বৈজ্ঞানিক মানসচিন্তা ও বঙ্গবন্ধু

ড. শিরীণ আখতার | বুধবার , ১৬ ডিসেম্বর, ২০২০ at ৯:২৪ পূর্বাহ্ণ

বঙ্গবন্ধুর দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের মূল লক্ষ্য শোষণমুক্তি হলেও মুক্ত বাঙালি জাতিকে বিশ্বের দরবারে কিভাবে গৌরবের আসনে অধিষ্ঠিত করবেন তার কর্মপরিকল্পনা তিনি কিন্তু রাজনৈতিক জীবনের শুরু থেকেই অন্তরে লালন করেছিলেন। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে মুসলিম লীগের মোকাবেলা করার জন্য বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির একটি যুক্তফ্রন্ট গঠন করার সিদ্ধান্ত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ১৯৫৩ সালের ১৪ই নভেম্বর অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক কাউন্সিল অধিবেশনে গৃহীত হয়। এই যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনী ইশতেহার লেখার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন শেখ মুজিবুর রহমান। একুশ দফা নির্বাচনী ইশতেহারের অন্যতম তিনটি দফা হল :
১। পূর্ববঙ্গকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে শিল্পায়িত করিয়া ও কৃষিকে আধুনিক যুগোপযোগী করিয়া শিল্প ও খাদ্যে দেশকে স্বাবলম্বী করা হইবে এবং আন্তর্জাতিক শ্রমসংঘের মূলনীতি অনুসারে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক ও সামাজিক এবং সকল প্রকার অধিকার প্রতিষ্ঠিত করা হইবে।
২। শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করিয়া শিক্ষাকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে কার্যকরী করিয়া কেবলমাত্র মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থা করা হইবে এবং সরকারি ও বেসরকারি বিদ্যালয়সমূহের বর্তমান ভেদাভেদ উঠাইয়া দিয়া একই পর্যায়ভূক্ত করিয়া সকল বিদ্যালয় সমূহকে সরকারি সাহায্য পুষ্ট-শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা হইবে এবং শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা করা হইবে।
৩। ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় আইন প্রভৃতি প্রতিক্রিয়াশীল কানুন বাতিল ও রহিত করিয়া বিশ্ববিদ্যালয় সমূহকে স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে পরিণত করিয়া উচ্চশিক্ষাকে সস্তা ও সহজলভ্য করা হইবে এবং ছাত্রাবাসের অল্প ব্যয়সাধ্য ও সুবিধাজনক বন্দোবস্ত করা হইবে।
অর্থাৎ তিনি ভবিষ্যৎ জাতিকে কিভাবে গড়ে তুলবেন, জাতির কৃষি, শিল্প, শিক্ষা কোন নীতির ভিত্তিতে পরিচালিত হবে তার যে রূপরেখা জনগণের সামনে হাজির করেছেন তার মধ্যে দিয়ে আমরা বঙ্গবন্ধুর বৈজ্ঞানিক চিন্তার রাষ্ট্রদর্শন খুঁজে পাই। শামসুজ্জামান খান ‘‘ স্বাধীনতা বিপ্লবী অধ্যায় বঙ্গবন্ধু ও অন্যান্য ’ গ্রন্থে বলেছেন, ‘‘ ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতার ছক বিন্যাসের প্রায় সামগ্রিক রূপরেখা প্রস্তুত করে ফেলেন। এ ব্যাপারে তাঁর সময়জ্ঞান ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং সাহস ছিলো অতুলনীয়। ১৯৬১ সালে তিনি ছাত্রলীগ সদস্যদের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য গ্রীন সিগন্যাল দেন। এর প্রথম প্রকাশ ঘটে ১৯৬২ সালে ছাত্রলীগের উদ্যোগে ‘‘ স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান” শীর্ষক লিফলেট প্রকাশে। সামরিক শাসকদের নাকের ডগায় বসে এটা ছিলো প্রাথমিকভাবে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার প্রতিক্রিয়া দেখার এক আকস্মিক কৌশল। এরপর এই কার্যক্রমকে আরো অর্থবহ ও সংহতভাবে সামনে এগিয়ে নেয়ার জন্য তিনি ১৯৬২ সালে ছাত্রলীগের তৎকালীন নেতা সিরাজুল আলম খান, আবদুর রাজ্জাক, কাজী আরেফ আহমেদ ও শেখ ফজলুল হক মনি সমন্বয়ে গঠন করেন ‘‘স্বাধীনতার নিউক্লিয়াস”। এই নামটির মধ্যেই আমরা আবিষ্কার করতে পারি বঙ্গবন্ধুর মানসগঠনে বিজ্ঞান চিন্তা কিভাবে কাজ করেছে।
