১৮ বন্যহাতির অবাধ বিচরণ

চাইল্যাতলী অভয়ারণ্য

চকরিয়া প্রতিনিধি | শনিবার , ১০ জুলাই, ২০২১ at ৬:৪৯ পূর্বাহ্ণ

কক্সবাজারের চকরিয়া ও বান্দরবানের লামা সীমান্তে এক পাল বন্য হাতির অবাধ বিচরণ লক্ষ করা গেছে। বন্য হাতির এই পালটি কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের চকরিয়ার ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জের কাকারা বনবিটের অধীন চাইল্যাতলী এলাকার চিরচেনা অভয়ারণ্যের মধ্যে খাদ্যের সংস্থানও পেয়ে গেছে।
স্থানীয়দের ভাষ্য, গত একযুগ ধরে এই সময়ে এখানে হাতির বিচরণ দেখা না গেলেও এখন নিয়মিতই দেখা মিলছে বন্য হাতির পালটিকে। চাইল্যাতলীর গহীন অরণ্যের মধ্যে পর্যাপ্ত খাবারের সন্ধান পেয়ে নতুন করে স্থানটি বন্য হাতির নিরাপদ আবাসে পরিণত হয়েছে। সরেজমিন এবং বনবিভাগের দেওয়া তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে চাইল্যাতলী এলাকায় দেখা যাওয়া পালটিতে বেশ কিছু শাবকসহ কমপক্ষে ১৮টি বন্য হাতি রয়েছে। এসব হাতি কয়েক ভাগ হয়ে আপন মহিমায় সেখানে বিচরণ করছে। বনবিভাগ এবং হাতি সচেতন লোকজন ধারণা করছেন, এতে দীর্ঘদিন ধরে সংঘটিত হয়ে আসা চকরিয়া ও লামার সীমান্তবর্তী ইউনিয়নগুলোতে মানুষ এবং বন্য হাতির দ্বন্দ্ব কমে আসতে পারে।
চকরিয়া পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি এম আর মাহমুদ দৈনিক আজাদীকে বলেন, গত এক যুগ ধরে প্রতিনিয়তই লোকালয়ে হানা দিয়ে আসছিল বন্য হাতির দলটি। মূলত পাহাড়ে বন্য হাতি, বন্য পশুর অভয়ারণ্য ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংস করা, গাছপালা উজাড়, পাহাড় সাবাড় ছাড়াও জনবসতি স্থাপনের পাশপাশি পরিবেশের বারোটা বাজিয়ে অবৈধ ইটভাটা স্থাপন করা হয়েছে। এসব কারণে পাহাড়ে চরম খাদ্য সংকট দেখা দেয় বন্য হাতির। এই পরিস্থিতিতে গত এক যুগ ধরে প্রতিনিয়ত খাবারের সন্ধানে এসে লোকালয়ে বহু মানুষকে প্রাণ দিতে হয়েছে তাদের রোষানলে পড়ে। প্রতিবছর শত শত একরের ধান ক্ষেত ও বনের ভেতর স্থাপিত অবৈধ বসতবাড়িও গুঁড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। তবে আগামীতে এই পরিস্থিতি দেখা নাও যেতে পারে।
ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জ কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্র জানায়, বান্দরবানের লামার সীমান্তবর্তী এলাকা চকরিয়ার কাকারা বনবিটের চাইল্যাতলী এলাকায় সংরক্ষিত বনের মধ্যে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৫০ হেক্টরজুড়ে বন্য হাতি ও বন্য পশু খাদ্যের বাগান সৃজন করা হয়। কলাগাছের পাশাপাশি সেখানে বন্য হাতির পাল ক্ষুধা নিবারণে খেতে পারছে আমলকি, বহেরা, হরিতকি, জাম, জলপাই, বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ, বিরল ও বিপন্ন প্রজাতির চারা গাছ। একইভাবে ২০২০-২১ অর্থবছরে আরও ২৩০ হেক্টর এলাকায় সৃজন করা হয়েছে এই বাগান।
