কক্সবাজারের রামুর বৌদ্ধ বিহার ও বসতিতে সামপ্রদায়িক হামলার আট বছর পূর্ণ হল আজ। কিন্তু এত বছর পেরিয়ে গেলেও এ সংক্রান্ত ১৮টি মামলার মধ্যে একটিরও বিচার কাজ শেষ হয়নি। উপযুক্ত স্বাক্ষীর অভাবে বিচার কাজ শেষ করা যাচ্ছে না। তাই মামলাগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছে বৌদ্ধ সমপ্রদায়। অন্যদিকে বিচার আদৌ পাবে কিনা তা নিয়েও সন্দেহ আছে তাদের।
উল্লেখ্য উত্তম বড়ুয়া নামের এক বৌদ্ধ যুবকের ফেসবুকে পবিত্র কোরান শরীফ অবমাননার অভিযোগ এনে ২০১২ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর রাতে রামুর ১২টি বৌদ্ধ বিহার, ২৬টি বসতঘরে অগ্নিসংযোগ ও হামলা চালায় দুর্বৃত্তরা। এ সময় আরো ছয়টি বৌদ্ধ বিহার এবং শতাধিক বসতঘরে হামলা, লুটপাট ও ভাঙচুর চালানো হয়। পরদিন (৩০ সেপ্টেম্বর) বিকেলে উখিয়া ও টেকনাফে আরো চারটি বৌদ্ধ বিহারে হামলা চালানো হয়। এতে পুড়ে যায় এসব বিহারে থাকা প্রত্নতাত্ত্বিক সব নিদর্শন। এসব ঘটনায় রামু, উখিয়া ও টেকনাফে ১৯টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে রামু থানায় ৮টি, উখিয়ায় ৭টি, টেকনাফে দুইটি ও কঙবাজার সদর থানায় দুইটি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ১৫ হাজার ১৮২ জনকে অভিযুক্ত করা হয়। এর মধ্যে এজাহারভুক্ত আসামি ছিল ৩৭৫ জন। পরবর্তীতে এসব মামলায় ৯৯৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। এর মধ্যে রামুর ৮টি মামলায় অভিযুক্ত করা হয়েছিলো ৪৫৮ জনকে।
কঙবাজার জেলা জজ আদালতের কোর্ট পরিদর্শক চন্দন কুমার চক্রবর্তী (মোরশেদ পারভেজ তালুকদার) জানান, ১৯টি মামলার মধ্যে রামু থানায় জনৈক সুধাংশু বড়ূয়ার করা মামলাটি দু‘পক্ষের আপোস মীমাংসার ভিত্তিতে খারিজ করে দেন আদালত। বাকি ১৮টি মামলা বর্তমানে বিচারাধীন রয়েছে। কিন্তু বর্তমানে মামলাগুলোর স্বাক্ষী পাওয়া যাচ্ছে না। যে কারণে বিচার কার্যক্রম দীর্ঘায়িত হচ্ছে।
কঙবাজার জেলা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর (পিপি) অ্যাডভোকেট ফরিদুল আলম বলেন, মামলার স্বাক্ষীদের আনার জন্য ওয়ারেন্ট জারি করা হয়েছে। তবে করোনা মহামারীর কারণে মামলাগুলোর কার্যক্রম আপাতত বন্ধ রয়েছে। পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক হলে আবার কার্যক্রম শুরু করা হবে।
অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মূলত সাক্ষীর অভাবে মামলাগুলোর ভবিষ্যত অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। এসব মামলায় স্বাক্ষী বেশিরভাগই বৌদ্ধ সমপ্রদায়ের হওয়ায় তারা ভয়ে কেউ স্বাক্ষ্য দিতে আসছেন না।
তবে পিবিআইএর এক কর্মকর্তা বলেন, তদন্ত কার্যক্রম শেষে এমনভাবে মামলাগুলোর অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে স্বাক্ষী পাওয়া না গেলেও আসামিদের ঘটনার সঙ্গে সম্পৃক্ততা রয়েছে এরকম বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও ফুটেজ রয়েছে। এসব দেখে সনাক্ত করে অভিযোগপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। আদালত চাইলে এদের শাস্তি দিতে পারে।
রামু কেন্দ্রীয় সীমা বিহার পরিচালনা কমিটির সাধারণ সম্পাদক রাজু বড়ুয়া জানান, এসব মামলা নিয়ে বরাবরই বৌদ্ধ সমপ্রদায়ের মাঝে সংশয় ছিলো। কারণ সব মামলার বাদি পুলিশ। পুলিশ এজাহারে কাকে আসামি করেছে আবার কাকে অভিযোগ পত্রে এনেছে, কাকে বাদ দিয়েছে এ বিষয়ে বৌদ্ধ সমপ্রদায় কিছুই জানতো না। কিন্তু পরে দেখা গেছে, যারা মিছিলের সামনের সারিতে ছিল, যারা ভাঙচুর–অগ্নিসংযোগে নেতৃত্ব দিয়েছে এরা কেউই পুলিশের অভিযোগ পত্রে নেই। তিনি বলেন, প্রকৃত অপরাধীরা বাদ পড়ায় এবং বর্তমানে আসামিরা সবাই জামিনে থাকায় স্বাক্ষীরাও স্বাক্ষ্য দিতে রাজি হচ্ছেন না।
কঙবাজার জেলা বৌদ্ধ সুরক্ষা পরিষদের সভাপতি প্রজ্ঞানন্দ ভিক্ষু বলেন, ঘটনার আট বছর হয়ে গেছে। এই আট বছরে বৌদ্ধ সমপ্রদায়কে অনেক কিছু মোকাবিলা করতে হয়েছে। সেই ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের পর বৌদ্ধ সমপ্রদায়ের মনে যে ক্ষত সৃষ্ঠি হয়েছিল, সেই ক্ষতও অনেকটা মুছে গেছে। বর্তমানে পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক বলা যায়।
এদিকে রামু সহিংসতায় নিহতদের স্মরণে রামু কেন্দ্রীয় বৌদ্ধ যুব পরিষদ শ্রীকুল লাল চিং–মৈত্রী কমপ্লেঙ চত্ত্বরে দিনব্যাপী কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে সকাল ৮টায় জাতীয় ও ধর্মীয় পতাকা উত্তোলন, সকাল ১০টায় সংঘদান ও অষ্ট উপকরণ দান, ধর্মসভা, বেলা বারটায় অতিথি ভোজন, বিকাল ৫টায় হাজার প্রদীপ প্রজ্জ্বলন ও সন্ধ্যে সাতটায় বিশ্বশান্তি কামনায় সমবেত প্রার্থনা।