নির্ভর। এর ফলে নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য উৎপাদনে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশে সময় ও শ্রম লাগে অধিক। অথচ উন্নত দেশে আধুনিক প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে সমপরিমাণ পণ্য উৎপাদনে সময় লাগে কম। তাছাড়া উৎপাদন খরচও কম হয়। কারণ নির্দিষ্ট পরিমাণ পণ্য যদি কম সময়ে উৎপাদন করা যায় তবে ঐসব পণ্যের একক প্রতি উৎপাদন খরচ কমে আসে। তাছাড়া উন্নত ও অনুন্নত দেশের মধ্যে শিক্ষা, গবেষণা, প্রযুক্তি ইত্যাদির মধ্যেও বিশাল ব্যবধান রয়েছে। অপরপক্ষে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার মধ্যে অধিকাংশ জনসংখ্যার বসবাস হচ্ছে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশে। অথচ রোগ ব্যাধি অথবা অন্য কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যখন পৃথিবীতে হানা দেয় তখন এসব প্রাকৃতিক দুর্যোগ কখনো ধনী বা দরিদ্র দেশ বিবেচনা করে না, সব দেশে একইভাবে হানা দেয়। এতে বিশ্বের ধনী দেশের তুলনায় দরিদ্র দেশসমূহে বিপর্যয় দেখা দেয় বেশি। তাছাড়া বিশ্বের ধনী দেশগুলোর মধ্যে বিপর্যয় কাটিয়ে উঠার শক্তি সামর্থ, অর্থ, প্রযুক্তি ও গবেষণা পর্যাপ্ত থাকার কারণে সেই সব দেশ দ্রুত বিপর্যয় কাটিয়ে উঠে। কিন্তু দরিদ্র দেশগুলোর পক্ষে এ বিপর্যয় কাটিয়ে উঠার শক্তি, সামর্থ, গবেষণা নেই বললেই চলে। এ কারণে বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলো বিপর্যয় কাটিয়ে উঠার ব্যাপারে অনেকাংশে ধনী দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল। এমন একটি বিপর্যয় দেখা দিয়েছে বিশ্বে ২০১৯ সালের ডিসেম্বরে। এ বিপর্যয়ের নাম করোনা ভাইরাস বা কোভিড-১৯। চীনের একটি প্রদেশ থেকে ছড়িয়ে পড়া এ ভাইরাসটি সমগ্র বিশ্বকে করে দিয়েছে কাবু। প্রাকৃতিক কারণে হোক বা অন্য কোন কারণে হোক আমেরিকা ও ইউরোপে এ ভাইরাস ধাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ইতিমধ্যে সমগ্র বিশ্ব থেকে প্রায় ২০ লক্ষ লোকের প্রাণ হরণ করেছে এ ভাইরাস। অবস্থাদৃষ্টে দেখা যাচ্ছে নাছাড়বান্দা এ ভাইরাস আরো অনেক মানুষের প্রাণ কেড়ে নেবে। কিন্তু মানবজাতিও বসে নেই। এ ভাইরাসকে মোকাবেলা করার জন্য বিভিন্ন দেশের বিজ্ঞানীরা দিনরাত গবেষণা করে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে অনেক দেশ এ ভাইরাসের টিকা আবিষ্কার করে সফলভাবে মানবজাতির শরীরে প্রয়োগ করেছে। এ সফলতার ধারাবাহিকতায় রয়েছে সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, চীন, যুক্তরাজ্য, জার্মানি ইত্যাদি রাষ্ট্র। মানবজাতির মঙ্গলের জন্য এসব দেশের বিজ্ঞানীদের অক্লান্ত পরিশ্রমের কথা মানবজাতির ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে। কিন্তু এসব দেশের রাষ্ট্রনায়কদের চিন্তা ভাবনা বা তাঁদের সিদ্ধান্ত মানবজাতির ইতিহাসকে কলঙ্কিত করার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রতিটি দেশ টিকা আবিষ্কারের পূর্বেই বিভিন্ন উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের সাথে কোটি কোটি ডলারের চুক্তি করে বসে আছে। ইহার অর্থ হলো যে, বিশ্বের অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশগুলো যথাসময়ে টিকা পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তাছাড়া ইতিমধ্যে শুরু হয়েছে টিকা কূটনীতি। যে দেশের সাথে যে অনুন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের সম্পর্ক ভালো, সেই উন্নত দেশ ঐ অনুন্নত দেশগুলোকে আগে টিকা দেবে। এ সুযোগে অনুন্নত দেশগুলোর ওপর আধিপত্য বিস্তার করা শুরু করে দিয়েছে।
