হাজার বছরের চট্টগ্রাম। অসংখ্য জনগোষ্ঠীর ঠিকানা মিলেছে এ চট্টগ্রামে। সাগর, নদী, জল এবং পাহাড়ী জনপদ প্রকৃতির লীলায় সমৃদ্ধ। এই অঞ্চল চিৎ তা গং , চাটিগাঁ থেকে চট্টলা। মহাত্মা গান্ধী তো চট্টগ্রামের তেজোদীপ্ত অগ্রগামী মানসিকতায় বলেছিলেন, চিটাগাং টু দ্য ফোর। অগ্রগামী চট্টগ্রাম। সে অগ্রগামী মন মানসিকতা যে চট্টগ্রামে ছিল এবং আছে সে প্রমাণ তো ইতিহাসের পাতায় সমুজ্জ্বল। সংক্ষেপে বলা যেতে পারে এভাবে — ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে হাবিলদার রজব আলীর বিদ্রোহ, ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে মাস্টারদা সূর্যসেনের চট্টগ্রামের যুব বিদ্রোহ, ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে নূর আহমেদ চেয়ারম্যানের বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষার আন্দোলন, ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনে একুশের প্রথম কবিতা কবি মাহবুবুল আলম রচিত চট্টগ্রামেই, ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গবন্ধুর আনুষ্ঠানিক ৬ দফা ঘোষণা চট্টগ্রাম থেকেই, শেখ মুজিবকে বঙ্গবন্ধু শব্দটি দিয়ে সম্মাননার জনক চট্টগ্রামের ছেলে রেজাউল হক চৌধুরী মুশতাক। চট্টগ্রামে জেলা ছাত্রলীগ প্রথম প্রস্তাব সমর্থন করে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ এবং এরপর এম. এ আজিজ এর নেতৃত্বে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ এ প্রস্তাব সমর্থন করে। এই চট্টগ্রামের ছেলে স্বপন কুমার চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের মেধাবী ছাত্র ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচার সম্পাদক ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভায় স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ৭০ এর নির্বাচনের পর এম. এ আজিজ বুঝতে পারেন, পাকিস্তানীরা বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা দেবে না। তাই তিনি ১দফার স্লোগান তুলেন চট্টগ্রাম থেকেই। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র। বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা পাঠ করেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামীলীগের বিপ্লবী সাধারণ সম্পাদক এম. এ হান্নান এবং চট্টগ্রাম থেকেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। আজকের মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলার সূচনা ও ধারণা চট্টগ্রাম থেকেই এসেছে। ফলে চট্টগ্রামে অগ্রগামী এ কথা কি নতুন করে বলার অপেক্ষা রাখে!যেহেতু ইতিহাসের পরিক্রমায় চট্টগ্রাম অগ্রগামী মুক্তিযুদ্ধের প্রকাশনায় চট্টগ্রাম দেশের অন্যান্য জেলা থেকে এগিয়ে ছিল। চট্টগ্রামের প্রকৃতি ও মানস সম্পদ মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে শহর থেকে প্রকাশিত হয়েছিল “আগুন”। এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের বুলেটিন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধা জানে আলম প্রকাশ করেছিলেন “গেরিলার আত্মকাহিনী”। এটি স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রকাশিত গ্রন্থ ।এরপর থেকে ক্রমান্বয়ে মুক্তিযুদ্ধকে কেন্দ্র করে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে গবেষণা শুরু হয় হাজার ১৯৮৬ থেকে।
এই প্রবন্ধে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রবন্ধ, গবেষণা, স্মৃতিচারণ ও সাক্ষাৎকার প্রভৃতি আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে। ছড়া, কবিতা, উপন্যাস ও নাটকসহ সৃজনশীল অনেক সাহিত্য মুক্তিযুদ্ধের সত্য ঘটনার উপর রচিত হয়েছে। এই প্রবন্ধে সেইসব লেখকের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করছি। এই প্রবন্ধটিতে চট্টগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযোদ্ধা সন্তান, লেখক এবং গবেষক যাঁদের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক লেখায় সাহিত্যাঙ্গন সমৃদ্ধ হয়ে প্রকৃত ইতিহাস প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে পৌঁছে দিয়েছেন তাঁদের সৃষ্টিকে আলোপাত করা হয়েছে। চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধের প্রকাশনা নিয়ে কিছুটা আলোচনার চেষ্টা করা হয়েছে মাত্র। যা পরবর্তীতে আরও বৃহৎ ও সম্পূর্ণাকারে প্রকাশ করার ইচ্ছা পোষণ করছি। যেসব তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করেছি তা এই প্রবন্ধে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। চট্টগ্রাম থেকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রকাশিত প্রবন্ধ, গবেষণা ও স্মৃতিচারণমূলক বই সমূহের নাম উল্লেখ করা হলো :
মাহবুবউল আলমের ‘মুক্তিযুদ্ধ’ ‘ইতিহাসের দালাল’ ‘স্বাধীনতার কাছে স্মারকলিপি’, জানে আলমের ‘গেরিলার আত্মকথা’
আবুল ফজল ‘দুর্দিনের দিনলিপি’, বেগম মুশতারী শফীর মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের নারী,স্বাধীনতা আমার রক্ত ঝরা দিন; ডাঃ মাহফুজুর রহমানের ‘বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ’, স্বাধীনতার ঘোষণা ধানমন্ডি থেকে বাংলাদেশ,
বাঙালি জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, শওকত হাফিজ খান রুশ্নির ‘সাহসী ঠিকানা একাত্তর’
সাথী দাশ ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম মহানগরী’ নাসিরুদ্দিন চৌধুরীর ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম (সম্পাদিত) , মুহাম্মদ শামসুল হকের চোখে দেখা ৭১, স্বাধীনতার সশস্ত্র প্রস্তুতি আগরতলা মামলা, স্বাধীনতার বিপ্লবী অধ্যায় বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য (৪৭-৭১), স্বাধীনতা-সশস্ত্র প্রস্তুতিও বঙ্গবন্ধু আগরতলা মামলার অপ্রকাশিত জবানবন্দি, ৪৪ প্রত্যক্ষদর্শীর চোখে দেখা -৭২(২য় পর্ব), একাত্তরের শোকগাথা, সাখাওয়াত হোসেন মজনুর ‘নির্যাতন ৭১’ রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে শহর চট্টগ্রামের বধ্যভূমি ও নির্যাতন কেন্দ্র, মুক্তিযুদ্ধে আমার কৈশোর, শহীদ মধ্যম নাথপাড়া ও আব্দুল পাড়া বধ্যভূমি, আবু সাঈদ সরদারের অপারেশন জ্যাকপট, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম, আহসানুল করিম লিটনের মুক্তিযুদ্ধের আশ্রয়স্থল, ডা.
