তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে যখন ভাষার জন্য আন্দোলন চলছে তখন পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদপত্রগুলো রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে দেশদ্রোহী আচরণ প্রমাণ করতে উঠে-পড়ে লেগেছে। ৬ ফেব্রুয়ারি করাচির ‘ডন’ পত্রিকায় ‘প্রাদেশিকতা’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে পাকিস্তানের সব থেকে বড়ো শত্রুরূপে প্রাদেশিকতাকে আখ্যায়িত করে লেখা হয়, ‘বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্ররা যে আন্দোলন করছেন তা আন্দোলনের নামে রাষ্ট্রদ্রোহিতা। ভাষা প্রশ্নকে, যুবকদের কাছে যার একটা আবেগময় আবেদন আছে, কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রামে একটি খুব শক্তিশালী হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। যেসব মানুষ কায়েদে আজমের জীবদ্দশায় কোনোদিন মাথা তোলার সাহস করেনি তাদেরকেই প্ররোচিত করা হচ্ছে জাতির পিতার উপদেশ অগ্রাহ্য করতে’।…‘যারা প্রত্যক্ষ অথবা পরোক্ষভাবে প্রাদেশিকতার ওকালতি করে তাদেরকে রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে ঘোষণা করা এবং কোনো প্রকার প্রশ্রয় না দেওয়া উচিত।’ এই সম্পাদকীয়র প্রতিবাদ জানানো হয়। ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মিলিত হয়ে এর প্রতিবাদ করেন। ছাত্রদের ঐ সভায় এই বিবৃতির তীব্র নিন্দা করে প্রস্তাব গৃহীত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা একবাক্যে ঘোষণা করেন যে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনের সঙ্গে রাষ্ট্রদ্রোহিতার বা প্রাদেশিকতার কোনো সংশ্রব নেই। ‘ডন’ ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য পত্রিকাও পূর্ববাংলার ভাষা আন্দোলনকে প্রাদেশিকতা বলে উল্লেখ করেন। ৬ ফেব্রুয়ারি পাঞ্জাব প্রদেশ থেকে নির্বাচিত সংবিধান সভার সদস্য চৌধুরী নাজির আহমেদ খান ভাষা প্রশ্নে নাজিমুদ্দীনের একটি উক্তির প্রতিবাদ করে সংবাদপত্র বিবৃতির মাধ্যমে বলেন, ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে সে বিষয়ে সংবিধান সভাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। উর্দু যে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষারূপে প্রত্যেক সরকারি মুখপাত্র এবং দায়িত্বশীল নেতার দ্বারা পাকিস্তানের প্রথম থেকেই স্বীকৃত হয়েছে সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না।’ এই সময় পূর্ববাংলা সরকার কর্তৃক ‘পাকিস্তান অবজারভার’ এর প্রকাশনা নিষিদ্ধ করার ঘোষণা দেয়। অভিযোগ ছিল, রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও শান্তি-বিরোধী এবং রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপ ও রাষ্ট্রবহির্ভূত আনুগত্য। ১২ ফেব্রুয়ারি এই ইংরেজি দৈনিকে ‘ছদ্ম ফ্যাসিজম’ শীর্ষক সম্পাদকীয় নিবন্ধে খাজা নাজিমুদ্দিনের সমালোচনা করা হয়।
সংবাদপত্র বন্ধের সরকারি আদেশ জারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই ব্যবস্থার বিরুদ্ধে চারদিকে অসন্তোষ ও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সভা করে তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা করেন। বক্তারা বলেন, ভাষা আন্দোলনকে ব্যাহত করার জন্যই আন্দোলনের সমর্থক একমাত্র দৈনিক পত্রিকাকে বন্ধ করে দেওয়া হলো।