চীনে উদ্ভাবিত করোনা ভাইরাসের টিকা দ্রুত পেয়ে যাবে ফিলিপাইন। লাতিন আমেরিকা আর ক্যারিবীয় অঞ্চলের দেশগুলো টিকা কিনতে চীন থেকে ঋণ পাবে ১০০ কোটি মার্কিন ডলারেরও বেশি। আর বাংলাদেশ পাবে চীনা কোম্পানির উদ্ভাবিত টিকার এক লক্ষ ডোজ বিনামূল্যে। ভারতের টিকা বাংলাদেশ পাবে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে। চীন ও ভারত কর্তৃক এরই মধ্যে এসব প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়ে গেছে। যদিও চীনে ও ভারতে করোনার নিরাপদ ও কার্যকর টিকার ব্যাপক উৎপাদন শুরু করতে আরো সময় লাগতে পারে। মূলত সম্পর্ক ঠিক করতে আর বন্ধু রাষ্ট্রগুলোকে আরো কাছে টানতে দেশগুলো করোনার টিকা উদ্ভাবনের বিষয়টি ব্যবহার করার চেষ্টা করছে। বিশেষত, চীন যে দেশগুলোকে নিজের স্বার্থের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মনে করছে, তাদেরই কাছে টানার চেষ্টা করছে টিকা কূটনীতি দিয়ে। বেইজিংয়ের ব্যাপারে দীর্ঘদিন ধরেই সতর্ক অবস্থানে রয়েছে ইন্দোনেশিয়া। ২০২০ সালের ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে চীনের প্রেসিডেন্ট সি.চিন পিং ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট কোকো উইদোদোকে টেলিফোন করে আশ্বস্ত করেন যে, চীন ইন্দোনেশিয়ার উদ্বেগের বিষয়গুলো তিনি গুরুত্বের সাথে নিয়েছেন। পরবর্তীতে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলে যে, করোনার বিরুদ্ধে এ লড়াইয়ে চীন ও ইন্দোনেশিয়া ঐক্য অব্যাহত থাকবে। এখানে উল্লেখ করা মতো বিষয় যে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র বৈশ্বিক নেতৃত্ব থেকে নিজকে গুটিয়ে নিচ্ছে, ঠিক তখনই চীনের টিকা সরবরাহের প্রতিশ্রুতি আসছে। বিশ্বজুড়ে দু্রততম সময়ের মধ্যে মাস্ক ও ভেন্টিলেটর সরবরাহের উদ্যোগ চীনকে বিশ্ব মঞ্চে এক দায়িত্ববান দেশ হিসেবে উপস্থাপন করেছে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রেও চীনের টিকা কূটনীতি উল্লেখ করার মতো। চীনে উদ্ভাবিত করোনার দুইটি সম্ভাব্য টিকার পরীক্ষা চলছে পাকিস্তানে। এ দেশটির জাতীয় স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের একজন কর্মকর্তা মন্তব্য করেছেন যে, “পাকিস্তানের জনগণ চীনের টিকা নিতে অত্যন্ত আগ্রহী।”
যুক্তরাষ্ট্রে উদ্ভাবিত তিনটি টিকার মধ্যে ফাইজার এবং মডার্নার টিকা মানুষের স্বাস্থ্যে প্রয়োগ শুরু হয়েছে।
যুক্তরাজ্যের অঙফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ও ব্রিটিশ-সুইডিশ ওষুধ প্রস্তুতকারী কোম্পানি অ্যাস্ট্রাজেনেকা করোনার টিকা উদ্ভাবনে মার্কিন সরকারের তহবিল পেয়েছিল। এ টিকা দ্রুত আবিষ্কার হয়েছে। ফিলিপাইনে প্রভাব বিস্তার নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নীরব লড়াই চলছে চীনের। কিছুদিন পূর্বে ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট তাঁর দেশের আইনপ্রণেতাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, তিনি চীনের প্রেসিডেন্টের নিকট টিকা সহায়তা চেয়েছেন। তাছাড়া দক্ষিণ চীন সাগরে চীনের দাবির বিরুদ্ধে তিনি কিছু বলবেন না। এর একদিন পরই চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র বলেছেন যে, চীন, ফিলিপাইনকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে টিকা সরবরাহ করবে।
যে সব অঞ্চলে চীনের প্রভাব বিস্তারের আগ্রহ রয়েছে যেমন- আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকা, ক্যারিবীয় অঞ্চল, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া ইত্যাদি সেখানেই চীন টিকা সরবরাহের প্রস্তাব দিয়েছে। ২০২০ সালের জুন মাসে আফ্রিকার দেশগুলোর নেতাদের সাথে এক বৈঠক করে চীন। ঐ বৈঠকে চীনের প্রেসিডেন্ট বলেন, আমরা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, চীনে কোভিড-১৯-এর টিকা উদ্ভাবন ও সরবরাহ সম্পন্ন হওয়ামাত্র আফ্রিকার দেশগুলো টিকার সুবিধাভোগী হওয়া দেশগুলোর মত প্রথম সারিতে থাকবে। অবশ্য চীন বলেছে যে, টিকা সরবরাহের ক্ষেত্রে চীন একক আধিপত্য বিস্তার করতে চায় না। করোনার টিকাকে চীন কূটনীতির উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করছে বলে যে অভিযোগ উঠেছে তা চীন প্রত্যাখ্যান করেছে।
বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রও টিকা কূটনীতিতে জড়িত। তবে এর মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি ইত্যাদি দেশগুলো করোনার আঘাতে জর্জরিত হওয়ায় এসব দেশ টিকার যথাযথ প্রয়োগ নিয়ে ব্যস্ত নিজ দেশে। তাই টিকা কূটনীতি নিয়ে মনোযোগ তুলনামূলক কম। ইতিমধ্যে চীন করোনার আক্রমণ কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছে। তাই চীন বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোর টিকা প্রাপ্তির ব্যাপারে কূটনীতির আশ্রয় নিয়েছে। এটা মানবজাতির জন্য সুখবর নয়।
লেখক : পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