হুয়াহিনের নীল আকাশ

রূপা দত্ত | শনিবার , ২০ নভেম্বর, ২০২১ at ৮:৫৯ পূর্বাহ্ণ

‘হুয়াহিন’ হল থাইল্যান্ডের উপসাগর ‘গলফ অফ থাইল্যান্ডে’র তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা ছোট্ট শহর। ১৯১১ সালে ব্যাংককের সাথে এর রেল যোগাযোগ স্থাপিত হওয়ার পর শহরের মানুষের হাওয়া বদলের জন্য আদর্শ জায়গা হয়ে উঠে। ১৯২১ সালে রেল কর্তৃপক্ষ প্রথম হোটেল নির্মাণ করে সমুদ্রের তীর ঘেঁষে। তারপর রাজ পরিবার সেখানে বেশ কয়েকটি প্রাসাদ নির্মাণ করলো। আর একে একে সম্ভ্রান্ত পরিবারের মানুষেরা অবসর যাপনের জন্য রিসোর্ট নির্মাণ শুরু করে দিল। এসময় হুয়াহিনের অন্য নাম হয়ে গেল ‘বীচ রিসোর্ট টাউন’, যেটি থাইল্যান্ডের প্রথম সমুদ্র তীরবর্তী রিসোর্ট টাউন। বলা হয়, এখানকার রেলস্টেশান হল থাইল্যান্ডের সবচেয়ে সুন্দর রেল স্টেশান। ব্যাংকক থেকে আড়াই ঘণ্টায় পৌঁছে যাওয়া যায় সাদা বালুর এ-সমুদ্র সৈকতে।
২০১৭ এর মার্চের মাঝামাঝি একদিন ঠিক মধ্য দুপুরে মাথার তালু ফাটা রোদের মধ্যে গিয়েছিলাম হুয়াহিন। সারাবছরই এখানে তালপাকা, তালুফাটা, কুকুর পাগল করা, বেলপাকা যে বিশেষণই ব্যাবহার করি না কেন, সেই লেভেলের গরম থাকে। গিয়েছি অফিসের একটি প্রশিক্ষণে অংশ নিতে। নাম রেজিস্ট্রি করে নিজের ঘর বুঝে নিলাম। আমাদের থাকার ব্যবস্থা হল থাইল্যান্ডের একটি প্রতিরক্ষা বাহিনীর নিজস্ব এলাকার ভেতরে। দুপুরের খাবার খেতে যেয়ে পরিচয় হল থাইল্যান্ডের মেয়ে কিন-এর সাথে। কিন কাজ করে মিয়ানমারের সীমান্তের কাছাকাছি এক শহরে। ওর অবশ্য আর সব থাই মানুষের মত একটা বেশ লম্বা চওড়া নাম আছে। থাই নামের ক্ষেত্রে সংস্কৃত নামের খুব প্রভাব দেখা যায়। প্রথমে খুব খটোমটো লাগলেও, একটু খেয়াল করলে বাঙলা নামের সাথে বেশ মিল পাওয়া যায়।
দুপুরের খাবারের পর শুরু হল প্রশিক্ষণের পরিচয় পর্ব। পরিচয় পর্বকে উপভোগ্য করার জন্য আমাদের সকলের হাতে একটা কাগজ ধরিয়ে দেয়া হল, যাতে ছক করে করে মানুষের বিভিন্ন শখের কথা লেখা আছ। প্রশিক্ষণের জন্য নির্বাচন করার সময়ই আয়োজকেরা ইমেইলের মাধ্যমে জেনে নিয়েছিল প্রশিক্ষণার্থীদের শখ এবং শখ পূরণের সম্পর্কে গল্প। আর সেই তথ্য কাজে লাগিয়েই এই পরিচয়ের খেলা। এত এত সারি সারি উপর নিচে শখের তালিকা দেখে আমার চোখ বেশ বড় বড় হয়ে গেল। একজন পঞ্চাশটির বেশি দেশে ঘুরেছে। একজন