চন্দ্রাবতী আর রেহানা মরিয়ম নূর

ভিন্ন নাম, অভিন্ন সত্তা

ফারহানা আনন্দময়ী | শনিবার , ২০ নভেম্বর, ২০২১ at ৯:০২ পূর্বাহ্ণ

চন্দ্রাবতী। বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারীকবি। নারীকবি শুধু নন- একজন নারীবাদী কবি। ভাবা যায়, আজ থেকে চারশত বছর আগে একজন নারীলেখক রামায়ণ লিখছেন রামকে তুষ্ট করে নয়, সীতাকে মহিমান্বিত করে! প্রজাদের মনরক্ষায় রাম যখন সীতাকে তার সতীত্বের প্রমাণ দিতে অগ্নিপরীক্ষায় সামিল হতে বলেছেন, এই চন্দ্রাবতীর কাজলের কালিতে লেখা সীতার আত্মসম্মানে আঘাত করেছে তা। চন্দ্রাবতী প্রশ্ন তুলেছেন তার রামায়ণে, রামকে তিরস্কার করেছেন। পুরুষতান্ত্রিক চিরায়ত অসম্মানকে চন্দ্রাবতী রুখে দিয়েছেন তার কলমে। পৃথ্বীমাতার কোলে তুলে দিয়ে সীতার সম্মান তিনি বাঁচিয়েছেন তার রামায়ণে। তো, এই চন্দ্রাবতীকেই প্রথম নারীবাদী নারীকবি হিসেবেই অভিবাদন জানাবো আমরা, এই একবিংশ শতাব্দীর সূচনাপর্বে দাঁড়িয়ে।
চন্দ্রাবতীর জন্ম ষোড়শ শতাব্দীতে হলেও, কবির লেখালিখির বিস্তার সপ্তদশ শতাব্দীতে গড়িয়েছে। তাঁর লোকগীতিকা, পালাকাব্য আর রামায়ণকাব্য কালের পরম্পরায় এখনো উজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। সেই চন্দ্রাবতীর জীবন, মৈমনসিংহ গীতিকা আর চন্দ্রাবতীপালাকে অনুসরণ করে বাংলাদেশে নির্মিত হলো এক কাব্যিক চলচ্চিত্র ‘চন্দ্রাবতী কথা।’ এ চলচ্চিত্রের পর্যালোচনা লিখছি না আমি। দর্শক-ভাবনা জানাচ্ছি কেবল।
চন্দ্রাবতী কথা’র পরিচালক রাশেদ চৌধুরীকে কুর্নিশ জানাতেই হয় তার সাহসিকতার জন্য। সমগ্র বিশ্ব যখন কেবল বাণিজ্য আর পুঁজিবাদ অভিমুখী, ঠিক এরকম সময়ে তিনি সেলুলয়েডের পর্দায় একটি দীর্ঘ কবিতা লিখে গেছেন। কোমল এক কবিতা। স্পর্শী এক কবিতা। চন্দ্রাবতী কথা-র শো পূর্ণ প্রেক্ষাগৃহ চলবে, নাকি মাঝপথে মিলনায়তন অর্ধেক খালি হয়ে যাবে, সেই ভাবনা মাথায় রেখে পরিচালক এই চলচ্চিত্র সৃষ্টি করেননি। প্রেক্ষাগৃহে যদি শেষ পর্যন্ত দশজন দর্শকও মুগ্ধতা নিয়ে চন্দ্রাবতীকে দেখেন, জানেন, পাঠ করেন- তো ধরে নেবো, চন্দ্রাবতী কথা-র নির্মাণ সার্থক হয়েছে। সার্থক আর সফল হবার মধ্যে একটা সূক্ষ্ম ফাঁক আছে। চন্দ্রাবতী কথা একটি সার্থক সৃষ্টি।
পাঠক-শ্রোতা-দর্শকের রুচির দায় কখনোই নির্মাতাশিল্পীর নয়। দর্শক-পাঠককে ভালো লাগাতেই হবে, এই দায়বোধ থেকে ‘ক্ল্যাসিক’ সৃষ্টি হয় না, হয়নি। শিল্পীকে দায়বদ্ধ থাকতে হয় কেবল শিল্পের প্রতি, ইতিহাসের প্রতি, পরম্পরার প্রতি। ‘ফাইননেস’ বিষয়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ- কেবল শিল্পনির্মাণে নয়, জীবনের মৌলিকবোধের