১৯৭০ সালের নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয়ের পর ১৯৭১ খ্রিষ্ট্রাব্দের ৩রা জানুয়ারি তারিখে আওয়ামী লীগ শপথ দিবস উদ্‌যাপন করে। ঐ দিন রমনা রেসকোর্স মাঠে এক ঐতিহাসিক জনসভায় আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যগণ শপথ গ্রহণ করেন। সভায় আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকার আদলে নির্মিত মঞ্চের উপরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সকল সদস্যকে শপথ নামা পাঠ করান। ঐতিহাসিক সেই শপথের একটি অংশে দেশে ভবিষ্যৎ বিজ্ঞান ভিত্তিক সমাজ গঠনের কথা উল্লেখিত হয়েছে-‘‘ আওয়ামী লীগের নীতি, আদর্শ, উদ্দেশ্য ও কর্মসূচীর প্রতি অবিচল আনুগত্য জ্ঞাপন পূর্বক আমরা অঙ্গীকার করছি যে, অঞ্চলে অঞ্চলে ও মানুষে মানুষে বিরাজমান চরম রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের চির অবসান ঘটিয়ে শোষণ মুক্ত ও বিজ্ঞানমনস্ক এক সুখী সমাজের বুনিয়াদ গড়ার এবং অন্যান্য অবিচার বিদূরিত করে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাবো।”
১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সেই শপথ পূর্ণ বাস্তবায়নের কাজ শুরু করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। প্রথমেই প্রজাতন্ত্রের জন্য রচনা করেন সংবিধান। রাষ্ট্র পরিচালনা সংক্রান্ত এ দলিলেই আমরা বঙ্গবন্ধুর দেশ গঠনে প্রগতিশীল চিন্তার ছাপ ও দর্শন প্রতিফলিত হতে দেখি। বঙ্গবন্ধু দেশ গঠনে উচ্চ শিক্ষাকে গুরুত্ব দেন। কারিগরী শিক্ষার প্রতিও সমভাবে গুরুত্ব দেন তিনি। ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই দেশসেরা বিজ্ঞানী ড. কুদরত-ই-কুদাকে দিয়ে শিক্ষা কমিশন গঠন করেন বঙ্গবন্ধু। ড. কুদরত-ই-কুদা একটি বিজ্ঞানবান্ধব যুগোপযোগী শিক্ষানীতির রিপোর্ট দেন যেখানে প্রচলিত পড়াশোনার মধ্যেও বিজ্ঞান শিক্ষার উপর জোর দেয়া হয়। ১৯৭৩ সালে রূপপুর পরমানু বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য ‘বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন’ গঠন করেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুর এই স্বপ্নদর্শনকে বাস্তবায়ন করে চলেছেন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বাংলাদেশে রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ এখন দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে।
বিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের আবির্ভাব ঘটে মূলত ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে। ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেটের আবিষ্কারে এ বিপ্লবের গতি, প্রভাব ও ক্ষমতা আরো বেড়ে যায়। বঙ্গবন্ধু এটা গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। এ ক্ষেত্রে তাঁর দুটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগের কথা স্মরণ করা যেতে পারে। একটি হচ্ছে ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন (আইটিইউ)সদস্য পদ লাভের জন্য জোর প্রচেষ্টা চালানো এবং অন্যটি হচ্ছে বেতবুনিয়ায় স্যাটেলাইট আর্থ-স্টেশন স্থাপন। তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের প্রধান চালিকা শক্তি, ডিজিটাল প্রযুক্তি। বঙ্গবন্ধু সদ্য স্বাধীন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে পুনগর্ঠনের জন্য এবং একটি আত্মমর্যাদাশীল উন্নত, আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক ও সমৃদ্ধশালী দেশে পরিণত করার লক্ষ্যেই তিনি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার ও স্যাটেলাইট আর্থ-স্টেশন স্থাপনের উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। ১৯৭২ সালে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণের পর কোনরূপ কালবিলম্ব না করে আইটিইউর সদস্যপদ লাভের জোর প্রচেষ্টা চালান। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপন ও বিশ্বব্যাপী তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সম্প্রসারণে জাতিসংঘের এ সংস্থাটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। স্যাটেলাইট অরবিট বা ফ্রিকোয়েন্সি বরাদ্দসংক্রান্ত আন্তর্জাতিক বিধিমালা তৈরী ও এবং এর বরাদ্দে সহযোগিতা প্রদান ও সমন্বয়ের কাজ করে আইটিইউ । বঙ্গবন্ধুর এ উদ্যোগের ধারাবাহিকতায় ১৯৭৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ আইটিইউর সদস্য পদ লাভ করে। এর প্রায় ২১ মাস পর ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বঙ্গবন্ধু বেতবুনিয়ার স্যাটেলাইট আর্থ-স্টেশন (ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্র) স্থাপন করেন। আইটিইউর সদস্যপদ লাভ ও স্যাটেলাইট আর্থ-স্টেশন স্থাপন কোনো সাধারণ দুটি ঘটনা নয়। এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও মহাকাশে স্যাটেলাইট উৎক্ষেপনের ভিত্তি রচিত হয়। সর্বোপরি ডিজিটাল বিপ্লবে শামিল হওয়ার পথ সুগম হয়।
পঁচাত্তর পরবর্তী সময়ে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির সহায়তায় রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল এরশাদের সামরিক এবং খালেদা জিয়ার সরকার বঙ্গবন্ধুর চিন্তাপ্রসূত উদ্যোগ গুলো এগিয়ে না নিয়ে বরং উল্টো পথে প্রতিক্রিয়াশীল ধারায় দেশকে পরিচালিত করে। এমনকি ১৯৯২ সালে খালেদা জিয়ার সরকার বিনা অর্থ ব্যয়ে আন্তর্জাতিক সাবমেরিন কেবলে বা সাউথ ইষ্ট এশিয়া। মিডল ইস্ট-ওয়েস্ট এশিয়া (সিসিইউই) যুক্ত হওয়ার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করে। সেই সাবমেরিন কেবল লাইনে আমরা যুক্ত হই ২০০৬ সালে। বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথেই ঠিক ৪৩ বছর পর ২০১৮ সালের ১২ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ মহাকাশে উৎক্ষেপণ করে। এর মধ্য দিয়ে বিশ্বের ১৯৮টি দেশের মধ্যে ৫৭ তম দেশ হিসেবে বাংলাদেশ স্যাটেলাইট এলিট ক্লাবের সদস্য হয়। স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ বাংলাদেশের জন্য শুধু গৌরবের নয়, এটি মহাকাশ গবেষণা, স্পেস অর্থনীতি ও ডিজিটাল অর্থনীতি গড়ে তোলার পথকে মসৃন করেছে।
বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে ডিজিটাল বিপ্লবে শামিল হওয়ার পথ দেখিয়েছেন। তাঁর দূরদর্শিতা ও চিন্তাশক্তির প্রখরতা দেখে এটা নিশ্চিতই বলা যায় তিনি জীবিত থাকলে অনেক আগেই ডিজিটাল বিপ্লবের সুফল ঘরে তুলে বাংলাদেশকে তাঁর স্বপ্নের বাংলায় পরিণত করতেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর দেখানো পথে হেঁটেই ভিশন ২০৪১ এর ঘোষণা দিয়ে তার বাস্তবায়ন করছেন। শতবর্ষ ব্যাপী ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ এরও ঘোষণা দিয়েছেন তিনি। তাঁকে সহায়তা করছেন তাঁরই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইটি বিশেষজ্ঞ সজীব ওয়াজেদ জয়। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের অগ্রগতিতে শেখ হাসিনা এখন প্রচন্ড আত্মবিশ্বাসী। শিক্ষিত তরুণদের মাঝে বিরাজমান বেকারত্বের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করার জন্য দক্ষতা উন্নয়ন এবং ডিজিটাল উদ্যোক্তা তৈরীর দিকে মনোযোগ দিচ্ছে বর্তমান সরকার। দেশ এখন বিনিয়োগের অন্যতম গন্তব্য। হাইটেক পার্ক তৈরী করা হচ্ছে, নির্মিত হচ্ছে অত্যাধুনিক ল্যাব। যেখানে বিনিয়োগে বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও আকৃষ্ট হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু জন্ম দেন বাংলাদেশে কৃষিবিষয়ক সব সংস্থার সমন্বয়কারী প্রতিষ্ঠান ‘বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল। গবেষণার পরিসর বৃদ্ধি করে বঙ্গবন্ধু বলেছেন, ‘খাদ্য বলতে শুধু ধান, চাল, আটা, ময়দা আর ভুট্টাকে বোঝায় না; বরং মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, শাকসবজি এসবকে বোঝায়।’ এর মাধ্যমে তিনি গবেষকদের কৃষির উন্নয়নে সুষম ও সমন্বিত খাদ্য গবেষণার নতুন ধারণা তৈরী করে দিয়েছেন। কৃষি গবেষণার মাধ্যমে খাদ্যে স্বনির্ভরতা অর্জনে তিনি বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশন, উদ্যান উন্নয়ন বোর্ড, তুলা উন্নয়ন বোর্ড, বীজ প্রত্যয়ন এজেন্সি, ইক্ষু গবেষণা প্রতিষ্ঠান, মৎস্য উন্নয়ন কর্পোরেশনসহ অনেক নতুন প্রতিষ্ঠান সৃষ্টি করেন। বঙ্গবন্ধুর রাষ্ট্রনায়োকচিত দার্শনিক চিন্তার ফল এসব প্রতিষ্ঠান।
দেশে ধান গবেষণার গুরুত্ব অনুধাবন করেই বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে আইন পাসের মাধ্যমে ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠা করেন এবং তখন থেকে ধানের উপর নিয়মিত গবেষণা শুরু হয়। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৭৫ সালে বিনাশাইল, ইরাটম ২৪ এবং ইরাটম ৩৮সহ নতুন নতুন জাতের ধান উদ্ভাবিত হয়। ১৯৭৪ সালে গমের তিনটি উচ্চফলনশীল জাতের গম উদ্ভাবনে বিজ্ঞানীরা সফল হন। এর মধ্যে সোনালিকা জাতটি এদেশে গমের ঘাটতি পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। বঙ্গবন্ধুর সময়ে তিনটি উন্নতজাতের তুলা উদ্ভাবিত হয়। এভাবে বঙ্গবন্ধু নানা পরিকল্পনার মাধ্যমে নতুন নতুন জাতের খাদ্যশস্য উদ্ভাবনের যে প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন তা গবেষকদের সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু পাটের সম্ভাবনার কথা ভেবেছেন, তা ছিল নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তি থেকে উত্থিত গবেষণা ভাবনা। অর্থাৎ পাটের ফাইবার ব্যবহার করে কম্পোজিট ম্যাটেরিয়ালসহ নানা গবেষণালব্ধ উপাদানের সৃষ্টি পৃথিবীর প্রযুক্তির অগ্রযাত্রায় একটি মাইল ফলক। যার ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার পাটের জিনোম আবিষ্কারে সক্ষম হয়েছেন। বঙ্গবন্ধু গবেষণার ক্ষেত্রে দেশীয় কাঁচামাল ব্যবহারের উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। এর মাধ্যমে তিনি রপ্তানীমুখী শিল্পধারণা সৃষ্টি করেছেন।
১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে জাতির জনক উল্লেখ করেছিলেন, ‘‘ অনাহার, দারিদ্র, বেকারত্ব ও বুভুক্ষার তাড়নায় জর্জরিত, পারমাণবিক যুদ্ধের দ্বারা সম্পূর্ণ ধ্বংস হওয়ার শঙ্কায় শিহরিত বিভীষিকাময় জগতের দিকে আমরা এগুবোনা, আমরা তাকাবো এমন এক পৃথিবীর দিকে যেখানে বিজ্ঞান ও কারিগরি জ্ঞানের বিস্ময়কর অগ্রগতির যুগে মানুষের সৃষ্টিক্ষমতা ও বিরাট সাফল্য আমাদের জন্য এক শঙ্কামুক্ত উন্নত ভবিষ্যৎ গঠনে সক্ষম। এই ভবিষ্যৎ হবে পারমাণবিক যুদ্ধের আশঙ্কা থেকে মুক্ত। বিশ্বের সকল সম্পদ ও কারিগরি জ্ঞানের সুষ্ঠু বন্টনের দ্বারা এমন কল্যাণের দ্বার খুলে দেওয়া যাবে যেখানে প্রত্যেক মানুষ সুখী ও সম্মানজনক জীবনের ন্যূনতম নিশ্চয়তা লাভ করবে।” বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য তনয়া মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নসারথী হয়ে উক্ত বক্তব্যের প্রতিটি শব্দ সফল রূপদানের জন্য নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। যার ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশ এখন বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল।
লেখক : শিক্ষাবিদ; উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ, বাঙালির মুক্তির সংগ্রাম ও স্বাধীনতার ৪৯ বছর
পরবর্তী নিবন্ধবঙ্গবন্ধু ও ১৬ ডিসেম্বর উন্নয়ন যুদ্ধের ঘোষণা