দুনিয়ার ভয়ংকর ভয়ংকর পাথুরে পাহাড়ের দেয়াল বেয়ে উঠে, মানে রক ক্লাইম্বিং করে। একজনের শখ পর্বতারোহণ। বেশ কয়েকজনের শখ হাইকিং, মানে বনে, জঙ্গলে, পাহাড়ে হেঁটে হেঁটে ঘুরে বেড়ানো আবার কয়েকজনের শখ ট্র্যাকিং মানে একটু উঁচু, একটু চ্যালেঞ্জিং পাহাড়- পর্বতে হাঁটা। এর বাইরে আরও শখ আছে- সন্তানের সাথে সময় কাটান, পরিবারের জন্য রান্না করা, বাজার করা আর বই পড়া, মুভি দেখা, ছবি আঁকা আর ছবি তোলা তো আছেই। সবচেয়ে অবাক হয়েছিলাম মধ্যবয়সী শান্তমত আমাদের প্রধান প্রশিক্ষক অ্যামেরিকান ভদ্রলোকের শখ দেখে। শার্টের কবজি গুটিয়ে না দেখালে কল্পনাতেই আসত না, ওনার শখ শরীর জুড়ে রঙিন উল্কি আঁকানো। যে মানুষগুলো এখানে এক হয়েছে, এরা সবাই কাজ করে পৃথিবীর যুদ্ধপীড়িত এলাকায় কিংবা যে কোনো দুর্যোগ আক্রান্ত এলাকায়। জীবনের একটা বড় অংশ এদের কাটে দুর্যোগের মাঝে গিয়ে বিপদগ্রস্ত মানুষকে সাহায্য করতে করতে। এরা প্রায় সবাই থাকে পরিবার থেকে দূরে। সেই মানুষগুলোর রকমারি শখ দেখে স্বীকার করতেই হল, শখের তোলা লাখ টাকা। শখ ছাড়া কি আর আছে জীবনে!
বিকেলে কিন আর আমি ঘুরতে বেরুলাম সমুদ্রের ধারে। সন্ধ্যার আকাশে সে কি রঙ! মুহূর্তে মুহূর্তে আকাশ তার রূপ পাল্টাচ্ছে। কি ভীষণ কমলা আকাশ! কমলা মিলিয়ে যেতে যেতে নীলের নানা শেড। সেই নীলের ছায়া সমুদ্রে পড়ে, সমুদ্রের নীল জল আরও নীল হয়ে উঠল। আমরা যেন সম্মোহিত হয়ে গেলাম। দু’জন সমুদ্রের ধারে বসেই রইলাম । কিছুটা দূরে আস্তে আস্তে ঝলমল করতে শুরু করল পর্যটকের জন্য অপেক্ষমাণ সারিবদ্ধ সরাইখানাগুলো। আর আমাদের দিকটায় জ্বলে উঠল নিরাপত্তারক্ষার কড়কড়ে আলো। আমরা আমাদের ঘুরে বেড়াবার গল্পে জমে গেলাম। কিন জানালো, কিছুদিন আগে ও ঘুরে এসেছে মালয়েশিয়ার একটি প্রাাচীনতম বন থেকে। গিয়েছিল একাই। যাওয়ার পথে নৌকায় পরিচয় হয় দু’জন ভ্রমণকারীর সাথে। কথায়-কথায় জানা গেল ওদের তিনজনের কারোই কোন নির্দিষ্ট গন্তব্য নেই। কেউ জানে না রাতে কোথায় থাকবে। কেবল জানে বনের ভেতর থাকার অনুমতি নেই। নৌকা নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে একটা জায়গা সবার পছন্দ হয়ে গেল। এদিকে বিকেলও পড়ন্ত। মাঝির আপত্তি সত্ত্বেও ওরা নেমে গেল বনের ভেতরে অচেনা জায়গায়। বিদায় করে দিল মাঝিকে। তারপর নদীর ধারে বনের পাশে থাকার