চর্চায়। এ দেশের টিভি চ্যানেলগুলোতে দেখানো প্যাকেজ নাটক দেখে বিনোদিত হওয়া দর্শকের পছন্দানুসারে নিশ্চিতভাবেই এই সিনেমা চিরকালীন ‘ফ্লপ’ এর তালিকায় তলানিতে পড়ে থাকবে। থাকুক। তাতে বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসের অ্যালবামের উজ্জ্বলতায় কিছু কম পড়বে না। জীবন থেকে নেয়া, সীমানা পেরিয়ে, মাটির ময়নার মতোই চন্দ্রাবতী কথাও ঠায় দাঁড়িয়ে থাকবে ‘পথ-দেখানো, আলো-ছড়ানো’ চলচ্চিত্র হয়ে। পটচিত্র আর পালাগানের হাত ধরাধরি করে এগিয়ে যাওয়া এই সিনেমাকে আমি বলবো, এ অবশ্যই অগ্রসরমনস্ক চলচ্চিত্রপ্রেমীদের জন্যই নির্মিত একটি চলচ্চিত্র।
চন্দ্রাবতী কথা-র সিনেমাটোগ্রাফি চেয়ে চেয়ে দেখবার মতো। অতি চমৎকার। কিশোরগঞ্জের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তো আছেই, চন্দ্রাবতীর একান্ত ও একলা আবাস শিবমন্দিরটি চোখ থেকে সরছেই না সিনেমাটি দেখবার পর থেকে। যদিও সুগন্ধার অতি পুরাতন প্রজেক্টরের পর্দায় তা শতভাগ নিপুণতায় ফুটে ওঠেনি। সঙ্গীত মন পেতে শুনবার মতো; পরাণ বিরাম পেল তাতে। সাত্যকি ব্যানার্জিকে ধন্যবাদ। অভিনয়ের কথা যদি বলি, সকল খ্যাতনামা অভিনেতাদের পাশে অভিনয়গুণে নিজের জায়গা পোক্ত করেছেন তনয় বিশ্বাস আর ইমতিয়াজ বর্ষণ। চন্দ্রাবতী স্বেচ্ছায় নির্বাসিত একাকী জীবন বেছে নেবার পরের পর্বে এই দুই অভিনেতার অভিনয় সত্যিই হৃদয় ছুঁয়ে গেছে। চন্দ্রাবতী চরিত্রে অভিনয়-করা দিলরুবা দোয়েলসহ বাকিরাও যার যার সাধ্যমত সর্বোচ্চটুকুই দিয়েছেন। অনেকদিন পরে সেই কৈশোরে দেখা মিতা রহমানকে অল্প সময় পর্দায় দেখলাম, ভালো লাগলো। সবশেষে পরিচালক এন রাশেদ চৌধুরীকে আবারো অভিবাদন, ১৪৫ মিনিট ব্যাপ্তির এই বেদনাবিঁধুর কবিতাটি সেলুলয়েডে লিখবার জন্য।
এবার ফিরি অভিন্ন সত্তার ভিন্ন নাম রেহানা মরিয়ম নূরের কাছে। সেদিন সন্ধ্যায় রেহানা মরিয়ম নুর দেখে যখন সিনেমা হল থেকে বেরোচ্ছি, আমার চোয়াল তখনো শক্ত, দাঁতে দাঁত পিষছি, নিঃশ্বাস পড়ছে শব্দ করে। গলার মধ্যে কী এক অদ্ভুত অনুভব দলা পাকাচ্ছে- না, সে কান্না নয়, অন্যকিছু। শুধু রেহানার ক্রোধ আর ক্ষোভ নয়, সাথে ইমুর জেদ ততক্ষণে সংক্রমিত হয়েছে আমার মধ্যেও। ক্রোধ আর জেদের তেজে সবকিছু পুড়ে খাক্‌ হতে থাকে। প্রবল এক ভাঙচুরের স্পর্ধা জাগে। এই যে কিছু মানুষ এই সিনেমা দেখে বেরোতে বেরোতে ভাববে, ‘মেয়েমানুষের এত তেজ কেন?’ এখানেই রেহানা মরিয়ম নুর নির্মাণ শতভাগ সার্থক হয়ে ওঠে। ‘তেজ কেন’ প্রশ্ন করবার সাথে সাথে ওই প্রশ্নটাই স্বাভাবিকভাবে সামনে চলে আসে, ‘এত তেজ আসে কোত্থেকে?’ তেজের উৎসটা তো এক অবিরাম চলা লড়াই-পথ। এই রোগাক্রান্ত সমাজে সুস্থভাবে বেঁচে থাকতে গেলে এই তেজটুকুই সবচেয়ে বেশি দরকার। ললিপপ মুখে গুঁজে-থাকা, মগজে খিল-দেয়া নারী-পুরুষেরা এই তেজের মর্মার্থ বুঝতে অপারগ।