মোঃ রেজাউল করিমের বাংলাদেশের রাজনীতি মুক্তিযুদ্ধ ও অসামপ্রদায়িক চেতনা, নেছার আহমদের ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও সমকালীন বাংলাদেশ’, ‘মুক্তিযুদ্ধের অগ্রনায়কেরা’, জামাল উদ্দিনের মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম শহর, আনোয়ারা:একাত্তরের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম, বাংলা আমার মা :-বাঙালি বাংলার স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধ, রমা চৌধুরীরএকাত্তরের জননী (প্রথম খন্ড), শরীফা বুলবুলের বীরাঙ্গনা নয় মুক্তিযোদ্ধা, সিরু বাঙালির ‘বাঙাল কেন যুদ্ধে গেল’, রশিদ এনামেরএকাত্তরের শহীদ ছবুর, এমদাদুল ইসলাম চৌধুরীর স্মৃতিতে ভাষা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ, শামসুল আলম সাঈদের ‘মুক্তিযুদ্ধের মুখ চট্টগ্রাম’, রুনু সিদ্দিকীরএকাত্তরে স্মৃতি, করিম আবদুল্লাহর চট্টগ্রাম শহরে গেরিলা যুদ্ধ, দেলোয়ার হোসেনের পাকিস্তান সামরিক অপারেশন সার্চলাইট বাঙালি পুলিশের হামলা, আহমেদ আমিন চৌধুরীর ইতিহাসের আলোকে মুক্তিযুদ্ধ ও রাউজান, মোহাম্মদ মাহবুব আলমের বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে মাইজভান্ডার দরবার শরীফ, শাহজাহান চৌধুরীর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণ, মহীউদ্দীন শাহ আলম নিপুর ৬৯ এর গণ আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ ৭১ (স্মৃতিচারণ ), পধঢ়ঃ. গধহুড়ড়ৎ ছঁফবৎ ‘ঘঙ গঅঘ’ঝ খঅঘউ’, শৈবাল চৌধূরীর মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র প্রসঙ্গ বাংলাদেশ, আহসান উল্লাহ চৌধুরীর স্বাধীনতা সংগ্রাম ও সহযোদ্ধা স্মৃতি, শিরীণ আখতারের যুদ্ধজীবন, নাজনীন বেগমের ‘একাত্তর ও আমার মুক্তিযুদ্ধ’, আবুল হাসেমের ‘যুদ্ধে যুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ’, বিশ্বজিৎ চৌধুরীর ‘মুক্তিযুদ্ধ যুদ্ধাপরাধ ও অন্যান্য’, দিলীপ কুমার মিত্র ‘একাত্তরের সেই দুঃস্বপ্নের দিনগুলি’, প্রিয়শ্রী সেনগুপ্তার ‘ফিরে দেখা ৭১’, ডাক্তার সুলতানুল আলম চৌধুরীর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র (সম্পাদিত), শামসুল আলমের মুক্তিযুদ্ধে আনোয়ারা, শাকিল আহমেদের ‘বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের একুশ ও একাত্তর’, এবি সিদ্দিক চৌধুরীর মুক্তিযুদ্ধের সন্দ্বীপ, আহমেদ আমিন চৌধুরীর ইতিহাসের আলোকে মুক্তিযুদ্ধ ও রাউজান, জামশেদ উদ্দিনের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস সীতাকুন্ড অঞ্চল, গাজী সালেহ উদ্দিনের ‘মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম প্রামাণ্য দলিল’, সৌরভ শাখাওয়াতের ‘আমাদের বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ’।
এ প্রবন্ধে চট্টগ্রামের মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বইয়ের নাম তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। কোনো বইয়ের নাম অনিচ্ছাকৃতভাবে বাদ গেলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত। মুক্তিযুদ্ধের সমৃদ্ধ প্রকাশনার মাধ্যমে বীর প্রসবিনী চট্টগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাই প্রতিফলিত হয়েছে।
লেখক: প্রাবন্ধিক