জায়গা খুঁজে নিল। তাঁবু খাটিয়ে থাকবার ব্যবস্থা করল, আর খাবারের জন্য সাথে থাকা কৌটার খাবারই ভরসা। এরপরের চার/ পাঁচ দিন ওরা আর কোথাও নড়ে চড়েনি। সকাল-দুপুর বিকেল-সন্ধ্যা কেবল পাখির ডাক শুনেছে, ঘুমিয়েছে, ভয় পেয়েছে, আড্ডা দিয়েছে আর ছবি তুলেছে। ওর গল্প শুনতে শুনতে ঠিক করে ফেললাম এই বনে আমাকে যেতেই হবে। হবেই হবে। আত্মার ভেতর থেকে ডাক শুনলাম।
কথা প্রসঙ্গে জানলাম, থাই সমাজকে দূর থেকে যতখানি উদার দেখা যায়, ভেতরে তা পুরোপুরি নয়। ওর মা’কে নিয়ে ওর সংসার। বাবা মারা গেছেন বেশ আগে। মা চাকরি করে একাই মেয়েকে বড় করেছে। কিন বিয়ে করেছিল ওর স্কুবা ডাইভিং এর পশ্চিমা প্রশিক্ষককে। দু’জনই এডভ্যাঞ্চার প্রিয় মানুষ। কিন্তু, কিনদের মধ্যবিত্ত সমাজে বেশ কানাঘুষা চলল। থাইল্যান্ডে বিদেশি বিয়ে করাটা খুব স্বাভাবিক মনে হয়েছিল। ওর সাথে কথা বলে জানলাম, শিক্ষিত মধ্যবিত্ত সমাজে একে খুব একটা ভালো চোখে দেখে না। কাজের সূত্রে কিন এবং ওর স্বামী, দু’জন থাকে দুই শহরে। আর ওর মা থাকে ব্যাংকক। বেশ কয়েক বছর এভাবে তিন শহরে ঘুরে ঘুরে সংসার করল ওরা। এক সময় ওর স্বামী হাল ছেড়ে দিল। এভাবে সম্ভব না। কিনকে বা ওর স্বামীকে চাকরি ছাড়তে হবে। প্রশ্নটা হয়ে দাঁড়ালো কে ছাড়বে? দিনশেষে সংসারের আঙুল সেই মেয়েটার ক্যারিয়ারের দিকেই। সমস্যার সমাধান, কিনকে চাকরি ছাড়তে হবে। এক্ষেত্রে পশ্চিমের পুরুষের সাথে প্রাচ্যের পুরুষের কোন পার্থক্য দেখা গেল না। নিজের এতদিনের এত কষ্ট করে গড়ে তোলা এত ভালো ক্যারিয়ার ছেড়ে কেবল সংসার করার কথা কিন ভাবতে পারলো না। তাই স্বেচ্ছায় সরে এলো সংসার থেকে। আর মেয়ের সংসার টিকলো না বলে, ওর মাকে শুনতে হল নানান মন খারাপ করা কথা। একদিকে নিজের স্বাতন্ত্র অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা, আরেকদিকে সমাজের মানুষের কথা থেকে মা’কে রক্ষা- এই দুই মহাযুদ্ধের মাঝে থেকেও কিন নিজের শান্তি খুঁজে পায় ঘুরে বেড়িয়ে, ক্যামেরায় প্রকৃতির ছবি তুলে। ওর একটা মজার বিষয় দেখেছিলাম, ও যেখানেই যাক সেখানকার সব কুকুর বিড়াল ওর আশেপাশে ঘুরঘুর করে। ওর বাড়িতে নাকি তিনটা বিড়াল আর একটা কুকুর এসে জুটেছে। ওর দুই হাত জুড়ে কেবল কুকুর বিড়ালের রাগ আর ভালবাসার আঁচড়ের দাগ। মানুষ বুঝে না, ভালবাসার মর্ম কুকুর-বেড়াল ঠিকই বোঝে!