বিশ্বাস ও বচনে সৎ, জেদিপ্রকৃতির একজন নারী, তার কর্ম-চেতনায় এটুকু স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে যে, রেহানা নারীবাদে বিশ্বাসী এবং তার নিজস্ব জীবনে তা শতভাগ চর্চা করেন-সাথে ধর্মটাও চর্চা করেন। রেহানার মতো নারী আমাদের সমাজে অনেক অনেক আছেন। লড়াই করে এই সমাজে ‘একলা নারী’ হয়ে টিকে আছেন; শুধু তাদের লড়াইয়ের ক্ষেত্রটা ভিন্ন। সেই ময়দানে এরা সকলে একলা একলাই দাঁড়িয়ে গেছেন, যার যার যোগ্যতা অনুসারে। কিন্তু এই দাঁড়াবার পথটা কারো জন্যেই মসৃণ নয়। নিরন্তর সংগ্রাম করতে হয়েছে, সমাজের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে শিখতে হয়েছে, পুরুষের সঙ্গে লড়াই করতে হয়েছে, এমনকী অন্য নারীর ভ্রু-কুঞ্চনকে অবজ্ঞা করতে হয়েছে। পুরুষসহকর্মীর কুৎসিত যৌন-ইঙ্গিতের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হয়েছে, আবার সেইসব পুরুষেরই স্ত্রীদের আঙুল-নির্দেশের লক্ষ্য হতে হয়েছে সেই একলা নারীকেই। তারপরেও তাঁরা ঋজুভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থেকেছেন, এগিয়ে গেছেন… আমাকে এবং আমাদেরকে ছাড়িয়ে অনেকটা সামনে। রেহানা এবং রেহানার মতো কেউ কেউ তার নিজস্ব কঠিন সময়ে দৃশ্যত একলা হলেও, মানসিকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ।
আপাতদৃষ্টিতে সমাজের কাছে মনে হচ্ছে, রেহানা যেহেতু একজন ‘স্ট্রাগলিং সিঙ্গেল মাদার’, তিনি তার পেশাগত কাজের ব্যস্ততায় কন্যাকে যথেষ্ট সময় দিচ্ছেন না। কন্যা আর মায়ের মধ্যেও একটা মনস্তাত্ত্বিক লড়াই প্রতিনিয়ত চলতেই থাকে। বয়সে শিশু হলেও ‘ইমু’ নামের কন্যাটির অন্তর্গত জগতে মায়ের একরোখা, জেদি, স্বতন্ত্র ব্যক্তিত্বের প্রতিবিম্ব স্পষ্টই দেখা যায়। রেহানাকে কেবল বাইরের জগতেই নয়, ঘরে পরিবারে মন কষাকষির টান্‌টান্‌ এক দড়ির এক প্রান্ত ধরে রেখে যাপিত জীবনে বাঁচতে হয়। তবে রেহানার অন্তর্গত টানাপোড়েন, নৈতিক আপসহীনতাকে কখনো মনে হয়েছে তাকে স্বৈরাচারী করে তুলেছে, খানিকটা অমানবিক-ও। ইমুর প্রতি তার কিছু আচরণে এর প্রতিফলন স্পষ্ট। নৈতিক ব্যাখ্যা আর মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার এক দ্বৈরথ চলমান পুরো চলচ্চিত্রটির শুরু থেকে একেবারে শেষ দৃশ্য পর্যন্ত। সিনেমা হলের আসনে বসে রেহানা আর ইমুর চিন্তাজগতের এই অমোঘ টানাপোড়েনের অনেকখানি অনুভব করাই যায়।