সূত্র আরও জানায়, বন্য হাতি যাতে শুষ্ক মৌসুমে পানির সংকটে না পড়ে সেজন্য কাকারা বনবিটের চাইল্যাতলী এলাকায় তিনটি পরিখা (পুকুর) খনন করা হয়েছে। এছাড়াও খুটাখালীর মেদাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যান এলাকায়ও একটি পরিখা খনন করা হয়েছে। এসব পরিখায় কৃত্রিমভাবে যাতে বন্য হাতি লবণের চাহিদা মেটাতে পারে সেজন্য প্রতিমাসে প্রতিটি পরিখায় ১২ কেজি করে লবণ মিশিয়ে দেওয়া হচ্ছে পানিতে। এছাড়াও এসব পরিখায় নিয়মিতভাবে দেওয়া হচ্ছে আঁখের গুড়, হাঁড়ের গুড়, সোডিয়াম ক্লোরাইডসহ বিভিন্ন খাদ্য।
গত এক যুগ ধরে প্রতিনিয়ত হাতি-মানুষে দ্বন্দ্ব লেগে থাকা, জানমালের ক্ষতি হওয়াসহ নানাভাবে বন্য হাতি কর্তৃক ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হয়ে আসছিল চকরিয়ার সুরাজপুর-মানিকপুর ইউনিয়নের মানুষগুলো। স্থানীয় চেয়ারম্যান আজিমুল হক আজিম দৈনিক আজাদীকে বলেন, অতীতে এমনও সময় গেছে- খাবারের সন্ধানে এসে বন্য হাতি ঘরবাড়ি, ক্ষেতের ফসল নষ্ট করার পাশাপাশি প্রতিনিয়ত একাধিক মানুষকেও হত্যা করেছে। সর্বশেষ গেল শুষ্ক মৌসুমেও অনেক মানুষ মারা পড়েছে হাতির আক্রমণে। এই পরিস্থিতিতে বন্য হাতি ও মানুষের মধ্যে দীর্ঘবছর ধরে চলে আসা দ্বন্দ্বের কারণ শনাক্ত করে বন্য হাতির অভয়ারণ্য সৃষ্টি এবং তাদের খাদ্য উপযোগী বাগান সৃজন করাটা একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। তাই পাহাড়ের মধ্যে খাদ্যের সংস্থান হলেই বন্য হাতি আর লোকালয়ে আসবে না। বন্য হাতিসহ পশুখাদ্যের বাগান সৃজন করায় আগামীতে হাতি-মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসন হবে।
এ ব্যাপারে কঙবাজার উত্তর বনবিভাগের ফাঁসিয়াখালী রেঞ্জ কর্মকর্তা মো. মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘বনবিভাগ হাতি ও মানুষের দ্বন্ধ নিরসনকল্পে কাজ শুরু করেছে অনেক আগেই। কাকারা বনবিটের চাইল্যাতলীর বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যকে নতুন করে সাজানো হয়েছে। সেখানেই এখন অবাধ বিচরণ করছে বন্য হাতির পাল। যে পালে রয়েছে বেশকিছু বাচ্চাসহ ১৮টি বন্য হাতি। চাইল্যাতলীই নিরাপদ খাদ্যের সংস্থান এবং আবাস হিসেবে গড়ে উঠেছে এসব হাতির।
রেঞ্জ কর্মকর্তা মাজহারুল ইসলাম আরও বলেন, নতুন করে ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের ভেতর ১০০ হেক্টর এবং মেদাকচ্ছপিয়া জাতীয় উদ্যানের ২০ হেক্টর এলাকায় পশুখাদ্য উপযোগী বাগান গড়ে তোলা হচ্ছে। পর্যায়ক্রমে আরও অনেক এলাকায় একই ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। এতেই ধারণা করছি, আগামীতে বন্য হাতি ও মানুষের মধ্যে প্রকট দ্বন্দ্ব আর থাকবে না।
বন্য হাতি বিশেষজ্ঞ মাজহারুল ইসলাম জানান, বর্তমানে চকরিয়ার কাকারা বিটের চাইল্যাতলী অভয়ারণ্যে অবস্থান করা হাতির পালটি একদিকে ফাঁসিয়াখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য হয়ে চট্টগ্রামের চুনতি ও বাঁশখালী বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য এবং অপরদিকে বান্দরবানের লামা-নাইক্ষ্যংছড়ি হয়ে কঙবাজারের উখিয়া পর্যন্ত বিচরণ করে থাকে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসৌদি সরকারের নির্দেশনা মেনে চলার পরামর্শ প্রবাসীদের
পরবর্তী নিবন্ধ‘প্রধানমন্ত্রীর উপহারের বাড়ি নিয়ে অনিয়ম সহ্য করা হবে না’