হুয়াহিনের নাইট মার্কেট খুব বিখ্যাত। থাইল্যান্ডের আর সব নাইট মার্কেটের মতই। ভ্যানে করে হরেকরকম জিনিসের পসরা বিছিয়ে বসেছে বিক্রেতারা। মিয়ানমার থেকে আসা তিনজন খুব আগ্রহের সাথে দেখছিল এবং কিনছিল ছোটোখাট উপহার সামগ্রী। ওরা আমাকে মিয়ানমার যাবার আমন্ত্রণ জানালো। মাথায় টুকে রাখলাম আমি। রাস্তার উপর বসা রাতের মার্কেটে ঘুরতে ঘুরতে একটু ভয় ভয়ও লাগছিল। এই শহরের নাম আমি প্রথম জেনেছিলাম অফিস থেকে মোবাইলে পাঠানো একটা সতর্কবার্তা থেকে। ২০১৬ সালের আগস্টের ১১ তারিখ, বোমা বিস্ফোরিত হয় হুয়াহিনে। মারা যায় একজন, আহত হয় অনেকে। এর পরেরদিন ১২ আগস্ট আবার হুয়াহিনসহ বেশ কয়েকটি শহরে বোমা বিস্ফোরিত হয়। ওই সময়টায় সরকারি বন্ধ ছিল। আমি পরিকল্পনা করছিলাম একটা দ্বীপে ঘুরতে যাওয়ার। অফিস থেকে সাফ জানিয়ে দিল, পরবর্তী নির্দেশ না দেয়া পর্যন্ত ঘর থেকে বের হওয়া যাবে না। খবরের কাগজ জানালো যদিও কেউ হামলার দায় স্বীকার করেনি, কিন্তু দেশের দক্ষিণে মালয়েশিয়ার কাছাকাছি অঞ্চল নিয়ে আলাদা হয়ে গিয়ে ইসলামিক শরিয়া আইনে দেশ চালাতে চায় যেসব সন্ত্রাসী দল, তাদেরই কেউ এইসব হামলার জন্য দায়ী। থাইল্যান্ডের দক্ষিণাঞ্চল মালয়-মুসলিম অধ্যশিত এলাকা। এদের ভাষা সংস্কৃতি বুড্ডিস্ট অধ্যশিত মূল থাইল্যান্ড থেকে আলাদা। সুদীর্ঘ সময় থেকেই ওই অঞ্চলের মুসলিমেরা থাইল্যান্ডের মূলধারা থেকে আলাদা হয়ে গিয়ে, নিজেরা এই অঞ্চল শাসন করতে চায় নিজস্ব সংস্কৃতি আর ধর্মীয় আইন মেনে। ১৯৩৪ সালে প্লেক নামে এক থাই মার্শাল দেশের সকল জাতিগোষ্ঠীর ভাষা-সংস্কৃতি- ঐতিহ্যকে ছুড়ে ফেলে দিয়ে, একক থাই সংস্কৃতি ও ভাষা প্রতিষ্ঠার মিশন হাতে নেন। এতে করে দক্ষিণাঞ্চলের মুসলিমেরা ক্ষেপে যায়, এবং সেই প্রায় একশ বছর আগের অদূরদর্শিতার ফলাফল হল বর্তমানের অশান্ত দক্ষিণাঞ্চল। ২০০০ সালের পর বিচ্ছিন্নতাবাদীরা সাধারণ মানুষের উপর হামলা বাড়িয়ে দেয়। এর মাঝে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীদের উপর হামলা হতে থাকে আশঙ্কাজনকভাবে। বিশেষত নারী শিক্ষকদের টার্গেট করে মেরে পুড়িয়ে ফেলার মত বীভৎস ঘটনা বাড়তে থাকে। এ-নিয়ে জাতিসংঘের ‘এটাক অন এডুকেশন’ একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ঘটনার উৎপত্তিস্থল হল পাত্তানি নামে একটা জায়গা। সেখানে একবার গিয়ে মনে হয়েছিল আমি একটি যুদ্ধের জন্য সদা প্রস্তুত শহরে এসেছি। সম্পূর্ণ এলাকা ছিল সেনাবাহিনীর কঠোর নজরদারি আর পাহারায়। দুপুর দু’টার পর আমাদের ওই শহরে থাকার কোন অনুমতি ছিল না।
যে প্রশিক্ষণার্থী পঞ্চাশটির অধিক দেশ ঘুরেছে, ওকে প্রশ্ন করেছিলাম কোন দেশ সবচেয়ে সুন্দর লেগেছে? ও গলার স্বর নামিয়ে উত্তর দিয়েছিল, ‘আফগানিস্তান’, তবে সেটা দেশটি ক্ষত-বিক্ষত হবার আগে। এখন এসব বলা বারণ। চাকরি থাকবে না। মন ভারী হয়ে উঠলেও, দু’জনে কেন যেন হেসে উঠেছিলাম।
আগামী সপ্তাহে যাবো থাইল্যান্ডের উত্তরের শহর চেংরাই- এ। ওখানকার সাদা মন্দির (হোয়াইট টেম্পল) তার কারুকার্যের জন্য জগত বিখ্যাত। এবার অপেক্ষা সেই শিল্পকর্ম দেখার। ৎঁঢ়ংনফ@মসধরষ.পড়স <সধরষঃড়:ৎঁঢ়ংনফ@মসধরষ.পড়স>

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিতর্কিত ৩ কৃষি আইন বাতিলের ঘোষণা মোদীর
পরবর্তী নিবন্ধচন্দ্রাবতী আর রেহানা মরিয়ম নূর