এই সিনেমা কয়েক মাস আগে যখন কান চলচ্চিত্র উৎসবে গেল, ট্রেলার দেখে আর বিদেশি পত্রিকার রিভিউ পড়ে একটা নিজস্ব ভাবনা লিখে দাঁড় করিয়েছিলাম। সেদিন সিনেমাটা দেখবার পরে আবার মিলিয়ে নিলাম। মেলাতে পেরেছি, বেশিরভাগটাই মিলেছে। তবে বিশেষ একটি বিষয় যুক্ত করা আবশ্যকীয় হয়ে পড়েছে। তা হলো, অভিনয়। রেহানা তো রইলোই, এর বাইরে বিশেষ করে, ইমু চরিত্রটি। একইসঙ্গে অ্যানি, আরেফিন চরিত্র দু’টোর অভিনয়! এককথায় পরিণত আর দারুণ সাবলীল। সিনেমা শেষে সকলে যখন বেরিয়ে যাচ্ছে প্রেক্ষাগৃহ থেকে, আমি ঠায় দাঁড়িয়ে আছি, সিনেমার ক্রেডিট-লাইন পড়বার জন্য। ইমু-আমার সমস্ত আগ্রহ তখন ইমুতে গিয়ে ভর করেছে। আফিয়া জাহিন জাইমা! এই শিশুর অভিনয় সত্যিই এক বিস্ময়! মুগ্ধতা ছাড়িয়ে স্তব্ধতায় গিয়ে পৌঁছুনোর মতো। “তরুণ হাসির আড়ালে কোন্‌ আগুন ঢাকা রয়- এ কি গো বিস্ময়! অস্ত্র তোমার গোপন রাখো কোন্‌ তূণে।” এই পঙক্তি কেবল ওর নামের পাশেই যথার্থ রূপ নেয়।
মা আর মেয়ের এই মনস্তাত্ত্বিক জটিলতার দ্বৈরথকে বাঁধন এবং জাইমা সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। রেহানা আর বাঁধন একটা সময়ে এসে মিলেমিশে এক হয়ে গেছে। বাঁধনের রিয়েল-জীবনের লড়াই আর রিলে-জীবনের চিত্রনাট্য এতটাই মিলে গেছে যে তিনি রেহানা চরিত্রটার সাথে প্রতি মুহূর্তে সংযোগস্থাপন করতে পেরেছেন। কিন্তু ইমু! জাইমা! সে কী করে পারলো তার চরিত্রের সাথে এতখানি লীন হয়ে যেতে! সত্যিই, এ এক বিস্ময়! অভিনয়ের পরে আর রইলো এই সিনেমার নির্মাণ। নির্মাতা সাদকে অভিবাদন জানাই, তার সাহসকে শিল্পরূপে নির্মাণের জন্য। সিনেমাস্কোপে বিষাদনীলের ঘোর তৈরি, মেডিকেল কলেজের একটামাত্র করিডোরকে কেন্দ্রে রেখে দুর্দান্ত সিনেমাটোগ্রাফিতে এক ঘণ্টা পঞ্চাশ মিনিট ব্যাপ্তি এক বৃত্ত আঁকা- এতটুকু ক্লান্ত করেনি চোখকে। বদ্ধ ওই করিডোরটা যেন আমাদের মগজ, কিছুতেই বাইরের আলো-হাওয়াকে ঢুকতে দিতে চাইছে না। সমাজের স্থবিরতার নির্দেশক ওই করিডোর। রেহানা একটা দৃশ্যে মুখে পানির ঝাপটা দিচ্ছে- বারংবার, বারংবার…! জড়তুল্য পাথরের মতো যা চেপে বসে আছে সামাজিক ক্ষতরূপে, কিছুতেই সারানো যাচ্ছে না। এভাবেই দৃশ্য থেকে দৃশ্যে সাদ সার্থক নির্মাণশিল্পী হয়ে উঠলেন।
শেষে একটা কথাই বলবার, না, নির্মাতা কিছু বলতে চাননি, দর্শককে কোনো বার্তা পৌঁছাতে চাননি সিনেমাটি দিয়ে- সিনেমার শেষে। তিনি কেবল ভাবতে বলেছেন আমাদেরকে, আমাদের চারপাশ নিয়ে। যেন সেই অমোঘ বাণী- ‘ভাবো, ভাবো। ভাবা প্র্যাকটিস করো।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধহুয়াহিনের নীল আকাশ
পরবর্তী নিবন্ধঔপনিবেশিকতার ক্ষত উঠে এসেছে ওয়ালকট ও নজরুলের কবিতায়